শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ড. জিয়াউদ্দীন বলেছেন, সামাজিক চাপে বা পরিবারের চাপে তোমাদের লক্ষ্য পরিবর্তন হওয়ার সুযোগ নেই। তোমরা নিজেরা যে লক্ষ্য ঠিক করেছো সেটাই আসল লক্ষ্য। দেশের জনগণের জন্য দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নিজের ভেতরে ভেতরে যে চিন্তা করছো সেটাই চূড়ান্ত লক্ষ্য। এ চিন্তা নিয়ে যারা পড়াশোনা করছো নিজেকে গড়ে তুলছো তারাই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের কারিগর। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রাম কলেজিয়ট স্কুল আয়োজিত কৃতী ছাত্র সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন বলেন, আজকে এখানে আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক অনেক অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য দিয়েছেন। কারণ আগামীর বাংলাদেশ যাদের হাত ধরে গড়ে উঠবে তারা আজকে এখানে উপস্থিত–তাই তিনি হয়ত সুযোগটা হাতছাড়া করেননি। আমরা যদি কোনো শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করি তার জীবনের লক্ষ্য কী? তাহলে নিশ্চয় উত্তরে কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার কেউ কেউ ব্যাংকার বা প্রযুক্তিবিদ হওয়ার কথা বলবে। কেউ কি বলবেন আমি অন্য রকম একটি স্বপ্ন দেখি সেটা বাস্তব করার জন্য পড়ছি? আমি তোমাদের বলি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একটি কবিতার লাইন তোমরা সকলের জানো। সেখানে অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিলেন। তোমাদের কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তোমরা কি অকপটে এরকম কিছু বলতে পারবা? পারবা না। এ স্কুলের প্রাঙ্গণে আমাদের দেশের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস হেঁটেছেন। তখনও যদি তাঁকে কেউ জিজ্ঞাসা করতেন আপনি জীবনে কি হতে চান! তিনি হয়ত পরিবারের আকাঙ্ক্ষার চাপে কিংবা পরিবেশের আকাঙ্ক্ষার চাপে একটা কিছু উত্তর দিতেন। কিন্তু আমরা পরে দেখতে পেয়েছি তিনি পৃথিবীর সব দরিদ্র মানুষের দুঃখ দূর করতে চেয়েছিলেন। আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি তিনি আমাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ফলে এখানে যেসব শিক্ষার্থী উপস্থিত হয়েছো সামাজিক চাপে বা পরিবারের চাপে তোমাদের লক্ষ্য পরিবর্তন হওয়ার সুযোগ নেই। তোমরা নিজেরা যে লক্ষ্য ঠিক করেছো সেটাই আসল লক্ষ্য। এছাড়া প্রধান অতিথি কৃতী শিক্ষার্থীদের জন্য দিকনির্দেশনা মূলক বক্তব্য প্রদান করেন এবং স্বনামধন্য এ বিদ্যালয়ের সাফল্য অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান।
স্কুল প্রাঙ্গণে এসএসসি পরীক্ষায় চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে অংশগ্রহণকৃত ছাত্রদের অভূতপূর্ব সাফল্যের জন্য কৃতী ছাত্র সংবর্ধনা–২০২৫ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এতে ৪০৫ জন কৃতী শিক্ষার্থীকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন ঘোষণা করেন দৈনিক আজাদী সম্পাদক, একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব ও চট্টগ্রাম কলেজিয়েটসের সভাপতি এম এ মালেক। সভাপতি ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক মুহাম্মদ তজল্লী আজাদ। স্কুলের শিক্ষক শাহেদ মাহমুদ, আনিস ফারুক ও জেসমিন আরার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজিয়েটসের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম কলেজিয়েটসের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাক হোসাইন, সাবেক প্রধান শিক্ষক রেহানা আক্তার। আরও উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকবৃন্দ।
উদ্বোধকের বক্তব্যে দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, একুশ আমার অহংকার, একুশ মানে মাথা নত না করা। এ শিক্ষাটা আমি আমার বাবার কাছ থেকে পেয়েছি। কারণ ১৯৫২ সালে চট্টগ্রাম থেকে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী লিখেছিলেন ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। সেই কবিতাটা আমার বাবা রাষ্ট্রদোহিতার অপরাধ জেনেও ছেপে দিয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন মাতৃভাষাকে যদি অবহেলিত করা হয় এবং উর্দুকে যদি রাষ্ট্রভাষা করা হয় তাহলে আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না। তিনি বলেন, আমি অনন্তকাল ধরে সমুদ্রের পথে হাঁটবো, জোয়ার এসে আমার পদচিহ্ন মুছে দিবে, হাওয়া আমার পদচিহ্ন মুছে দিবে, তবু এ সাগর থাকবে চিরকাল’ অর্থাৎ আমরা আসবো যাবো সবকিছু বর্তমান থাকবে। আমাদের সবকিছু বর্তমানকে ঘিরেই। অনেকে বলে আজকের শিশু আগামীদিনের ভবিষ্যৎ, আমি সেটা বলি না। আমি বলি এখন অতীতে কি হয়েছে জানি বর্তমান কি হচ্ছে জানি ভবিষ্যতে কি হবে জানি না। তাই বর্তমানকে গুরুত্ব দিতে হবে। বর্তমানের ওপর সবকিছুই নির্ভর করে। বর্তমানকে গুরুত্ব দিয়ে ভবিষ্যত গড়তে হবে।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, নেলসন ম্যান্ডেলা একটি কথা বলেছেন education is the most powerful weapon which you can use to change the world আসলে বলাটা সহজ করাটা কঠিন। এডুকেশন মানে কি, এ পি জে আব্দুল কালাম সে সম্পর্কে বলেছেন, ‘তোমার মধ্যে আগুনের যে ঝলক আছে সেটা জ্বালিয়ে দেওয়ার নামই শিক্ষা।’ তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে পৃথিবীতে তিনজন ব্যক্তি আছে যারা তোমাদের শুধু ভালো চায় তোমাদের থেকে কিছুই চায় না। তারা হলেন, মা, বাবা ও শিক্ষক। এরা তোমাদের থেকে কিছুই চায় না, চায় তোমাদের সফলতা। কোনো কিছু্ই এমনি এমনি হয় না। একটু কষ্ট করলে কিন্তু সব হয়। সত্যজিত রায় বলেছিলেন ‘জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই’–এটা ছিল রুপক কথা। আসলেই জানার শেষ নেই। তিনি বলেন, মানুষের অসাধ্য বলে কিছু নেই। আমরা যখন হিমালয়ে উঠি তখন আমরা আমাদের যত সাধ্য আছে সাধনা আছে সব কাজে লাগাই। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ড. ইউনূস এ স্কুলের বারান্দায় হেঁটেছেন। আমি ছিলাম তার দুই বছরের জুনিয়র। তিনি ১৯৫৫ সালে এ স্কুল থেকে পাস করেছেন। আমি ১৯৫৭ সালে পাস করেছি। ড. ইউনূস হওয়া সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। আজকে আমরা গর্বের সাথে বলছি, যিনি আজকে দেশ পরিচালনা করছেন। তিনি আমাদের এ স্কুলের ছাত্র ছিলেন। দেশের যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল সেখানে তিনি হাল ধরেছেন। এটাই আমারে সবচেয়ে বড় গৌরবের। এ জন্য তোমাদেরও নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। তোমরাই সিদ্ধান্ত নিতে হবে ড. ইউনূস হবে নাকি অন্য কিছু হবে। আজকে যদি ড. ইউনূস ভালো একটা নির্বাচন দিয়ে বের হয়ে যেতে পারেন, হয়ত তিনি ইউনাটেড নেশনের কর্ণধারও হতে পারেন। আমরা সবাই দোয়া করি যেন তিনি সেটা হতে পারেন। আমরা এমন লোক পেয়েছি যে, আমাদের একজন ইউনাইটেড নেশনে গিয়ে বসতে পারেন, এর চেয়ে গৌরবের বিষয় আর কিছুই হতে পারে না। আমরা গর্ব করে বলতে পারবো আমাদের কলেজিয়েট স্কুলের সাবেক ছাত্র ইউনাইটেড নেশনকে পরিচালিত করছে। তিনি হবেন নিশ্চয়। উনি না পারার কিছু নাই। উনার বক্তব্য শোনার জন্য বিদেশে মানুষ অর্থ খরচ করে শুনতে যায়। আমাদের এখানে সবকিছু ফ্রি। উনি যখন বক্তব্য দেন সব লেটেস্ট কথা বলেন লিখিত কিছু ছাড়াই। এটা তো দুস্কর ব্যাপার।
এম এ মালেক বলেন, সাফল্যের আসলে গোপন কোনো সূত্র নেই। সাফল্য আসে প্রস্তুতি, পরিশ্রম, ধৈর্য এবং ব্যর্থতা থেকে শিখার সমন্বয়ে। অনেকে বলে দেশের অবস্থা কি হবে আমি বলি। অথচ আমরা নিজেদের নিয়ে ভাবি না। আমরা যদি আমাদের প্রতিষ্ঠা করতে পারি, আমাদের পরিবারকে প্রতিষ্ঠা করতে পারি, প্রত্যেকটা লোক এভাবে গড়ে উঠলে দেশ এমনেই এগিয়ে যাবে। আমরা নিজেরা পরিবর্তন হলে সবকিছু পরিবর্তন হবেই।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রাম কলেজিয়েটসের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ১৮৩৬ সালে ব্রিটিশ আমলে তৎকালীন বাংলাদেশে ছয়টি স্কুল করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেগুলো ছিল মাধ্যমিক স্কুল। এরমধ্যে চারটি ছিল পূর্ববঙ্গে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীতে স্কুলগুলো প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। এরমধ্যে সর্বপ্রথম ছিল চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল। এটি প্রথমে চন্দপুরায় হয়েছিল, পরে ১৯২৫ সালে এখানে লাল বিল্ডিংয়ে স্থানান্তর করা হয়। তখন এটা মাধ্যমিক স্কুল ছিল। যখন পাকিস্তান স্বাধীন হয় তখন এটাকে পাইলট হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সর্বপ্রথম জুনিয়র ক্যাডেট কোর্পস এটা কলেজিয়েট স্কুলে প্রথম করা হয়। এরপর ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টস নামে একটি সাবজেক্ট এখানে শুরু করা হয়। এখানে ল্যাব ছিল, ওয়ার্কশপ ছিল, লাইব্রেরি ছিল। আমি এখানে ১৯৬২ থেকে ৬৭ সাল পর্যন্ত পড়েছি। পাইলট স্কুল চালু হওয়ার পরে কলেজিয়েট স্কুল কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে ছিল। ওই সময় কলেজিয়েট সব সময় কুমিল্লা বোর্ডে ফাস্ট সেকেন্ডে হতো। এরপর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখানে আরও সমৃদ্ধ হয়। ছাত্র সংখ্যা বাড়ে। বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়। পরে ইন্টারমিডিয়েট শাখা চালু করা হয়। তিনি বলেন, ১৯৮২ সালে আমরা যারা কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র ছিলাম, তারা মিলে একটা সংগঠন করি ‘চট্টগ্রাম কলেজিয়েটস’ নামে। আমরা প্রতি পাঁচ বছর অন্তর একটা পুনর্মিলনী করে থাকি। আমাদের একটা ফান্ড আছে। সেখান থেকে আমরা গরীব, পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের সহায়তা করে থাকি। তোমাদের মধ্যে কারো যদি সহায়তা লাগে, আমাদের বললে এগিয়ে আসবো।
এ সময় ৪৩জন শিক্ষককের পদোন্নতি হওয়ায় সম্মাননা প্রদান করা হয়। অবসরপ্রাপ্ত দুজন শিক্ষককে সম্মাননা প্রদান করা হয়। তারা হলেন, মজিবুল হক ও নুরুল আমিন। স্কুলের অবসররপ্রাপ্ত কর্মচারী আবুল কালামকে সম্মাননা ও উপহার প্রদান করা হয়। বোর্ডে ভালো ফলাফল করার জন্য রাজস্বী দাশ গুপ্ত ও শাফিন ইলহামকে পুরস্কৃত করা হয়। এছাড়া অতিথিদের সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। পরে ৪০৫ জন শিক্ষার্থীতে ক্রেস্ট তুলে অতিথিরা। পুরস্কার বিতরণ শেষে গ্রুপ ভিত্তিক ফটোসেশন অনুষ্ঠিত হয়।