দেশের সম্পদ বিক্রি করার বাপের মেয়ে আমি নই : শেখ হাসিনা

| শনিবার , ২৪ জুন, ২০২৩ at ৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ

ক্ষমতার লোভে বাংলাদেশের সম্পদ বিক্রি করে ক্ষমতায় থাকার মতো ‘বাপের মেয়ে নন’ বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক আলোচনায় তিনি এ কথা।

বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে আওয়ামী লীগের ৭৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি উদ্বোধন করেন তিনি। সকালে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি উদ্বোধন করেন তিনি। খবর বিডিনিউজের।

পাকিস্তান আমলে ১৯৪৯ সালের এই দিনে জন্ম হয় আওয়ামী মুসলিম লীগের। ১৯৫৫ সালে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আদর্শের অধিকতর প্রতিফলন ঘটানোর জন্য পরে নাম হয় আওয়ামী লীগ। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোওরাওয়ার্দীসহ যারা বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের স্মরণ করেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, পলাশীর প্রান্তরে যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, আওয়ামী লীগ সেই সূর্য উদিত করেছে। আওয়ামী লীগ এ দেশের মানুষকে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার অর্জন করে দিয়েছে, স্বাধীন দেশ দিয়েছে। দীর্ঘ বক্তব্যে পাকিস্তান আমলে ও স্বাধীন দেশে আওয়ামী লীগের অবদান, উন্নয়নে ভূমিকা ও অন্যদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের তুলনা তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু কন্যা।

১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ। এর ৫ বছর পর ফের বিরোধী দলে বসার পেছনে জনগণের সমর্থনের অভাব নয়, ‘অন্য কারণ’ ছিল বলে দাবি করেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ২০০১ সালে সরকারে আসতে পারিনি। আমার ওপর প্রচণ্ড চাপ ছিল, আমাদের গ্যাস বিক্রি করতে হবে। আমি বলেছিলাম, এই গ্যাস জনগণের, আর কতটুকু গ্যাস আছে জানি না। কাজেই আমার পক্ষে বাংলাদেশের মানুষের সম্পদ শুধু ক্ষমতার লোভে বিক্রি করে ক্ষমতায় থাকব, সেই বাপের মেয়ে আমি না। আমরা চাইনি। কিন্তু মুচলেকা দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া।

স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ ছাড়া যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা জনগণের কথা চিন্তা করেনি, নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে বলেও মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

হাড্ডিসার বাংলাদেশ পেয়েছিলাম : ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, ২১ বছর পর যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তখন বাংলাদেশের কী চিত্র দেখেছি? হাড্ডিসার কঙ্কালসার দেহ, পেটে ক্ষুধার জ্বালা, পরনে ছিন্ন কাপড়, বিদেশ থেকে কাপড় এনে তাদের বিলি করা হত। একবেলা খাবার জোটাতে পারে না, থাকার মতো কুঁড়েঘরটা পর্যন্ত নেই, রোগে কোনো চিকিৎসা নেই। সেই বাংলাদেশ তো আমার বাবা চাননি। তিনি চেয়েছিলেন এ দেশের প্রতিটি মানুষ অন্তত দুবেলা পেট পুরে খাবে, রোগে চিকিৎসা পাবে, শিক্ষা পাবে। আর সেই পদক্ষেপ কিন্তু তিনি নিয়েছিলেন। কিন্তু ২১ বছর যারা একের পর এক ক্ষমতা দখল করে তারা কিন্তু মানুষের দিকে তাকায়নি। নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এদেশের মানুষ প্রথম উপলব্ধি করেছে সরকার জনগণের সেবক। কারণ, আমি আমার বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে জনগণের সেবক হিসেবেই ঘোষণা দিয়েছিলাম, প্রধানমন্ত্রী না।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ছয় বছর পর ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পরিস্থিতিও বর্ণনা করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, যখন আমি এয়ারপোর্টে নেমে আসি, হাজার হাজার মানুষ। একটা প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জন করে যে সম্মান পেয়েছিল, বাঙালি সেই সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া; শোষিত বঞ্চিত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে তাদের উন্নত জীবন দেওয়া, যা আমার বাবা দেখেছিলেন, যে জন্য বারবার কারাবরণ করেছেন, তার সেই স্বপ্ন পূরণ করতেই হবে। সেই প্রত্যয় নিয়ে ফিরে এসেছিলাম। বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করেছিলাম। ১৬০০ মেগাওয়াট থেকে থেকে ৪ হাজার ৩০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করেছিলাম। সাক্ষরতার হার ৪৫ থেকে ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করেছি। চিকিৎসা সেবার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক করেছি। প্রতিটি পরিবার যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, এজন্য একটি বাড়ি একটি খাবার প্রকল্প নিয়ে তাদের সহযোগিতা করেছি। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাসহ সামাজিক নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। ভূমিহীন মানুষদের জন্য যেমন আমার বাবা ঘর করার প্রকল্প নিয়েছিলেন, আমরা সেইভাবে মানুষকে ঘর করে দিয়েছি।

বিএনপি আমলের সঙ্গে তুলনা : বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে তুলনামুলক চিত্র তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি জানান, ২০০৬ সালে বিএনপির শেষ বছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ। মহামারীর সময়ও সেটা ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ আনতে পেরেছে সরকার।

বিএনপির তুলনায় মাথাপিছু আয় ও রপ্তানি পাঁচ গুণ বাড়ানো, রেমিট্যান্স ৬ গুণ করা, আমদানি ৭ গুণ বাড়ানো, জিডিপির আকার সাড়ে ১২ গুণ করা, বাজেট ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ১৩ গুণ করা, দারিদ্র্যের হার ৪২ শতাংশ থেকে ১৮ শতাংশে নামিয়ে আনাসহ নানা সাফল্য তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে দুই আমলের কথাও উঠে আসে তার বক্তব্যে। তিনি জানান, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৬০০ মেগাওয়াট থেকে ৪ হাজার ৩০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করেছিল। সেটা বিএনপি কমিয়ে নিয়ে এসেছিল ৩ হাজার ৭৮ মেগাওয়াটে। ‘সবসময় মানুষ বাড়ায় আর বিএনপি কমায়’, এই টিপ্পনি কেটে বলেন, সেখান থেকে এখন ২৫ হাজার ২২৭ মেগাওয়াটে উন্নীত করেছি।

তিনি জানান, বিএনপির আমলে বিদ্যুৎ সুবিধা পেত মোট জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ। সেটি বাড়িয়ে আওয়ামী লীগ সরকার শতভাগ করেছে, ঘরে ঘরে আলো দিতে সক্ষম হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, প্রযুক্তি, ইন্টারনেট ব্যবহার, কোনো দিক দিয়েও আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির ‘তুলনা হয় না’ বলেও মনে করেন শেখ হাসিনা।

নিত্যপণ্যের দাম গত এক বছরে অনেকটাই বেড়ে যাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে দায়ী করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ২০০১ সালে যখন ক্ষমতা হস্তান্তর করি, তখন মূল্যস্ফীতি ১ দশমিক ৫ শতাংশে রেখে এসেছিলাম। বিএনপি ক্ষমতায় এসে তা ১০ শতাংশে বৃদ্ধি করে। আমরা আবার ক্ষমতায় এসে সেটা ২০২১ সাল পর্যন্ত ৫ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যের বিষয়, রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী মন্দার কারণে আবার সেই মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা কমিয়ে আনার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছি।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে তিনি বলেন, বিএনপি আমলে রিজার্ভ এক বিলিয়ন ডলারও ছিল না। আওয়ামী লীগ তা ৪৮ বিলিয়নে তুলেছিল। এখন তা ৩০ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন। তিন মাসের খাবার কেনার ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ যথেষ্ট জানিয়ে তিনি বলেন, এখন যে রিজার্ভ আছে, তা দিয়ে পাঁচ মাসই খাবার কিনতে পারব।

তারা নিজেদের ভাগ্য গড়েছে, জনগণের নয়’ : স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ ছাড়া যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা ‘জনগণের কথা চিন্তা করেনি’ বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, জনগণ নয়, তারা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে। তিনি বলেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর থেকে কী ঘটেছে বাংলাদেশে? একের পর এক ক্যু, সেনাবাহিনীর মুক্তিযুদ্ধের অফিসারসহ হাজার হাজার অফিসারসৈনিকদের হত্যা, বিমান বাহিনীর অফিসারসৈনিকদের হত্যা করেছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী যারা খুনিদের সঙ্গে হাত মেলায়নি, তাদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে বন্দি, নেতাকর্মীদের দিনের পর দিন অত্যাচার করেছে, খুন করেছে, লাশ গুম করেছে। সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনীর অফিসার, সৈনিক তাদের হত্যা করে গুম করা হয়েছে। হত্যাখুনগুমসন্ত্রাস এই রাজত্বই হয়েছিল আর প্রতি রাতে কারফিউ ছিল। মানুষের কোনো অধিকারই ছিল না। ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে সেখানে অবৈধ ক্ষমতা বৈধ করার জন্য দুইতৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার জন্য, এই যে নির্বাচনের কারচুপির যে সংস্কৃতি সেটাইও কিন্তু ৭৫ এর পর থেকে শুরু।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচৌধুরী হাটে হাসিল আদায়ের ঘোষণায় উত্তেজনা
পরবর্তী নিবন্ধহজের আনুষ্ঠানিকতা কাল থেকে শুরু