দেশের বিভিন্ন খাতে নিগূঢ় পরিবর্তনের তাগিদ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, আমাদের একেবারে নতুন বাংলাদেশ গড়তে হবে। প্রলেপ দেওয়া পরিবর্তন না, একদম গভীর থেকে পরিবর্তন করতে হবে। নইলে এক স্বৈরাচার গিয়ে আরেক স্বৈরাচার আসবে।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। ‘জুলাই স্মরণ অনুষ্ঠান : জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধান প্রতিবেদনে সুপারিশ বাস্তবায়ন’ শীর্ষক এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে জাতিসংঘের ঢাকা কার্যালয়। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ড. ইউনূস বলেন, প্রতিবার জুলাইয়ের এই ছবি–ভিডিও দেখি, এখন জুলাই মাসের কারণে বেশি দেখছি। যখনই দেখি, নিথর হয়ে যাই। জুলাই শহীদদের বাবা–মায়ের সঙ্গে যখন দেখা হয়, তখন ভাবি, তারা কি আমাদের মতো ছবি দেখার অপেক্ষা করেন? তারা তো সারাক্ষণই নিথর হয়ে আছেন। কী ছিল, কী থেকে কী হয়ে গেল? কান্ট্রি অব হররে পরিণত হয়েছিল। মানুষ কীভাবে এমন নির্মম হতে পারে, মাথায় আসে না। খবর বাংলানিউজ ও বাসসের।
পতিত ফ্যাসিবাদের সময়ে গোপন বন্দিশালায় নির্যাতনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘আয়নাঘর’ যদি সবাইকে দেখাতে পারতাম তাহলে জাতি বুঝতে পারত যে এই ১৬ বছর কী হয়েছে। মানুষদের নির্মমভাবে অত্যাচার করেছে। ইলেকট্রিক চেয়ার রেখেছে। সেগুলোতে সবাইকে দেখানোর সুযোগ হয়নি। সেই সবকিছু মিলে আজকের বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, আমাদের সার্বিক প্রচেষ্টা, যে বাংলাদেশ আমরা গড়তে চাই, মুখের একতা না, বললাম আর ভুলে গেলাম, তেমন না, একেবারে নতুন বাংলাদেশ গড়তে হবে। প্রলেপ দেওয়া পরির্বতন না, একদম গভীর থেকে পরিবর্তন করতে হবে। নইলে এক স্বৈরাচার গিয়ে আরেক স্বৈরাচার আসবে। যতই আইন করি না কেন, আসবেই। আমাদের জাতির ভেতরে এমন কিছু রয়ে গেছে যে, আমরা যতকিছুই করি, আগের বীজ রয়ে গেছে। এটা কয়েকটা কাগজের সংস্কার না, মনের গভীরের সংস্কার।
ড. ইউনূস বলেন, জুলাই আমাদের পুনর্জন্মের মাস, শুধু স্বৈরাচার বিদায়ের মাস না। আমাদের কাছে এখনো সুযোগ আছে। জুলাইয়ের শিক্ষা এখনো তাজা আছে। আবার আগের পথ বন্ধ করে দেওয়া, আগের পথে আর কখনো যাব না, সেটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা।
মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিচার নিশ্চিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সংস্কারের পাশাপাশি জুলাইয়ে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ীদের আইনের আওতায় আনতে আমরা বদ্ধপরিকর। তিনি বলেন, ন্যায়বিচার মানে কেবল শাস্তি নয়, ন্যায়বিচার মানে এমন একটি রাষ্ট্র গঠন, যেখানে রাষ্ট্রক্ষমতা আর কখনো জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে না।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জাতির ত্যাগ, সাহস এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আন্তরিক সহায়তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আজ আমরা একত্র হয়েছি একটি গভীর তাৎপর্যময় ঘটনার, জুলাই বিপ্লবের প্রথম বার্ষিকী স্মরণে। এটি ছিল এমন এক মুহূর্ত, যখন হাজার হাজার বাংলাদেশি নারী ও পুরুষ, যাদের অধিকাংশই তরুণ, অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং দেশের মর্যাদা ও ভবিষ্যৎ পুনরুদ্ধার করেছিল। তাদের সাহস শুধু আমাদের জাতির জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির পক্ষেই উচ্চারিত হয়েছিল।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, এই ঐতিহাসিক দিনে আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষত জাতিসংঘের অবিচল সমর্থনের কথাও স্মরণ করতে চাই, যারা সবসময় বাংলাদেশের পাশে থেকেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে রোহিঙ্গা সংকট এবং গত বছরের জুলাই ও আগস্টের অন্ধকার দিনগুলোতেও।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গত বছরের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের দপ্তরকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। ফেব্রুয়ারি ২০২৫–এ প্রকাশিত জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ওই কয়েক সপ্তাহে প্রায় ১,৪০০ মানুষ প্রাণ হারায়। এই সহিংসতা ছিল পরিকল্পিত, সংগঠিত এবং পূর্ববর্তী সরকারের সর্বোচ্চ স্তর থেকে পরিচালিত। এই সহিংসতা শুধু নিন্দনীয় নয়, বরং তা মানবতা বিরোধী অপরাধ সম্পর্কেও গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করে। তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য সত্য উন্মোচন শুধু ন্যায়বিচারের জন্য নয়, নিজেদের শোধরানোর জন্যও অপরিহার্য।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এই অনুসন্ধানকে আরো সমর্থন করেছে আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা, যার মধ্যে বিবিসি এবং আল জাজিরার রিপোর্টও রয়েছে। জাতিসংঘের হাইকমিশনারের দপ্তরের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ, তারা শুধু এই নিপীড়নের প্রামাণ্য নথি প্রস্তুত করেনি, বরং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যেন আর কখনো না ঘটে, তার জন্য একটি বিস্তৃত সুপারিশমালাও প্রদান করেছে।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার মানবাধিকার সুরক্ষায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন দণ্ডবিধির সংশোধন, গুমের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা বিষয়ে আন্তর্জাতিক কনভেনশনে যোগদান এবং জাতিসংঘের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর। এই চুক্তির আওতায় ঢাকায় একটি সহায়তাকারী মিশন গঠিত হচ্ছে, যা সরকার ও সুশীল সমাজকে কারিগরি সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দেবে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এবং মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার টার্কসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শুরু থেকেই জাতিসংঘ আমাদের রূপান্তর প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তিনি বলেন, আমরা এমন একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য কাজ করছি, যার লক্ষ্য অন্তর্ভুক্তিমূলক, অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা। এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই, যেখানে সবাই শান্তি, স্বাধীনতা ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারবে।