‘দেশে দেশে ভ্রমণ শেষে’: ষোলকলায় পূর্ণ একটি ভ্রমণসম্ভার

হানিফ মজুমদার | শুক্রবার , ১৩ অক্টোবর, ২০২৩ at ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

জ্ঞান অর্জনের জন্য দশটি বই পড়ার চেয়ে দশ মাইল ভ্রমণ করা যে অধিক ফলপ্রসু তা সবারই জানা। কিন্তু দশ মাইল ভ্রমণ করে কেউ যদি একটি বই লেখে, সেটা তো হয়ে ওঠে একের ভিতর দুই। বলা চলে এর মাধ্যমে বই পড়া ও ভ্রমণ একসাথেই ঘটে। আর পড়তে পড়তে যে মানুষ ভ্রমণ করতে পারে তাকে আমরা বলি মানস ভ্রমণ। পাঠকের মানস ভ্রমণে তৃপ্তিদায়ক অনুভূতি জাগানোর মতোই একটি ভ্রমণগদ্যের বই দেশে দেশে ভ্রমণ শেষে। লেখক সাহিত্যিক ও সাংবাদিক হাসান আকবর। প্রায় পাঁচশ পৃষ্ঠার বিশাল এই বইটিতে পাঁচটি দেশের ভ্রমণ বৃত্তান্ত স্থান পেলেও এর বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে মহাভারত বা ভারতবর্ষের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শহরের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। এছাড়া রয়েছে ভারতেরই দুই দ্বীপ প্রতিবেশী রাষ্ট্র শ্রীলংকা ও মালদ্বীপ। রয়েছে পৃথিবীর বিস্ময়, আফ্রিকার দেশ মিশর ও মধ্যপ্রাচ্যের সোনায় মোড়ানো উপত্যকা আরব আমিরাতের নানা শহর আর পর্যটনকেন্দ্রের নিখুঁত ও প্রাঞ্জল বর্ণনা। রিপোর্টারের সাবলীল হাতে এমন উপাদেয় ও সাহিত্যব্যঞ্জনা সমৃদ্ধ গদ্য কদাচিৎই সৃষ্টি হতে পারে। দেশে দেশে ভ্রমণ শেষেতেমনই এক দুর্লভ গ্রন্থ হয়ে উঠেছে সব বিবেচনায়।

লেখক শুরু করেছেন ভ্রমণের একেবারেই প্রারম্ভিক অবস্থা থেকে। অর্থাৎ ভ্রমনপ্রস্তুতির সূচনা, কী উপলক্ষে ভ্রমণ, ভিসা পাওয়া, এয়ারপোর্টের ভোগান্তি, এমনকি বিমানে উড্ডয়নকালীন সময়কার বর্ণনাও উঠে এসেছে দারুন সৃজন দক্ষতায়। এরপর কাঙ্ক্ষিত দেশ বা শহরে অবতরণ, হোটেলে অবস্থান, খাওয়াদাওয়া, ঘুরতে বা কেনাকাটা করতে যাওয়া থেকে ফেরার প্রস্তুতিসব মিলিয়ে যেন ষোলকলায় পূর্ণ একটি ভ্রমণসম্ভার।

নিকটতম বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে নোনা হাওয়ার দেশ শ্রীলংকা কিংবা মালদ্বীপ। মমির দেশ মিশর থেকে প্রাচুর্য্যের আরব আমিরাত। সর্বত্রই নিজের বিস্ময়ের সঙ্গী করেছেন পাঠককে। পাঠক একটি পর্যায়ে ভুলতে বাধ্য হন যে, তিনি বই পড়ছেন। একজন লেখকের জন্য এটি একটি তৃপ্তির জায়গা। লেখক হাসান আকবর যেখানে প্রশ্নাতীত সাফল্য দেখিয়েছেন। কিন্তু সর্বত্রই যেন লেখকের ছায়াসঙ্গী ছিল প্রিয় বাংলাদেশ। নানা ভালো অভিজ্ঞতা লাভের সময় লেখক কে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখা গেছে প্রায়শই। ইশ! আমার দেশটি যদি এমন হতো!

গ্রন্থে বর্ণিত পাঁচটি দেশের ভ্রমণই আয়োজিত হয় লায়ন্স ক্লাবস ইন্টারন্যাশনালের ইসামি ফোরামের বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে। তবে সম্মেলনে যোগদানের পাশাপাশি ভেন্যু সংশ্লিষ্ট দেশের সাথে অন্য এক দুটি দেশ নিয়ে ট্যুর প্ল্যান করায় ভ্রমণটি আর সম্মেলনে অংশগ্রহণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। অংশগ্রহণকারীদের জন্য তা যেমনিভাবে আনন্দদায়ক হয়েছিল, পাঠকেরও ভারী হয়েছে লাভের পাল্লা।

ভারতের দক্ষিণ অঞ্চলের প্রদেশ তামিলনাড়ুর রাজধানী শহর চেন্নাই। আগে যেটি মাদ্রাজ নামে পরিচিত ছিলো। আজকাল অনেক বাংলাদেশি সেখানে যান চিকিৎসা সেবা নিতে। লেখক আগেও গিয়েছিলেন সেখানে চিকিৎসার জন্যই। তার অভিজ্ঞতা মিশ্র। সাথে দেশে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে না ওঠার হাহাকার। চেন্নাইয়ের মেরিনা বিচ, পোর্ট মিউজিয়াম, জেলেপাড়া ও শপিংমল; সিমলার পাহাড়ি পথ, মন ভোলনো কুফরি শহর, চেইলের পাহাড়চূড়া ও শীত উপভোগ; চণ্ডিগড়ের রোজ গার্টেন, রক গার্ডেন ও সুখনা লেক; দিল্লির নিজাম উদ্দিন আউলিয়া (রহ.) এর দরগাহ জেয়ারত, কুতুব মিনার, লাল কেল্লা, হুমায়ুন টম্ব, আগ্রা ফোর্ট, আকবরের রাজধানী ফতেহপুর সিক্রি আর চির বিস্ময়ের তাজমহল; কলকাতার হকার মার্কেট, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হয়ে গড়ের মাঠ, কবিগুরুর শান্তিনিকেতন হয়ে ফেরার পথে সুস্বাদু ল্যানচার স্বাদ নেয়া; সব মিলিয়ে এ যেন এক মহাভারতে দুর্দান্ত ভ্রমণ। বর্ণিত শহরগুলোর সৌন্দর্য বর্ণনার পাশাপাশি সেখানকার খাবারদাবার, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ইত্যাদি লেখায় উঠে এসেছে সাবলীলভাবে।

এরপর শ্রীলঙ্কা পর্ব। ভারতের উপকূল থেকে মাত্র ৩১ কিলোমিটার দূরের দ্বীপদেশ শ্রীলংকার কলম্বো, ক্যান্ডি প্রভৃতি শহরে সম্মেলনে অংশগ্রহণ ও ঘুরাঘুরিতে শেষ হয় এ পর্ব। সাথে উঠে আসে স্থানীয় ইতিহাসঐতিহ্য, ধর্ম, সংস্কৃতি এমনকি রাজনীতি ও অর্থনীতির চিত্র। রাস্তার ট্রাফিক সিস্টেম দেখে বরাবরের মতোই ফুটে ওঠে দেশের জন্য আক্ষেপ।

তারপর আসে শ্রীলংকা থেকে আরো দূরের, ভারত মহাসাগরের আরো গভীরের ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের বর্ণনা। বিমানবন্দরে অবতরণ থেকে শুরু করে সাবমেরিনে সাগরের তলদেশ ভ্রমণ ও সাগরতলের প্রাণী আর জীববৈচিত্র অবলোকন। সব মিলিয়ে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। ইয়টে চড়া বেশ মজার হলেও মালদ্বীপের পকেট কাটা পর্যটন বিরক্তিও জমিয়েছিল মনে। তবে সকল ক্লান্তি ও বিতৃষ্ণা যেন মুহূর্তেই মুছে দেয় ভারত মহাসাগরের নয়নাভিরাম নীলাভ জল। এত গাঢ় নীল জল যে আর কোথাও দেখেননি লেখক!

খ্রীষ্টের জন্মেরও তিন হাজার বছর পূর্বের সভ্যতার যে নিদর্শন এখনো টিকে আছে তা কী? চোখ বুঝেই যে কেউ উত্তর দিবে মিশরের পিরামিড। পাঠ্য বইয়ের পড়া সেই পিরামিডের দেশ মিশরের ভ্রমণ অভিজ্ঞতাও উঠে এসেছে চতুর্থ অধ্যায়ে। হোটেল থেকে শুরু করে খুফুর পিরামিড, নীল নদের স্বচ্ছ জলরাশি থেকে শুরু করে ফেরাউন ও মুসা আঃ পর্যন্ত ইতিহাসের নির্বাচিত অংশ। উঠে এসেছে পচনের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া মমি, গ্রেট স্ফিংস, সাহারা মরুভূমি, প্যাপিরাসের বাজার, নীল নদের ক্রুজ। আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর, লাইব্রেরি ইত্যাদি জীবনের পরমপ্রাপ্তি হিসেবে গণ্য হয়েছে নিঃসন্দেহে।

গ্রন্থের পঞ্চম অধ্যায় আজকের দুনিয়ার বিস্ময় সংযুক্ত আরব আমিরাত। মরুর বুকে দাঁড়িয়ে থাকা আধুনিক প্রযুক্তির দৈত্যাকার স্থাপনা বুর্জ আল খালিফা, ডেজার্ট সাফারি, মিরাকল গার্ডেন, গ্র্যান্ড মসজিদ, জেইস মাউন্টেইন, চারদিকে ছড়িয়ে থাকা বিস্তৃত সমুদ্র সৈকত, এত সব বিষয়ের মধ্যেও আমিরাতের অন্যরকম ভালোলাগা হচ্ছে এখানে সেখানে বাঙালিদের দেখা পাওয়া। দুবাইয়ের স্বর্ণ মার্কেট বিশ্বে শ্রেষ্ঠ। এ মার্কেটে ঘুরে আসার মধ্য দিয়ে শেষ হয় গ্রন্থের দেশে দেশে ভ্রমণ।

ভ্রমণসঙ্গীদের নানা বিষয় আশয়ও উঠে এসেছে লেখায়যা বাড়িয়েছে বৈচিত্র। বিমানের ক্রু থেকে জিপের ড্রাইভার, সাবমেরিনের ক্যাপ্টেন থেকে হোটেলের ওয়েটার, টুরিস্ট গাইড থেকে বিচের দোকানদারকত বিচিত্র অভিজ্ঞতা। বিশেষকরে দৈনিক আজাদী সম্পাদক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক এম এ মালেক, লায়ন কামরুন মালেক, লায়ন শাহ আলম বাবুল, লায়ন মনজুর আলম মনজু, লায়ন আনোয়ারুল আজিম, লায়ন জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী, লায়ন নিশাত ইমরান, লায়ন রেহেনা চৌধুরী লেখকের স্ত্রী অধ্যাপিকা শামীমা নার্গিসসহ অনেকেই ছিলেন এ ভ্রমণের নানা পর্বে, নানা আয়োজনে, নানা দৃশ্যে।

শারজাদুবাইআমিরাতের পাঠ চুকিয়ে আবার চিরচেনা চট্টগ্রামের পথে। এরমধ্যে কত কিছু দেখা হল, শেখা হল, ভারি হল অভিজ্ঞতার ঝুলি। সে অভিজ্ঞতার ভাগ পেয়ে পাঠকও তুলতে পারে তৃপ্তির ঢেকুর। আরেকটি প্রশ্ন জাগতেই পারে মনে, সাতশ বছর পূর্বে যখন ছিল না এখনকার মতো আধুনিক সব সুযোগ সুবিধা, কিভাবে দেশের পর দেশ ভ্রমণ করেছিলেন ইবনে বতুতা। চট্টগ্রামেও তো এসেছিলেন তিনি। ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ যখন বাংলার শাসক।

ভ্রমণগদ্যের এই গ্রন্থের ছাপার মান ভালো। এড়িয়ে যাওয়া কঠিনএমন এক আধটা মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়লেও অন্যান্য সব দিকে উৎরে গেছেন প্রকাশক। প্রচ্ছদের ছবিগুলো আরো জীবন্ত হতে পারত। আর কলেবর বেড়ে যাওয়ার ভয়েই হয়তো প্রতিটি অধ্যায়ের সাথে দুচারটি সংশ্লিষ্ট স্থানের ছবি সংযোজনের কথা ভাবা যায়নি। পাঠক অবশ্য আজকাল ভ্রমণ বিষয়ক লেখার সাথে এক দুটি ছবি দেখতেই অভ্যস্ত।

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমিলি উৎসবে আনন্দ আয়োজনে
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা