দেশের আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যের পণ্য পরিবহন নিয়ে দেশি–বিদেশি জাহাজের বিরোধ বাড়ছে। বাংলাদেশি জাহাজের স্বার্থ সুরক্ষায় প্রণীত ফ্ল্যাগ ভ্যাসেল প্রোটেকশন অ্যাক্ট নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে চলা দেশি ও বিদেশি জাহাজের স্নায়ুযুদ্ধ নতুন মাত্রা পাচ্ছে। সূত্র জানিয়েছে, বিদেশি জাহাজগুলো একজোট হয়ে নেতিবাচক কোনো পদক্ষেপ নিলে বাংলাদেশ বেকায়দায় পড়বে। অবশ্য এই আশঙ্কা নাকচ করে একাধিক শিপিং বিশেষজ্ঞ বলেছেন, বিদেশি জাহাজ মালিকদের একজোট হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এরা এখানে ব্যবসা করছে। বাংলাদেশ শিপিং বাণিজ্যের জন্য একটি উর্বর জায়গা।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, সমুদ্র বাণিজ্যের বিশাল বাজারে দেশের অংশীদারত্ব বাড়ানোর জন্য অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছে সরকার। এই পণ্যের অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ যাতে দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজ পরিবহন করতে পারে তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ফ্ল্যাগ ভ্যাসেল প্রোটেকশন অ্যাক্ট ২০১৯ নামে একটি আইন রয়েছে। মূলত দেশীয় জাহাজকে সুরক্ষা দিতে আইনটি প্রণয়ন করা হয়। এই আইনে বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরগুলোতে চলাচলকারী বিদেশি জাহাজগুলোকে একটি এনওসি বা অনাপত্তিপত্র নেওয়ার বাধ্যবাধকতায় আনা হয়েছে। দেশের বন্দরের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে বাংলাদেশি আমদানি কিংবা রপ্তানি পণ্য পরিবহন করতে আগেভাগে মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের প্রিন্সিপ্যাল অফিসার (পিও–এমএমডি) থেকে এই এনওসি বা ছাড়পত্র নিতে হয়। পিও–এমএমডি বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ওশনগোয়িং শিপ ওনার্স এসোসিয়েশনের (বগসোয়া) কাছ থেকে তথ্য নিয়ে সংশ্লিষ্ট বন্দরে দেশীয় পতাকাবাহী কোনো জাহাজ নেই বা পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে উপস্থিত হওয়ার সিডিউল নেই মর্মে নিশ্চিত হওয়ার পরই বিদেশি জাহাজকে পণ্য বোঝাইয়ের ছাড়পত্র বা ওয়েভার সার্টিফিকেট প্রদান করে। এই সনদ পাওয়ার পরই কেবল ওই বিদেশি জাহাজ পণ্য বোঝাই করতে পারে। কোনো বন্দরে বাংলাদেশি জাহাজ নোঙর করা থাকলে বা পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে পৌঁছার সিডিউল থাকলে ওই বন্দরে বাংলাদেশমুখী কোনো পণ্য আর ওই বিদেশি জাহাজ লোড করতে পারে না।
বছর কয়েক আগে প্রণীত আইনটি নিয়ে বাংলাদেশ তেমন কড়াকড়িতে যায়নি। দেশীয় জাহাজের সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ায় এই আইন নিয়ে কড়াকড়ির সুযোগও ছিল না। এখনো দেশীয় মালিকানাধীন জাহাজের সংখ্যা প্রত্যাশিত পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। তবুও আইনটি নিয়ে কড়াকড়ি শুরু হয়েছে। ছাড়পত্র ইস্যু নিয়ে বিরাজ করছে সংকট। দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও অনেক বিদেশি জাহাজ ওয়েভার সনদ বা পণ্য বোঝাইয়ের অনুমোদন পাচ্ছে না। এতে করে বিদেশি পতাকাবাহী অনেক জাহাজকে সংকটে পড়তে হচ্ছে।
চট্টগ্রামের একাধিক শিপিং বিশেষজ্ঞ বলেছেন, বাংলাদেশের আমদানি–রপ্তানি পণ্যের ভলিউম অনেক। অপরদিকে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা মাত্র ৯০টি। এর মধ্যে মাত্র ৮টি কন্টেনার জাহাজ। এই স্বল্প সংখ্যক জাহাজ দিয়ে দেশের এত পণ্য হ্যান্ডলিং কঠিন। আবার ওয়েভার ইস্যু নিয়ে বিদেশি জাহাজগুলোও পণ্য বোঝাই করতে পারছে না। ফলে পণ্য পরিবহন নিয়ে সংকট তৈরি হচ্ছে। সংকট নিরসনে ইতোপূর্বে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে দফায় দফায় বৈঠক এবং নানা সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও সংকটের সুরাহা হয়নি। দেশীয় জাহাজের স্বার্থ সুরক্ষার ব্যাপারটি সংসদে পাশকৃত আইন হওয়ায় এর বাইরে গিয়েও কিছু করা যাচ্ছে না।
দেশি–বিদেশি জাহাজের বিরোধের মাঝে দেশের পণ্য পরিবহন যাতে ব্যাহত না হয় সেদিকে সজাগ এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের (এমএমডি) একজন কর্মকর্তা বলেন, আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করার সুযোগ নেই। দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের স্বল্পতাসহ অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, সক্ষমতা অর্জনের জন্য এই কড়াকড়ি গুরুত্বপূর্ণ। দেশি–বিদেশি জাহাজ নিয়ে বিরাজিত সংকট যত দ্রুত নিরসন করা যাবে ততই দেশের আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য মঙ্গল হবে। এমএমডির পক্ষ থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরকে বিষয়টির ব্যাপারে আপডেট দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজের স্থানীয় প্রতিনিধিদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিদেশি জাহাজগুলোতে পণ্য বোঝাই করার ক্ষেত্রে যেভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে তাতে দেশ বড় কোনো সংকটের দিকে যাচ্ছে কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। কারণ দেশের আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যের আশি শতাংশের বেশি পণ্য পরিবহনকারী বিদেশি জাহাজগুলো একজোট হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তার মূল্য দেশকেই দিতে হবে।