বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ মালিকদের সুবিধার জন্য দেশে একটি আইনের প্রচলন রয়েছে। বছরের পর বছর এই আইন ঢিমেতালে চলায় কোনো সমস্যা না হলেও সাম্প্রতিক সময়ে আইনের কড়াকড়িতে বিদেশি জাহাজ মালিকেরা সংকটে পড়ছেন। এতে দেশের আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এর ফলে বর্তমানের বাড়তি জাহাজ ভাড়া আরো বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। তবে দেশীয় জাহাজ মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশীয় শিপিং সেক্টরকে সুরক্ষা দিতে এই আইনের কড়াকড়ির কোনো বিকল্প নেই। সূত্র জানায়, বিশ্বের পণ্য পরিবহনের প্রায় পুরো কার্যক্রমই চলে আন্তর্জাতিক নৌ পরিবহনের মাধ্যমে। চট্টগ্রাম বন্দরে বছরে গড়ে চার হাজারের বেশি জাহাজ আসা-যাওয়া করে। একসময় বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি কন্টেনার জাহাজ থাকলেও দিনে দিনে তা কমে গেছে। ইতোমধ্যে কোনো কোনো কোম্পানি ঋণখেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশি একটি কোম্পানি ছয়টি কন্টেনার জাহাজ কিনেছে। এর বাইরে কয়েকটি কোম্পানি আগে থেকে জাহাজ পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) বহরে থাকা জাহাজগুলো বিদেশি কোম্পানির নিকট দীর্ঘমেয়াদি ভাড়া দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ হিসেব অনুষায়ী দেশীয় পতাকাবাহী ৭৫টির মতো জাহাজ রয়েছে।
দেশীয় জাহাজগুলোকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য ‘বাংলাদেশ পতাকাবাহী জাহাজ (স্বার্থরক্ষা) আইন ২০১৯’ নামের একটি আইন রয়েছে। আশির দশকের শুরু থেকে দেশীয় জাহাজগুলোকে সুরক্ষা দিতে একটি আইনের প্রচলন রয়েছে। ওই আইনের ৩ নম্বর ধারার ৩ উপধারা মোতাবেক ‘অব্যাহতি প্রাপ্তি’র লক্ষ্যে পণ্য বোঝাই করার অন্যূন ১৫ কার্যদিবস পূর্বে নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন করার শর্ত রয়েছে। অর্থাৎ কোনো বন্দর থেকে বাংলাদেশের কোনো পণ্য বোঝাই করতে হলে জাহাজ মালিকদের ১৫ কর্মদিবস আগে এদেশীয় এজেন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন এবং দেশীয় জাহাজ মালিকদের সংগঠন বঙওয়া বরাবরে এনওসির জন্য আবেদন করতে হয়। যদি ওই বন্দরে বাংলাদেশি কোনো জাহাজ থাকে তাহলে পণ্যগুলো দেশীয় জাহাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিবহন করবে। দেশীয় জাহাজ না থাকলে বিদেশি জাহাজ পরিবহন করতে পারবে। এক্ষেত্রে ওই বন্দরে দেশীয় জাহাজ নেই মর্মে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন এবং বঙওয়া এনওসি প্রদান করবে। এই এনওসির ভিত্তিতে মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের প্রিন্সিপ্যাল অফিসার ওয়েভার সনদ ইস্যু করবেন। ওই সনদমূলে বিদেশি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরমুখী পণ্য বোঝাই করতে পারবে।
আশির দশকের শুরু থেকে এই আইন চলে আসছে। তবে এক্ষেত্রে ‘১৫ কর্মদিবস’-এর ব্যাপারটি পালন করা হতো না। ২/৪ দিন আগে সংশ্লিষ্ট জাহাজ মালিক ওয়েভার সনদ গ্রহণ করতেন। তবে ওই বন্দরে দেশীয় কোনো জাহাজ থাকলে এই সনদ ইস্যু করা হতো না।
কিন্তু সম্প্রতি নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তর থেকে ‘১৫ কর্মদিবস’-এর ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। যেকোনো বিদেশি জাহাজ বাংলাদেশের পণ্য পরিবহন করতে হলে ১৫ কর্মদিবস আগেই ওয়েভার সনদের জন্য আবেদন করতে হবে। এর পরে আবেদন করা হলে তা বাতিল করা হচ্ছে। ওই জাহাজকে এদেশীয় পণ্য পরিবহন করতে দেয়া হচ্ছে না।
বিষয়টি নিয়ে বিদেশি জাহাজ মালিকদের মাঝে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তারা বিষয়টি লিখিতভাবে নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তরের প্রিন্সিপ্যাল অফিসারকে জানিয়েছেন। গত সোমবার এক পত্রে তারা জানান, কড়াকড়ির ব্যাপারটি অস্বাভাবিক। কারণ জাহাজ ছাড়ার ১৫ কর্মদিবস আগে ওই জাহাজের ব্যাপারে ওয়েভার সনদ চাওয়ার ব্যাপারটি স্বাভাবিক নয়। এটি বাস্তবসম্মতও নয়। অধিকাংশ সময় পণ্য পরিবহনের ব্যাপারে ৪/৫ দিন আগে জাহাজ ভাড়া করা হয়। প্রতিবেশী দেশগুলোতে স্বল্প সময়ে পণ্য পরিবহনের সুবিধা থাকায় তুলনামূলকভাবে কম সময়ের মধ্যে জাহাজ ভাড়া করে পণ্য বোঝাই করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবেও জাহাজ ভাড়া করা হয়। কিন্তু এই আইনের কড়াকড়িতে জাহাজ ১৫ কর্মদিবস আগে ভাড়া করতে হলে পুরো সমুদ্র বাণিজ্যই মুখ থুবড়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেছে একাধিক শিপিং এজেন্ট। বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ স্বাক্ষরিত ওই পত্রে আইনের এই কড়াকড়িতে বিদেশি জাহাজ মালিকদের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
এ ব্যাপারে নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, দেশীয় জাহাজকে সুরক্ষা দিতেই এই আইন করা হয়েছে। আইনটি কার্যকর ছিল না। এতে বিপুল সম্ভাবনার দেশীয় শিপিং খাত বিকশিত হয়নি। আইনের কড়াকড়ি প্রয়োগে দেশীয় শিপিং সেক্টর লাভবান হবে। তারা বলেন, বন্দরে দেশীয় জাহাজ থাকলে বিদেশি জাহাজ আমাদের পণ্য পরিবহন করতে পারবে না-এটিই আমাদের সুরক্ষা। নিজেদের সুরক্ষার জন্য পৃথিবীর অনেক দেশে এই ধরনের আইন কড়াকড়িভাবে আরোপ করে।
বাংলাদেশি জাহাজ মালিকদের প্রতিনিধি ক্যাপ্টেন মেহেরুল করিম আজাদীকে বলেন, বিষয়টি শিপিং এজেন্টদের নয়। এটা নিয়ে তারা কথা বলার অধিকার রাখেন না। তারা বিদেশি জাহাজ মালিকের স্বার্থ সংরক্ষণ করেন। এটা ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ প্রটেকশন আইন, নট ইন্টারন্যাশনাল। দেশীয় জাহাজকে সুরক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে এর বিকল্প নেই।
বিদেশি শিপিং এজেন্টদের একজন শীর্ষ নেতা বলেন, বর্তমানে বাড়তি জাহাজ ভাড়ায় দিশেহারা দেশের আমদানি-রপ্তানি খাত। এই আইনের কড়াকড়িতে জাহাজ ভাড়া আরো বাড়বে। দেশীয় সব পণ্য পরিবহনের সক্ষমতা আমাদের নেই। যদি বিদেশি জাহাজগুলো অবাধে চলাচল করতে না পারে তাহলে আমাদের নৌ বাণিজ্য সংকটে পড়বে।
তবে দেশীয় জাহাজ মালিকদের একাধিক প্রতিনিধি বলেন, এই আইনের ফলে দেশের শিপিং সেক্টর বিকশিত হবে। বিদেশি জাহাজগুলো ব্যবসা করার জন্য এদেশে আসবে। এদেশের আইন মেনে চলতে তারা বাধ্য। এক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাবের শঙ্কার কথা নাকচ করেন তারা।