মহান বিজয় দিবস। বাঙালি জাতির সেরা গর্বের দিন, স্বপ্ন পূরণের দিন। বিশ্বের মানচিত্রে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা ‘বাংলাদেশ’ কে অন্তর্ভুক্ত করে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দেয়ার মতো অহঙ্কারের দিন। এমন আনন্দের দিনে আমাদের দেশের সরকারি–আধা সরকারি–বেসরকারি–স্বায়ত্তশাসিত ইত্যাদি ধরনের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হতে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তন্মধ্যে শহীদ মিনারে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে পুষ্পস্তবক অর্পণ, কুচকাওয়াজ, র্যালী, বিভিন্ন ইভেন্টের খেলাধুলা ইত্যাদি জাঁকজমকভাবে আয়োজন করা হলেও তেমন গুরুত্বসহকারে সব প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে জোরালোভাবে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয় না বললে মনে হয় আমার তেমন ভুল হবে না। স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসে অন্যান্য আয়োজনের ন্যায় আলোচনা সভা করে এর প্রকৃত ইতিহাস বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে জানানো বাধ্যতামূলক করা এবং ইতিহাস বিকৃতকারীদের চিহ্নিতপূর্বক প্রয়োজনে শাস্তির ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন। স্বাধীনতার পর হতে এ পর্যন্ত আমাদের দেশ শাসনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ছিল, তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার তেমন বেশি দিন এ দেশের মসনদে থাকতে পারেনি। ফলে এ কথা স্পষ্টভাবে বলতে দ্বিধা নেই যে, রাজনৈতিক দল যখনই ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন তখনই তার মনের মতো করে অর্থাৎ তার স্বপক্ষে স্বাধীনতার ইতিহাস রচনা করেছেন। যে কারণে বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস তেমন জানে না। ফলে ‘পরীক্ষায় বিজয় দিবস কখন’ প্রশ্ন করা হলে অনেকে ২৬ মার্চ, আবার কেউ কেউ ২১ ফেব্রুয়ারি মর্মে উত্তর দেয়। পত্র পত্রিকায় এমন খবর দেখলে আমি উত্তরদাতাকে মোটেও দোষারোপ করি না, নিজেকেই অপরাধী মনে করি। কারণ আমরা এ প্রজন্মকে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস বলার, পড়ার, বোঝার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারিনি। বিশ্বের কোনো জাতিই স্বাধীনতার জন্য আমাদের দেশের জনগণের ন্যায় নিঃস্বার্থভাবে এতো কষ্ট করে যুদ্ধ করেননি, হাসি মুখে মৃত্যুকে বরণ করেননি। খুবই দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, যাঁরা এভাবে কষ্ট করে শহীদ হয়েছেন তাঁদের পরিবারের প্রতি বা যাঁরা এখনো বেঁচে আছেন তাদের সকলের প্রতি সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি। ফলে অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বা তাঁদের ওয়ারিশগণকে ভিক্ষার থালি হাতে রাস্তায় বা অভাব অনটনে অকল্পনীয় কষ্টের জীবন যাপন দেখা যায়। অথচ এদের স্বাবলম্বী করা আমাদের তথা এ জাতির নৈতিক দায়িত্ব মর্মে আমি দৃঢ়চিত্তে বিশ্বাস করি। কারণ এদের ত্যাগের কারণেই আমরা এমন সুন্দর দেশের গর্বিত নাগরিক হিসেবে মাথা উঁচু করে নিঃশ্বাস নিচ্ছি। বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়া হতে জানা যায়, অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা অভাব–অনটনে অত্যন্ত নিম্ন মানের দিনযাপন করলেও অনেকে আবার মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সার্টিফিকেটে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা আদায় করেছেন। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা নিরপেক্ষ ভাবে যাচাই বাছাই করা হলে আরো অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমান অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের বিভিন্ন সংস্কারমূলক কাজকে এদেশের অধিকাংশ জনগণের সঙ্গে আমিও সাধুবাদ জানাই।
স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করার জন্য ও সংস্কার কমিটি করে এসব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি বিশ্ববাসীকে জানাতে পারলে তাঁরাও এদেশের ইতিহাসের অংশ হিসেবে এদেশবাসীর অন্তরে অনন্তকাল টিকে থাকবেন। অন্যথায় এদেশ স্বাধীন করার নিপুণ কারিগরদের এ জাতি একদিন ঠিকই ভুলে যাবে, যা হবে আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাকর। এর ফলে নতুন প্রজন্ম আমাদের কখনো ক্ষমা করবে না এবং বিশ্ববাসীর কাছেও আমরা অত্যন্ত ঘৃণিত জাতি হিসেবে চিহ্নিত হবো।