বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, বিগত সরকারের রাজনীতিবিদ, আমলা, বিচারক, বিভিন্ন বাহিনী একটি দুর্নীতির জোট তৈরি করেছিল। রাষ্ট্রপতি যে পরিমাণ হত্যা মামলার আসামির দন্ড মওকুফ করেছিলেন ইতিহাসে তার নজির নেই বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, একটি বাড়ি একটি খামার, ঘরে ঘরে চাকরি, ১০ টাকায় চাল আরও অনেক কিছু শুনেছি। আমরা প্রজা ছিলাম। আমরা প্রজাস্বত্ব মেনে নিয়েছিলাম এই জন্য আমাদের একটা কমফোর্টেবল লিভিং হবে। যখন মোহভঙ্গ হয়েছে আমরা দেখলাম কীভাবে ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজড ক্রিমিলাইজেশন হয়েছে আমাদের দেশে। এ জোটে (নেক্সাস) বিজনেস কমিউনিটি, আমলা, বিচারক, পুলিশ কেউ বাদ ছিল না।
গতকাল বুধবার সকালে নগরীর একটি হোটেলে আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন। ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএমএবি) চট্টগ্রাম শাখা ‘বাংলাদেশের বিকশিত অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে অভিগমন’ শীর্ষক এই আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, জুলাই–আগস্টে নিহত শহীদদের মর্যাদা দিতে দেশের সব শিল্পখাতে, সেক্টর ধরে সংস্কার করা হবে। তিনি বলেন, বিগত সরকারের সময় দেশে অপরিকল্পিত বিনিয়োগ হয়েছে। এ জন্য শিল্প খাতকে বাঁচাতে কৃষিতে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। ৭০ থেকে ৮০ টাকায় সার কিনে ১৫ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। এভাবে ক্রনি ক্যাপিটালিজম বা স্বজনতোষী পুঁজিবাদে জেঁকে বসেছিল। অর্থনীতিতে কোনো বৈচিত্র্য আসেনি। অনুষ্ঠানে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন দেশের বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘২০০৭ সালে মাসদার হোসেন মামলার মাধ্যমে আমাদের বিচার বিভাগ স্বাধীন হলো। এ স্বাধীনতা আমাদের কতটুকু উপকার করেছে, এটা ভেবে দেখা দরকার। এটি হয়েছে নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, শ্বেতপত্রে এসেছে ২৮ লাখ কোটি টাকা এ দেশ থেকে চুরি হয়েছে। এ জন্য কি ১০০ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও ৩০০ প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) দায়ী নন বলে প্রশ্ন তুলে তিনি এ প্রশ্ন তোলার এখনই সময় বলে মন্তব্য করেন।
নৈতিকভাবে সবাইকে উঁচু স্থানে উঠতে হবে মন্তব্য করে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘এ দেশটা আমাদের সন্তানদের জন্য গড়তে হবে। কিন্তু দেশের মধ্যে একটা সময় নানা কিছু ঘটল। ওই যে বয়ানটা ছিল, সেটা আমরা বিশ্বাস করেছিলাম। আমরা অনেকেই নিশ্চুপ ছিলাম। কিন্তু কিছু বাচ্চা ছেলে প্রতিবাদ করল। পরে জনতাও যোগ দিলেন। পরিবর্তন এল। এখন আমরা যদি আবার গতানুগতিকভাবে একই জিনিসের চর্চা করি, দক্ষতার মূল্যায়ন না করি, তবে এটি গ্রহণযোগ্য হবে না।’
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন বলেন, ‘এই যে গত ৫ আগস্টের আন্দোলন হলো, প্রায় দুই হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছেন, ৫০ হাজার মানুষ অসুস্থ হয়ে কাতরাচ্ছেন। তবু আমরা আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছি। এখনো অনেক লোক আসছেন ফটোসেশন করতে। তাঁরা কেন ছবি তুলছেন, আমি বুঝি না। তাঁরা হয়তো বোঝানোর চেষ্টা করছেন, আমার সঙ্গে উপদেষ্টার সম্পর্ক আছে। আমি মনে করি, এটার কোনো মূল্য নেই।
বিগত সরকারের আমলের অর্থনীতির চিত্র তুলে ধরতে একটি কৌতুক বলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। তিনি বলেন, এক ভদ্রলোক হাটে গরু বিক্রি করতে গেছেন। উনি গরুর ভালো দাম পাননি। উনি গরুটা ফেরত নিয়ে আসছিলেন। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেছে। পথিমধ্যে ডাকাত ধরেছে। ডাকাত বললো, টাকা দাও। উনি বললেন, আমার কাছে টাকা নাই, গরুর দাম পাইনি তাই বেচতে পারিনি। ডাকাত উনাকে বেদম প্রহার করে বললো, লাভ হইতো লস হইতো আমার হইতো, তুমি বিক্রি করোনি কেন! অনুষ্ঠানে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, আমাদের শিল্প খাত উচ্চ শুল্ক করের দ্বারা পরিচালিত। শিল্প খাতের লোকজন ট্যাক্স পরিশোধ করেন না কিন্তু ভ্যাট দেন। আমাদের মতো দরিদ্র অর্থনীতির দেশে ভ্যাট ও ট্যাক্সের মধ্যে একটা সংযোগ দরকার।
অনুষ্ঠানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) সচিব মোহাম্মদ আবদুর রহমান খান, বিএসআরএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আলী হোসেন আকবর আলী এবং আইসিএমএবির প্রেসিডেন্ট এবং বিল্ডকন কনসালটেন্সি লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহতাব উদ্দিন আহমেদ বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। সেমিনার ও সম্মেলন কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শহিদ স্বাগত বক্তব্য এবং সিবিসি চেয়ারম্যান প্রদীপ পাল ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বক্তব্য রাখেন। মোহাম্মদ আবদুর রহমান খান ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ল্যান্ডস্কেপের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে এবং অর্থনৈতিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করতে, জাতীয় কোষাগারকে সুনির্দিষ্ট জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা এবং সততার সাথে প্রসারিত করার উপর জোর দেন।
আলী হুসেন আকবর আলী “বৈচিত্র্যকরণ, ব্যবসায় স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা এবং পরিবেশগত বিষয়গুলির বিবেচনার পাশাপাশি গ্রাহকের সন্তুষ্টি নিঃসন্দেহে আমাদের অর্থনৈতিক ল্যান্ডস্কেপকে উন্নত করবে” বলে মন্তব্য করেছেন। মাহতাব উদ্দিন আহমেদ “এই ক্রান্তিকালীন সময়ে, আমাদের দক্ষ এবং প্রতিশ্রুতিশীল পেশাদাররা টেকসই প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের পথে অর্থনীতিকে সমর্থন করার সুযোগটি সাগ্রহে গ্রহণ করবে বলে বিশ্বাস করেন”। পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সিইও ড. এম. মাসরুর রিয়াজ ‘টেকসই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার: মুদ্রাস্ফীতি, ঋণ ও রাজস্ব নীতি ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করেন। সেশনটি পরিচালনা করেন আইসিএমএবি সাবেক প্রেসিডেন্ট, ইনডেক্স গ্রুপ অব কোম্পানিজের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ। লিভারনগিয়ার লিমিটেডের পরিচালক এবং আইসিএমএবির কাউন্সিল সদস্য মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম এবং আলম এম জামান অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের সিনিয়র পার্টনার ইমতিয়াজ আলম বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোচনা করেন।
অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং সিআইইউ বিজনেস স্কুলের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের প্রধান ড. ইমন কল্যাণ চৌধুরী ‘বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার জন্য স্থানীয় শিল্পকে শক্তিশালী করা: কৌশলগত ব্যয় ব্যবস্থাপনার ভূমিকা’ শীর্ষক আরেকটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন। সোনালী ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী সেশনটি পরিচালনা করেন, আইসিএমএবির ভাইস–প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ কাউসার আলম, এডিসন লজিস্টিকস বিজনেস এর সিইও এবং আইসিএমএবির কাউন্সিল সদস্য মোহাম্মদ মাকসুদুর রহমান এবং লংকাবাংলা ফাইন্যান্স লিমিটেডের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং হেড অব অপারেশন্স এ কে এম কামরুজ্জামান সেশনে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
সম্মেলনে আইসিএমএবির বিপুল সংখ্যক ফেলো ও এসোসিয়েট সদস্য, শিক্ষাবিদ, সরকারি, আধা–সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।