বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত একটি জরিপের প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের শেষ তিন মাসের তুলনায় ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে বেকার বেড়েছে প্রায় আড়াই লাখ। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাস্তবে বেকারের সংখ্যা আরো অনেক বেশি। বিবিএসের তথ্যমতে, দেশে মোট বেকারের ১২ শতাংশই উচ্চশিক্ষিত। অথচ যাদের কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তাদের বেকারত্বের হার মাত্র ১.০৭ শতাংশ। মানসম্মত শিক্ষার অভাবেই দেশে বেকারত্ব, বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেশি বাড়ছে। শ্রমশক্তি জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিন মাসের ব্যবধানে শ্রমশক্তিতে যুক্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ২ লাখ ৯০ হাজার। জনগোষ্ঠী বাড়লেও সেই তুলনায় দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। গত ২০ আগস্ট পত্রিকান্তরে প্রকাশিত একটি তথ্যে জানা যায়, বিগত পাঁচ বৎসরে দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে, কর্মসংস্থানের প্রশ্নে তরুণদের মধ্যে উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছে। ২০১৭ সালে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা যেখানে ৪ লক্ষ ছিল, সেখানে ২০২২ সাল শেষে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৮ লক্ষ। বর্তমানে উচ্চশিক্ষিত তরুণের সংখ্যা নিশ্চয়ই আরো বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোনো একটি দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের অধিক যখন শ্রমশক্তিতে পরিণত হয়, অর্থাৎ পরনির্ভরশীল জনসংখ্যার চেয়ে কর্মক্ষম জনসংখ্যার হার অধিক হয়, তখন সেই অনুপাতকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলে (ইউএনএফপি) উল্লেখ আছে, ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী ব্যক্তি কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হিসাবে বিবেচিত। এই বয়সী মানুষ তাদের শ্রম ও মেধা দিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে প্রভুত ভূমিকা রাখতে পারেন। সেই হিসাবে বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধাভোগী। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে শতকরা ৬৮ শতাংশ মানুষ কর্মক্ষম। জনমিতির হিসাবে, ২০১২ সাল হতে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবর্ণ সময় পার করছে, যা ২০৪০ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। এর পর থেকে দেশে মৃত্যুহার আরো কমে গিয়ে দেশে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকবে। এমতাবস্থায় ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুযোগ নিতে হলে ঐ সময়ের পূর্বেই দেশের বর্তমান কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষিত করে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর করতে হবে। তাদের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে। পরিতাপের বিষয় হল, এই ক্ষেত্রে প্রত্যাশা এবং বাস্তবতার মধ্যে বিশাল ফারাক রয়েছে আমাদের!
দেশে শিক্ষিতের হার শতকরা ৭০ শতাংশের মতো হলেও মোট জনশক্তির প্রায় এক–তৃতীয়াংশই বেকার। যাদের অধিকাংশই শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত, কিংবা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে লক্ষাধিক, যাদের বেশিরভাগের কর্মসংস্থান হয় না। ফলে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও। পরিসংখ্যান মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। এমনিতেই বিশ্ব মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বেই কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে। দেশে কর্মসংস্থান যে হারে বাড়ছিল, তা হ্রাস পেয়েছে নানা কারণে। তাই অনেকে শ্রম বেচতে বাইরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা অস্থিরতার কুফল যেসব দেশ ভোগ করছে বাংলাদেশ তার অন্যতম। সারা বিশ্বে প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি নাগরিক কর্মসংস্থানের কারণে বসবাস করছে। এর মধ্যে মালয়েশিয়ায়ই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক। তাই বলা যায়, সার্বিক পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ তা সহজেই অনুমেয়। পরিস্থিতির অবনতি রোধে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ কোনোটাই মূলত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে বৃহৎ এ জনগোষ্ঠী সম্পদ নয়, রাষ্ট্রের বোঝা হিসেবেই ভাবা হচ্ছে।
রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আর কে চৌধুরী তাঁর এক লেখায় লিখেছেন, বাংলাদেশে চাহিদা অনুযায়ী কর্মসংস্থান না হওয়ায় প্রতি বছর কর্মক্ষম মানুষ নতুন করে বেকার হচ্ছে। কারণ প্রবৃদ্ধির সমান্তরালে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। ফলে দেশের কর্মক্ষম শ্রমশক্তির একটি বড় অংশ কাজের বাইরে থেকে যাচ্ছে। অথচ দেশের সার্বিক উন্নয়নে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি নতুন কর্মপরিবেশের উপযোগী একটি শ্রমশক্তিও তৈরি করতে হবে। কর্মসংস্থান কী করে সৃষ্টি করা যাবে? কাজের সুযোগ তৈরি করতে হবে। দেশে প্রতি বছর নতুন জনশক্তি যুক্ত হচ্ছে। তাদের উৎপাদনশীলতায় নিয়ে আসতে হবে। তরুণদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যথাযথ কাজে লাগাতে হবে। তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাটাই এখন জরুরি। উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দিলে দেশ এগিয়ে যাবে।