আমরা বাঙালি। আঞ্চলিক নানা রীতি-নীতিতে সমৃদ্ধ সংস্কৃতির দেশ আমাদের বাংলাদেশ। আমাদের আছে নিজস্ব সংস্কৃতি। গৌরবময় বাঙালি সংস্কৃতির সে ইতিহাস ধর্ম-বর্ণ, গোত্রীয় রীতি-নীতি, পৈতৃক প্রথার সুষ্ঠু পরম্পরায় পরিচালিত। নিজস্ব সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ এ জনপদের মানুষ বরাবরই রুচিবোধসম্পন্ন এবং স্বাধীনচেতা। এদেশের মাটি ও মানুষের সাথে মিশে থাকা সংস্কৃতি পাশ্চাত্যের অনেক উন্নত দেশের চেয়েও মার্জিত ও সব মহলে গ্রহণযোগ্য। এখানে পরিবার আছে। সমাজ আছে। আর এ পরিবার ও সমাজের সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে এক সুস্থ, সুন্দর, রুচিশীল, মার্জিত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা। পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফালগুন, নবান্ন উৎসবসহ বিভিন্ন উৎসব বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এসব সংস্কৃতি আমাদের জাতীয় ও ধর্মীয় জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির আকাশ-পাতাল ব্যবধান। থার্টিফার্স্ট নাইটসহ ভিন দেশীয় বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠান পালন করার মাধ্যমে আমরা নানা সময়ে আমাদের দেশীয় এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সংকটাপন্ন করে তুলছি। দেশীয় পালাগান, কবি গান, আখড়াই গান, পুঁথি, জারি সারি গানের পাশাপাশি দেশীয় খেলাগুলো এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। লাঠি খেলা বিশেষ অনুষ্ঠান ও উৎসব ছাড়া দেখা যায় না। একই সাথে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম বাংলার বৌচি, দারিয়াবান্দা, হা-ডু-ডু, গোল্লাছুট, কানামাছি, বলি খেলা, মোরগের লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই, ঘোড়দৌড়সহ নানা ধরনের খেলা। গ্রাম বাংলার মাঠে ক্রিকেট, ফুটবলের পাশাপাশি ব্যাটমিন্টন, হকি, তাস, কেরাম, দাবাসহ বিভিন্ন খেলার উপস্থিতি এখন বেশি লক্ষ্য করা যায়। বিশ্বায়নের ঢেউ লেগেছে গ্রাম বাংলার বিভিন্ন উৎসব পার্বণে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের ঐতিহ্য এবং আবহমানকাল ধরে লালিত আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি। বর্তমানে আমরা দেশজ রীতিনীতি ও মূল্যবোধকে বিসর্জন দিতে শুরু করেছি। দুঃখ হয়, যখন দেখি আমাদের তরুণ সমাজ দেশীয় আবহাওয়ায় বিদেশী জীবনবোধকে গ্রহণ করে আত্মতৃপ্তি পাচ্ছে। পাশ্চাত্য লাইফ স্টাইলের প্রভাবে বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরা দেশীয় কালচারের সাথে পরিচিতি হওয়ার সুযোগ পায় না। আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাবে দেশের মানুষের আচরণে প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়াও কর্ম ব্যস্ততা, সাংসারিক টানাপোড়েন, সামাজিক সংকীর্ণতা, মানুষের মাঝে উৎসাহ উদ্দীপনার অভাব প্রভৃতির কারণে দেশের মানুষ শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চায় বিমুখ হয়ে উঠছেন বলে জানা গেছে। এটাকে বাংলার সংস্কৃতির বড় ধরনের পরিবর্তন বলে মনে করছেন সাংস্কৃতিক বিশেষজ্ঞরা। সংস্কৃতি পারস্পরিক বিনিময়যোগ্য। এটি চিরদিন স্থির থাকে না। বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে মিশে এর রূপ পরিবর্তন হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে নতুনত্বের নামে কোনো সংস্কৃতির জোর প্রভাবে যখন নিজস্ব সংস্কৃতির মৌলিক অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে, তখন সেটাকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলে অ্যাখায়িত করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ সকল সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে প্রত্যক্ষ ও বাহ্যিক নেতিবাচক প্রভাব হল নতুন প্রজন্মের কথাবার্তার পরিবর্তন।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মাতৃভাষা ও দেশীয় সংস্কৃতির পারস্পরিক সমপ্রীতি আমাদের জাতি গঠনে ও অতীত সংগ্রামে পাথেয় হয়ে আছে। আর সে কারণেই আমাদের মাতৃভাষাকে এবং দেশীয় সংস্কৃতিকে ধারণ ও লালন করতে হবে। করতে হবে এর সৃজনশীল ও কার্যকর রূপান্তর। দেশীয় সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতির দীর্ঘদিনের জীবনাচরণের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত মানবিক মূল্যবোধ, যা সুন্দরের পথে, কল্যাণের পথে এগিয়ে চলে। সংস্কৃতি স্থবির নয়, এগিয়ে চলাই তার ধর্ম। তাই সংস্কৃতিকে কোনো নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা কঠিন। সংস্কৃতির নিজস্ব স্বকীয়তা আছে। দেশ-কাল-জাতিভেদে এর রূপভেদ আছে। কিন্তু গুণভেদ নেই। সংস্কৃতির মূল কথা হল সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা।
আধুনিক প্রযুক্তির অপব্যবহার না করে এর সঠিক ও সৃষ্টিশীল ব্যবহারের মাধ্যমে দেশীয় সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও প্রচার করতে হবে। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। তাই দেশীয় সংস্কৃতি রক্ষা করতে হলে সবাইকে সচেতন ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। দেশীয় শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ও দেশের ঐতিহ্য নিয়ে সবার ভেতরে সচেতনতা থাকতে হবে।