দেশে মানবাধিকার লংঘন প্রতিরোধে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন প্রণীত হচ্ছে

জিয়া হাবীব আহসান

| বৃহস্পতিবার , ১১ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৮:১০ পূর্বাহ্ণ

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯ (২০০৯ সনের ৫৩ নং আইন) রহিতক্রমে তা পুনঃপ্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রণীত অধ্যাদেশ ২০২৫ নিয়ে UNDPআয়োজিত Regional dialogue & Consultation meeting বা পরামর্শ সভায় মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনবিএইচআরএফ এর পক্ষ থেকে আমন্ত্রিত পরামর্শক হিসেবে অংশ গ্রহণের সুযোগ পেলাম। নতুন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধান অনুসারে মানবাধিকার সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং নিশ্চিতকরণ রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন। স্পেশাল কন্সাল্টেন ( আইন, সংসদ ও বিচার মন্ত্রণালয়) জনাব ব্যারিস্টার তানিম হোসাইন শাওন কষ্ট করে একটি শক্তিশালী ও চমৎকার ড্রাফটের মাধ্যমে একটি যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের দ্বার উন্মোচন করেছেন। এখানে গুম এর অপরাধ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে (সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব, আনসার, বিজিবি সংস্থা, গোয়েন্দা সংস্থা, তদন্ত সংস্থা সমূহ) কমিশনের আওতায় আনা হয়েছে। যা অতীতে না থাকায় অপরাধীরা দায়মুক্তি পায় এবং সরকারি নির্দেশে চলে গুম, খুন ও মানবতা বিরোধী নানা অপরাধ। ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ বা ভিকটিমকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ সহ অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ প্রদানের ক্ষমতা, যেকোন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পূর্বানুমতি ব্যতীত তদন্ত দলের সারপ্রাইজড ভিজিটের ক্ষমতা, এডিআর এর ব্যবস্থা, লিগ্যাল এইডসহ নানা চমৎকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আমি কমিশনে রাজনৈতিক নিয়োগ চিরতরে বন্ধ করতে পরামর্শ দিয়েছি। কমিশনে অস্থায়ী নিয়োগ বন্ধ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। মানবাধিকার অঙ্গনে কাজ করে এমন যোগ্য, অভিজ্ঞ ও নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তিদের নিয়োগ দান খুবই জরুরি মর্মে অভিমত প্রদান করি। আইনটিকে যুগোপযোগী ও কার্যকর করতে মোট ৪৩টি ধারা সংযোজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে আইনবিদ, মানবাধিকার কর্মী, ভিকটিম, সরকারি আইন কর্মকর্তা, সাংবাদিক, বিচারক, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ অংশগ্রহণ করেন।

গত ৬ ডিসেম্বর্থ২৫ ইং তারিখে চট্টগ্রামের রেডিসন ব্লু বেভিউ হোটেলের কনফারেন্স কক্ষে ইউএনডিপি ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অর্ডিনেন্স ২০২৫’ শীর্ষক সেমিনারে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব মারুফ আল্লাম। তিনি বলেন, নতুন জারি হওয়া জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশসহ সব বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে স্বাধীনভাবে তদন্ত করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। যা আগের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনে ছিল না। আগে কমিশন ছিল পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এখন এটিকে কার্যকর তদন্তকারী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা হয়েছে। এতে বক্তব্য দেন মানবাধিকার অর্ডিনেন্স তৈরি করা ব্যারিস্টার তানিম হোসাইন শাওন, ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি রোমানা সোয়েভার, ইউএনডিপির সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি আনোয়ারুল হক। তানিম হোসাইন শাওন বলেন, নতুন আইনে মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা হয়েছে। ৩০ দিনের মধ্যে প্রাথমিক অনুসন্ধান ও ৬০ দিনের মধ্যে অভিযোগের তদন্ত নিষ্পত্তি করার বিধান রাখা হয়েছে। আর্থিক জরিমানার বিধানও রয়েছে। অনুমতি ছাড়া যে কোনো প্রতিষ্ঠানে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বা কমিশনারদের সারপ্রাইজ ভিজিট করার বিধান রাখা হয়েছে। কমিশন প্রয়োজনে যে কোন প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা চাইলে তা তারা প্রদানে বাধ্য থাকবে।

ইতিপূর্বে মানবাধিকার কমিশন ছিল একটি ঠুঁটো জগন্নাথ টাইপের দলীয় প্রতিষ্ঠান যাকে দন্ত নখর বিহীন প্রতিষ্ঠান বলা হতো। তাই আইনটির ৮০% সংস্কার করতে হচ্ছে। এমতাবস্থায় বিদ্যমান আইনটি বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়ন এর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। খুনগুম, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে এবং মানবাধিকার সুরক্ষায় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে বর্তমান এডইনটেরিয়াম গভর্মেন্ট উদ্যোগ নিয়েছে। আশা করি আগামী নির্বাচিত সরকার পার্লামেন্টে প্রস্তাবিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনটি পাস করবে এবং তা কার্যকর করে দেশে মানবাধিকার ও সূশাসন প্রতিষ্ঠায় যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে।

সম্প্রতি মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ মন্তব্য করেন, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ প্রণয়নের মাধ্যমে বহুদিনের দ্বৈত প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা দূর হয়েছে এবং সুপ্রিম কোর্ট প্রথমবারের মতো পূর্ণ প্রশাসনিক ও আর্থিক স্বায়ত্তশাসন লাভ করেছে। তিনি আরো বলেছেন, এর ফলে বিচার বিভাগ এখন নিজস্বভাবে পদসৃজন, বাজেট বরাদ্দ, প্রশিক্ষণ উন্নয়ন ও নীতিমালা প্রণয়নসহ বিচার সংস্কারকে দীর্ঘমেয়াদি এবং টেকসই ধারা হিসেবে এগিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে। ‘অপারেশনালাইজিং কমার্শিয়াল কোর্ট’ শীর্ষক এক সেমিনারে শনিবার প্রধান বিচারপতি এ কথা বলেন।

যৌথ উদ্যোগে রেডিসন ব্লু চট্টগ্রাম বেভিউ হোটেলের কনফারেন্স কক্ষে এই সেমিনার আয়োজন করে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)। সেমিনারে প্রধান বিচারপতি আরো বলেন, ‘গত দেড় বছরে সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সাংবিধানিক স্বচ্ছতার ভিত্তিতে বিচার ব্যবস্থায় যে মৌলিক রূপান্তর সাধিত হয়েছে, তা দেশের বিচারিক ইতিহাসে এক মাইলফলক। এর মাধ্যমে দেশের বিচার বিভাগ এক নতুন প্রাতিষ্ঠানিক যুগে প্রবেশ করেছে।’

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারপার্সন ও কমিশনার বৃন্দ ৪ (চার) ব্‌ছরের জন্য নিযুক্ত হবেন। ৭ (সাত) সদস্যের সমন্বয়ে একটি বাছাই কমিটি গঠিত হবে। কমিশন মানবাধিকার সংরক্ষণে নিয়োজিত ব্যক্তি বা হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার্সদের হয়রানি থেকে সুরক্ষা প্রদান ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কাজে কর্মরত সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিকদের পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান করবে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও জনসচেতনতা সৃষ্টিতে নানা পদক্ষেপ ও কর্মসূচী পালন করবে। কমিশন তাদের কার্যাবলির সার্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। ভিকটিম, সাক্ষী ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির গোপনীয়তা ও সুরক্ষা প্রদান করবে। কমিশনের বিষয় ভিত্তিক নানা কমিটি থাকবে। যেমনঃ গবেষণা, প্রতিবন্ধি ব্যক্তি, হিজড়া জনগোষ্ঠী, নারী, শিশু, প্রবাসী, পরিবেশ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ইত্যাদি। কমিশনের কর্মকাণ্ডে বা আদেশ পরিপালনে যে কোনো বাধা অপসারণে আইনী পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগও রাখা হয়েছে।

এমতাবস্থায় প্রস্তাবিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনটি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে ও রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক সেচ্ছাচারিতা প্রতিরোধে যুগপৎ ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

লেখক: আইনবিদ, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী এবং মহাসচিব, বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন বিএইচআরএফ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভুল করে ভুলে যেতে চাই
পরবর্তী নিবন্ধটার্মিনাল হস্তান্তর এবং বাংলাদেশের লাভক্ষতি