দেশ ছেড়েছেন বসুন্ধরা এমডির স্ত্রী-সন্তানরা

মুনিয়ার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষায় পুলিশ

আজাদী ডেস্ক | শুক্রবার , ৩০ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:৪৭ পূর্বাহ্ণ

কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার আত্মহত্যায় প্ররোচনা মামলার একমাত্র আসামি বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের কয়েকজন সদস্য দেশ ছেড়েছেন। করোনাভাইরাস মহামারীতে নিয়মিত ফ্লাইট চলাচলে বিধিনিষেধের মধ্যে দেশের শীর্ষ এই ব্যবসায়ী পরিবারের সদস্যরা ভাড়া করা একটি বিমানে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে দুবাইয়ের উদ্দেশে রওনা হন বলে বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন এবং এপিবিএনের একাধিক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। খবর বিডিনিউজের।
বসুন্ধরা এমডির পরিবারকে বিশেষ ফ্লাইটের অনুমতি দেওয়ার কথা জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান। গতকাল রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় তিনি বলেন, ‘বুধবার তারা একটি বিশেষ ফ্লাইটের অনুমতি চেয়েছিলেন। আজ (বৃহস্পতিবার) তাদের দেশ ছাড়ার কথা।’ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানন্দরে দায়িত্বরত এপিবিএনের একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজকে বলেন, ভাড়া করা ওই উড়োজাহাজটির ফ্লাইট নম্বর ভিপিসি ১১। রাত ৯টার কিছুক্ষণ আগে সেটি ঢাকা ত্যাগ করে। বিমানের গতিপথ নির্দেশক ওয়েবসাইট ফ্লাইটঅ্যাওয়ারে দেখা যায়, ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে রাত ৮টা ৫৬ মিনিটে রওনা হয় ফ্লাইটটি। রাত সোয়া ১টায় সেটি দুবাইয়ের কাছাকাছি ওমান সাগরের উপরে ছিল।
বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, ওই বিশেষ ফ্লাইটে যাত্রী মোট আটজন। তাদের মধ্যে সায়েম সোবহান আনভীরের স্ত্রী সাবরিনা সোবহান, তাদের দুই সন্তান, ছোট ভাই সাফওয়ান সোবহানের স্ত্রী ইয়াশা সোবহান ও তার মেয়ে এবং দুই পরিবারের তিনজন গৃহকর্মী রয়েছেন। আরেকটি ফ্লাইটে সাফওয়ান সোবহানেরও দুবাই যাওয়ার কথা রয়েছে বলে ইমিগ্রেশনের আরেকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। কলেজছাত্রী মুনিয়ার আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলায় আসামি আনভীরের দেশত্যাগের ওপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে তার পরিবারের অন্য কারও ক্ষেত্রে এরকম বিধিনিষেধ আদালত থেকে আসেনি।
বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা বিশেষ ফ্লাইটের অনুমতি দিয়েছি ঠিকই, তবে তাদের বলা হয়েছে, যারা ওই ফ্লাইটে যাবেন তাদের স্পেশাল ব্রাঞ্চের অনুমতি নিয়ে যেতে হবে।’ এ বিষয়ে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) কর্মকর্তাদের কারও বক্তব্য বিডিনিউজ জানতে পারেনি।
গত সোমবার রাতে গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে মুনিয়ার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধারের পর সেই রাতেই আনভীরের বিরুদ্ধে মামলা করে ওই তরুণীর পরিবার। পুলিশের আবেদনে আদালত পরদিন আনভীরের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিলেও তার আগেই তিনি দেশ ছেড়েছেন বলে গুঞ্জন ছড়ায়। এর মধ্যেই বুধবার তার পক্ষে হাই কোর্টে আগাম জামিনের একটি আবেদন জমা পড়ে। আনভীরের আগে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন তার ভাই সাফিয়াত সোবহান সানবীর। বসুন্ধরা কমিউনিকেশন্সের পরিচালক হুমায়ুন কবীর সাব্বির হত্যাকাণ্ডের পর ২০০৬ সালে সানবীর দেশ ছেড়েছিলেন। তারপর এমডির দায়িত্বে আসেন আনভীর। ২০১১ সালে সাব্বির হত্যামামলায় খালাস পাওয়া সানবীর পরে দেশে ফিরলেও এমডি পদে আর তাকে ফেরাননি তাদের বাবা বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমদ আকবর সোবহান (শাহ আলম)।
এদিকে কলেজছাত্রী মোসারত জাহান মুনিয়া ‘প্ররোচিত হয়েই আত্মহত্যা করেছেন’-এমন প্রাথমিক সন্দেহের ভিত্তিতেই তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের কথা জানিয়েছে পুলিশ। আর সেজন্য ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করার কথা বলেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ কমিশনার সুদীপ চন্দ্র চক্রবর্তী। অপরদিকে গতকাল হাই কোর্টের যে বেঞ্চের কার্যতালিকায় আনভীরের আগাম জামিনের শুনানির কথা ছিল, সেই বেঞ্চ লকডাউন ও মহামারির এই পরিস্থিতিতে আগাম জামিনের শুনানি করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।
উপ কমিশনার সুদীপ বলেন, মুনিয়ার মৃতদেহ আমরা ঝুলন্ত অবস্থায় পাই। সার্বিক পরিস্থির বিবেচনায় আত্মহত্যার প্ররোচনার সন্দেহ হওয়ায় সেভাবেই আমরা মামলা নিই। এখন আত্মহত্যায় প্ররোচনার বিষয়টি প্রমাণের জন্য প্রয়োজন তথ্য-উপাত্ত। সেটার দিকে এখন আমাদের নজর। তদন্তে কী পাওয়া গেছে জানতে চাইলে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, মুনিয়ার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না। দীর্ঘক্ষণ শরীর ঝুলে থাকার কারণে যেসব নমুনা, তা দেখা গেছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আসার পর পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হবে। মুনিয়ার লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে পুলিশ বলেছে, নাক স্বভাবিক ছিল, চোখ বন্ধ ছিল, তবে জিহ্বা আধা ইঞ্চি বাইরে দাঁত দিয়ে কামড়ানো ছিল। জিহ্বায় সামান্য লালাও দেখা গেছে, গলার বাম পাশে কালো দাগ রয়েছে, আর হাত অর্ধমুষ্ঠি অবস্থায় ছিল।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ওই তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়েছিল কিনা, বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে- এসব বিষয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানতে চাওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে উপ কমিশনার সুদীপ চন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আসার পর পুরো বিষয়টি স্পষ্ট হবে। আজ (গতকাল) পর্যন্ত আমরা প্রতিবেদন পাইনি।
এদিকে মুনিয়ার বড় বোনের করা মামলায় পিয়াসা নামে এক নারীর কথা এসেছে। এজাহারে বলা হয়েছে, মুনিয়া ও আনভীরের প্রেমের সম্পর্কের কথা জানতে পেরে আসামির মা সেই পিয়াসার মাধ্যমে ডেকে নিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়েছিলেন মুনিয়াকে।
গতকাল বিকালে পিয়াসার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মুনিয়াকে চেনার কথা এবং আনভীরের মায়ের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, আনভীরের পরিবারের সাথে আমাদের দীর্ঘদিনের পরিবারিক বন্ধন। মুনিয়াকে কখনোই ভয়ভীতি দেখানো হয়নি, বরং তার ভালোর জন্য আনভীরের মায়ের সামনে নিয়ে তাকে বোঝানো হয়েছে।
পিয়াসার ভাষ্য, মুনিয়ার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাকে বোঝানোর যে দায়িত্বটা তার বড় বোনের ছিল, সেই কাজটা তিনি নিজে করেছেন। আনভীর একজন বিবাহিত ছেলে, তার কাছ থেকে সরে যেতে মুনিয়াকে বোনের মত করে বহুবার বোঝানো হয়েছে। মামলায় নাম থাকলেও পুলিশের কেউ এখনও কোনো ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ করেননি বলে এক প্রশ্নের উত্তরে জানান পিয়াসা।
এদিকে গতকাল বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চের কার্যতালিকায় ১৩ ক্রমিক থেকে ২৭ ক্রমিক পর্যন্ত মোট ১৫টি আগাম জামিনের আবেদন ছিল। তার মধ্যে আনভীরের আবেদনটি ছিল ১৪তম ক্রমিকে। কিন্তু গতকাল সকালে ওই আদালত কক্ষের দরজায় টাঙিয়ে দেওয়া এক নোটিসে বলা হয়, ‘বর্তমান লকডাউন এবং কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে অত্র কোর্ট আগাম জামিনের আবেদনপত্র পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত শুনানি গ্রহণ করিবেন না বলে অত্র আদালত অভিমত ব্যক্ত করিয়াছেন।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধকুড়িয়ে পাওয়া শিশুর অভিভাবকত্ব পেলেন পুলিশ কর্মকর্তা
পরবর্তী নিবন্ধমুফতি হারুন ইজহার কারাগারে