জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, অনিরাপদ খাবারের কারণে প্রতিদিন বিশ্বে অন্তত ১৬ লাখ মানুষ অসুস্থ হচ্ছে। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক বিভাগের প্রধান ফ্রান্সেসকো ব্রাঙ্কা জানিয়েছেন, এ ধরনের অনিরাপদ খাদ্য খাওয়ার কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হয়। তিনি জানান, খাদ্যসংক্রান্ত রোগে আক্রান্তদের মধ্যে ৪০ শতাংশই পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশু। আনাদুলু এজেন্সি।
খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি সীমানা চেনে না উল্লেখ করে ব্রাঙ্কা জোর দিয়ে বলেন, ক্রমবর্ধমান হারে আন্তঃসংযুক্ত বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলে অনিরাপদ খাদ্যের কারণে সৃষ্ট ঝুঁকিগুলো স্থানীয় সমস্যা থেকে দ্রুত আন্তর্জাতিক জরুরি অবস্থায় পরিণত হতে পারে।
তিনি বলেন, বিশ্বের অনেক অংশেই মানবিক সংকট খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তোলে। জাতিসংঘের কর্মকর্তারা বিশ্বের সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যেন তারা শিগগির তাদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখে।
একই সঙ্গে এসব ঝুঁকিসংক্রান্ত সার্বিক যোগাযোগ পরিকল্পনা অতি দ্রুত এগিয়ে নিয়ে প্রাণী, পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টিকে ‘মৌলিক’ লক্ষ্যমাত্রা হিসাবে দেখা হয়। মার্কাস লিপ নামের ওই কর্মকর্তা বলেন, নিরাপদ খাদ্য আরও ভালো উৎপাদন, পুষ্টি, পরিবেশ এবং জীবনকে সক্ষম করার জন্য এফএও’র কৌশলগত পরিকল্পনা পূরণের অন্যতম শর্ত। মার্কাস লিপ বলেন, ‘যখন একটি নিরাপদ ও টেকসই কৃষি খাদ্যব্যবস্থায় খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবসা স্বাস্থ্যকর জীবনে অবদান রাখে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচনকে এগিয়ে নেয়। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘উন্নত খাদ্য নিরাপত্তা জনস্বাস্থ্য রক্ষার পাশাপাশি শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে দেয়।’
সাম্প্রতিক প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বিশ্বে অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের অর্ধেকেরও বেশি অংশের বসবাস এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। মারাত্মক অপুষ্টি থেকে শুরু করে অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতা পর্যন্ত বিস্তৃত পরিসরে এবং প্রায় সব বয়সী মানুষের ওপরেই অপুষ্টির নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তবে বিশেষ করে শিশুদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব বেশি পড়ে এবং তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অঞ্চলে ৭ কোটি ৯০ লাখ শিশু বা পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি চার শিশুর একজন খর্বাকৃতির সমস্যায় ভুগছে এবং ৩ কোটি ৪০ লাখ শিশুর জীবন অকেজো হয়ে যাচ্ছে, যাদের মধ্যে ১ কোটি ২০ লাখ শিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে এবং ভয়াবহভাবে ক্রমবর্ধমান মৃত্যু ঝুঁকিতে রয়েছে। যদিও গত দশকে শিশুর খর্বাকৃতির সমস্যা নিরসনে উল্লেখযোগ্য কিছু অগ্রগতি হয়েছে, তবে শিশুর জীবন অকেজো হয়ে পড়া ঠেকাতে খুব কমই অগ্রগতি হয়েছে।
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা সবসময়ই একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। এ দেশে প্রায়ই খাদ্যাভাব দেখা দিতো, দুর্ভিক্ষ হতো। খাদ্য নিরাপত্তাকে সব সময়ই মনে করা হতো অধরা হরিণের মতো যা অর্জন করা কখনো সম্ভব নয়। কিন্তু বিগত ১০ বছরে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। করোনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাঝেও এ অর্থবছরে খাদ্যশস্যের (চাল, গম ও ভুট্টা) উৎপাদন কমেনি। এ কথা সর্বোতোভাবে স্বীকৃত যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় সরকারের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অনেকটা অগ্রগতি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিক জনসংখ্যার এ দেশে ক্ষুধা ও অপুষ্টি একটি বড় সমস্যা। কৃষি উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য এ সমস্যা কমিয়ে আনতে ভূমিকা রাখছে, সন্দেহ নেই। এর কৃতিত্ব মূলত কৃষকদের। তারা যাতে এক্ষেত্রে আরও সাফল্য অর্জন করতে পারেন, সেজন্য সরকারের সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে, ক্ষেত্রবিশেষে এ সহায়তা আরও বাড়াতে হবে। এ জন্য কৃষিজাত খাদ্য উৎপাদনে জাতীয়, দ্বিপাক্ষিক, বহুপাক্ষিক এবং বেসরকারি প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, খাদ্যনিরাপত্তা হলো খাদ্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা। অর্থাৎ কারো হাতে টাকা থাকলে সে খুব সহজে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারবে। জনগণের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যের মজুত ও তার সহজলভ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তাই হলো খাদ্য নিরাপত্তা।
জাতিসংঘের চারটি বিশেষায়িত সংস্থা আগেই সতর্ক করে জানিয়ে দিয়েছিল, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো যদি সব ধরনের অপুষ্টির অবসানে এবং ২০৩০ সাল নাগাদ ক্ষুধামুক্ত অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় নিজেদের পুনরায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না হয়, তাহলে এই অঞ্চলের মানুষ ও অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। অপুষ্টি নিরসনকে অগ্রাধিকার দেওয়া সত্ত্বেও এটি সারা বিশ্বেই একটি ভয়াবহ সমস্যা। প্রতিটি রাষ্ট্রকেই এই সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে আমাদের প্রত্যাশাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার বিষয়টি যেন কোনো অবস্থায় ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে।