সড়ক দুর্ঘটনা এখানে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় রূপ নিয়েছে। গড়ে প্রায় ১৫ জনের জীবনহানি ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনায়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সেবা-মান ও ভাড়া নির্ধারণের সমতার সূচকে খুবই দুর্বল অবস্থানে দেশের পরিবহন ব্যবস্থা। মানুষের মাথাপিছু আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় পরিবহন ব্যয়। নগর বা আন্তঃ জেলা পরিবহন ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দৃশ্যমান। সড়ক পরিবহনের সঙ্গে রেল বা নৌ পরিবহনের সমন্বয় খুঁজে পাওয়া যায় না এখানে। নগর পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করতে বিআরটিএ এমআরটিএ নৌ পরিবহন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও এগুলোর অবকাঠামো নির্মাণই সম্পন্ন হয়নি। একসময় ঢাকার মতোই সমস্যাজর্জরিত ছিল পার্শ্ববর্তী দেশের কলকাতা। কয়েক বছর আগেও সেখানে আবাসিক এলাকাগুলো ঢাকার মতোই জরাজীর্ণ ছিল। ফুটপাত বেদখল, রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা ট্রাফিক জ্যাম, নোংরা, দুর্গন্ধ এ যেন ঢাকারই প্রতিচ্ছবি। কিন্তু আজ সেই কলকাতা শহরের ফুটপাত দখলমুক্ত। যেখানে ঢাকায় একটিও নগর বাস টার্মিনাল নেই, সেখানে শুধু কলকাতা শহরেই আছে ২৯টি নগর বাস টার্মিনাল। কয়েক দশক ধরে চলছে ট্রাম সার্ভিস। ১৯৮৪ সাল থেকে চলছে আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো। এছাড়া আছে সার্কুলার মেট্রো সার্ভিস। আধুনিক বিশ্বে যেটাকে মনে করা হয় সবচেয়ে কার্যকর গণপরিবহন ব্যবস্থা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ঢাকা শহরে। মেট্রো বা বিআরটির মতো সফল পরীক্ষিত গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু করলেও পুরোপুরি সুফল পাওয়া যাবে না। ভবিষ্যতে ওইসব গণপরিবহন ব্যবস্থা করতে হবে, এমন কোনো ভাবনা আমাদের শহর পরিকল্পনায় ছিল না। তাই পরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। মাঝে অন্যান্য দেশের মতো ফ্র্যাঞ্চাইজসের মাধ্যমে রাজধানীর পরিবহন চলাচলে উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও আজ পর্যন্ত সেটি আলোর মুখ দেখেনি। ভাড়া আদায়ে নৈরাজ্য চলে। উৎসবের সময় এলে এটি আরো বেড়ে ওঠে। তদারকি প্রতিষ্ঠান থাকলেও তাদের ভূমিকা এক্ষেত্রে দৃশ্যমান হয় না। অধিকাংশ বাস ও রেলে সেবার মান খুবই নিম্ন। বসার স্থান ভাঙাচোরা আর নোংরা, জীবাণুমুক্তকরণের কোনো উদ্যোগও চোখে পড়ে না। পরিবহনগুলো রক্ষণাবেক্ষণে কোনো বিধি বিধানের বালাই নেই। বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থাকে তাই উন্নত করতে হলে একে নিরাপদ, জনগণের সামর্থ্যের মধ্যে ভাড়া নির্ধারণ শূন্য দুর্ঘটনা, ফুটপাত উন্নত করা, পরিচ্ছন্ন ও মানসম্পন্ন পরিবহন সেবা, আরামদায়ক, টেকসই সবার প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ব্যয়ও সময়সাশ্রয়ী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। কার্যকর পরিবহন ব্যবস্থা অবকাঠামো ও পরিচালনা দক্ষতার ওপর নির্ভর করে। তাই সমন্বিত কার্যকর পরিবহন ব্যবস্থার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়নও তার যথাযথ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির সঙ্গে মানসম্পন্ন পরিবহন ব্যবস্থা সম্পর্কিত। উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা অনেক খাতের অর্থনৈতিক ব্যয় ও কমিয়ে আনে, যা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে সহায়তা করে। অর্থনৈতিক চাহিদা বৃদ্ধি মূল্য সংযোজন, যোগান নির্বিঘ্ন রাখার মাধ্যমে বাজার স্থিতিশীল রাখাও এর ভূমিকা রয়েছে। সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থার জন্য জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য অস্ট্রেলিয়ার সুনাম রয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, সেবার মান বৃদ্ধি, নিয়মিত তদারকি দেশগুলোকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে। উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার সুফল তাদের অর্থনীতি ও জনগণ পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করছে। দেশগুলোর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পেছনেও এটি নিয়ামক ভূমিকা রাখছে। পক্ষান্তরে রাজধানীর ঢাকার যানজটের কারণে ৩৭ হাজার কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দেশ। এটি বিশ্বব্যাংকের হিসাব। বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থা বললে মারাত্মক যানজট, মানহীন সড়ক, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, জরাজীর্ণ পরিবহন ও নিম্নমানের সেবা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। অনেক দেশেরই উন্নত অবকাঠামো রয়েছে কিন্তু পরিবহন ব্যবস্থাপনা প্রতিযোগিতামূলক ও মানসম্পন্ন নয়। এসব বিবেচনায় রেখে আমাদের পরিবহন ব্যবস্থাকে সমন্বিত রূপ দিতে পরিকল্পনা ঢেলে সাজাতে হবে। আর এটি বাস্তবায়নে শক্তিশালী তদারকি ব্যবস্থাও চালু করতে হবে। মানসম্পন্ন পরিবহন ব্যবস্থা অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সুযোগ সদ্ব্যবহারে মানুষ ও পণ্যের চলাচল নির্বিঘ্ন করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে পরিবহন ব্যবস্থার মান ও পরিমাণ উভয়ই বাড়তে হবে।