বাংলাদেশি জাহাজের স্বার্থ সুরক্ষায় প্রণীত ফ্ল্যাগ ভ্যাসেল প্রোটেকশন অ্যাক্ট নিয়ে আবারো কড়াকড়ির দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি এই ব্যাপারে মনিটরিং কমিটির উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। বৈঠকের আলোচ্যসূচি নিয়ে ইতোমধ্যে শিপিং সেক্টরে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। ইতোপূর্বে এই আইন বাস্তবায়নে বিভিন্ন বিদেশি জাহাজ থেকে জরিমানা আদায়সহ কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর বিষয়টিতে কিছুটা শিথিলতা পরিলক্ষিত হলেও আবারো নতুন করে কড়াকড়ি শুরু হতে যাচ্ছে বলে সূত্র আভাস দিয়েছে। ফ্ল্যাগ প্রোটেকশন অ্যাক্ট নিয়ে বাংলাদেশের কড়াকড়িতে বিশ্বের নানা দেশের জাহাজ মালিকেরা উদ্বেগ প্রকাশ করে। বিভিন্ন দেশে চলাচলকারী কন্টেনার এবং রো রো ভ্যাসেল অপারেটরদের সংগঠন ওয়ার্ল্ড শিপিং কাউন্সিল (ডব্লিউএসসি) থেকে ফ্ল্যাগ ভ্যাসেল প্রোটেকশন অ্যাক্টের কিছু ধারা ও শর্ত সংশোধনের আহ্বান জানিয়ে আসছে।
শিপিং সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশীয় পতাকাবাহী সরকারি–বেসরকারি জাহাজকে সুরক্ষা দিতে বাংলাদেশ ফ্ল্যাগ ভ্যাসেল প্রোটেকশন অ্যাক্ট’ ২০১৯ নামের একটি আইন রয়েছে। ইতোপূর্বে ১৯৮২ সালে ফ্ল্যাগ প্রোটেকশন অডিন্যান্স হিসেবে থাকলেও পরবর্তীতে তা আইনে পরিণত করা হয়। দেশীয় জাহাজ শিল্পকে সুরক্ষা দিতেই মূলতঃ আইনটি প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের প্রেক্ষিতে বিদেশি জাহাজগুলোকে দেশের বন্দরের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে বাংলাদেশি আমদানি কিংবা রপ্তানি পণ্য পরিবহন করতে আগেভাগে মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের প্রিন্সিপ্যাল অফিসার (পিও–এমএমডি) থেকে অনুমোদন বা ছাড়পত্র নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের (এমএমডি) প্রিন্সিপ্যাল অফিসার বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) এবং বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ওশনগোয়িং শিপ ওনার্স এসোসিয়েশনের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট বন্দরে দেশীয় পতাকাবাহী কোন জাহাজ নেই বা পরবর্তী ১৫দিনের মধ্যে উপস্থিত হওয়ার সিডিউল নেই মর্মে নিশ্চিত হওয়ার পরই বিদেশি জাহাজকে উক্ত পণ্য বোঝাইয়ের ছাড়পত্র বা ওয়েভার সার্টিফিকেট প্রদান করে থাকে। বন্দরে বাংলাদেশি জাহাজ উপস্থিত বা ১৫ দিনের মধ্যে আসার সিডিউল থাকলে ওই পণ্য আর বিদেশি কোন জাহাজ পরিবহন করতে পারে না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বহু ক্ষেত্রে বিদেশি জাহাজ পণ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসলেও ফিরতি পথে ওয়েভার না পেয়ে পণ্য বোঝাই করতে পারে না বলেও জানিয়েছেন বিদেশি জাহাজের এজেন্টেরা। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে ওয়েভার সনদ না নিয়ে পণ্য নিয়ে যাওয়ার জন্য বিদেশি জাহাজগুলোকে মোটা অংকের জরিমানা গুণতে হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে শুধু বিদেশি জাহাজ মালিকদের সংগঠনই নয়, দেশের তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকেও আইনের কড়াকড়ির ব্যাপারটির পুর্নবিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছে। বিজিএমইএর পক্ষ থেকে অরজিন টু অরজিন পণ্য পরিবহনের মধ্যে ফ্ল্যাগ প্রোটেকশন অ্যাক্ট সীমাবদ্ধ রাখার জন্যও পরামর্শ দিয়েছিল। ওয়ার্ল্ড শিপিং কাউন্সিলও এই আইনের কড়াকড়ি নিয়ে ইতোপূর্বে উদ্বেগ প্রকাশ করে। ওয়াশিংটন ভিত্তিক সংগঠনটির সিঙ্গাপুর অফিস থেকে আইনটির বেশ কিছু ধারা ও শর্ত শিথীল করার জন্য ইতোপূর্বে আহ্বান জানিয়েছিল।
বিশেষ করে ১৫দিন আগে সিডিউল দিয়ে ওয়েভার সনদ নেয়ার প্রসঙ্গে পত্রে বলা হয়েছে, যেখানে ৩/৪দিনের ট্রানজিটে পণ্য পরিবাহিত হয়, সেখানে ১৫দিন আগে থেকে বলে সনদ যোগাড় করা অসম্ভব।
উল্লেখ্য, দেশের ৫০ শতাংশ পণ্য দেশীয় জাহাজ দিয়ে পরিবহনের লক্ষ্য নিয়ে ফ্ল্যাগ প্রোটেকশন অ্যাক্ট করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) কিংবা বেসরকারি কোম্পানিগুলোতে জাহাজের সংখ্যা খুবই নগন্য হওয়ায় দেশীয় জাহাজ দিয়ে ৫০ শতাংশ পণ্য পরিবহন সম্ভব নয়। বাংলাদেশের পতাকাবাহী কন্টেনার জাহাজের সংখ্যা মাত্র ৮টি, অথচ চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের সাথে সিঙ্গাপুর কলম্বো এবং পোর্ট কেলাং মিলে ৯০টিরও বেশি বিদেশি কন্টেনার জাহাজ চলাচল করে। এসব জাহাজের চলাচল নির্বিঘ্ন না থাকলে সমুদ্রপথে আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য সামাল দেয়া কঠিন হয়ে উঠবে বলেও সূত্রগুলো জানিয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, ফ্ল্যাগ প্রোটেকটশন অ্যাক্ট নিয়ে বেশ কড়াকড়ি চলে আসছিল গত বছরের শুরু থেকে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বিষয়টি নিয়ে আর তেমন কোন উচ্চবাচ্য কোন পক্ষ থেকেই করা হয়নি। কিন্তু সম্প্রতি নৌপরিবহন অধিদপ্তরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার (চলতি দায়িত্ব) বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ (স্বার্থরক্ষা) বিধিমালা, ২০২৩ এর বিধি ৭ মোতাবেক গঠিত মনিটরিং কমিটির দ্বিতীয় সভা আহ্বান করেছেন। আগামী ১১ জানুয়ারি সকালে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে এই সভা অনুষ্ঠিত হবে। এই বৈঠকের চিঠিটি প্রচার হওয়ার পরই দেশের শিপিং সেক্টরে নতুন করে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে সভার আলোচ্যসূচি নিয়ে বিদেশি জাহাজ মালিকদের স্থানীয় এজেন্টদের মাঝে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। আবারো আগের মতো কড়াকড়ি শুরু হচ্ছে কিনা তা নিয়ে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ। মনিটরিং কমিটির দ্বিতীয় সভার আলোচ্যসূচিতে সাতটি বিষয় রাখা হয়েছে। এরমধ্যে মনিটরিং কমিটির কার্যপরিধি সম্পর্কে সদস্যদের অবহিতকরণ, গত সভার সিদ্ধান্ত সমূহের অগ্রগতি পর্যালোচনা, বাংলাদেশ পতাকাবাহী জাহাজ (স্বার্থরক্ষা) আইন/বাংলাদেশ পাতাকাবাহী জাহাজ বিধিমালা বাস্তবায়নে বাঁধাসমূহ চিহ্নিতকরণ, বিভিন্ন সময়ে ওয়েভার গ্রহণ ব্যতিরেকে বিদেশি জাহাজ কার্গো লোড কেন করেছে তা নিশ্চিতকরণ, ওয়েভার সনদ যথাযথভাবে প্রদান করা হয়েছে কি না তা বিশ্লেষণ, বিভিন্ন কোম্পানরি উপর আরোপিত জরিমানা সঠিকভাবে আরোপ করা হয়েছে কি না তা যাচাই করা এবং আরোপিত জরিমানা আদায় হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা, আদায় না হয়ে থাকলে তার কারণ বিশ্লেষণ, বাংলাদেশ পতাকাবাহী জাহাজ (স্বার্থরক্ষা) আইন/বাংলাদেশ পতাকাবাহী জাহাজ (স্বার্থরক্ষা) বিধিমালা নিষ্পত্তি, গ্রহণ অথবা ওয়েভার প্রদান সম্পর্কিত অভিযোগের বিশ্লেষণ এবং সঠিক নিষ্পত্তির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের (এমএমডি) দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা আগামী ১১ জানুয়ারি বৈঠকের কথা স্বীকার করে দৈনিক আজাদীকে বলেন, এটি একটি রুটিন বৈঠক। মনিটরিং কমিটির স্বাভাবিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। তিনি বলেন, ফ্ল্যাগ প্রোটেকটশন অ্যাক্ট বাংলাদেশ সংসদে পাশ করা একটি আইন। এটি লঙ্ঘনের কোন সুযোগ নেই। বিদেশি জাহাজ মালিকদের ব্যবসা করতে হলে এই আইন মেনেই করতে হবে।
বাংলাদেশের পতাকাবাহী ৮টি জাহাজ দিয়ে পুরো ব্যবসা সামাল দেয়া সম্ভব কিনা এমন প্রশ্নে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, এগুলো আমাদের অহেতুক হুমকি দেয়। তারা ব্যবসা করতে আসবেই। তাছাড়া আইন বাস্তবায়ন সুনিশ্চিত করা গেলে আমাদের শিপিং ব্যবসায়ীরা এক্ষেত্রে বিনিয়োগ করবে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমরা কয়েকমাস স্বস্তিতে ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে আবারো আইনটি নিয়ে কড়াকড়ি শুরু হবে। ইতোপূর্বে বহু জাহাজকে লাখ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে কয়েকটি বিদেশি অপারেটর জাহাজ প্রত্যাহারেরও ঘোষণা দিয়েছিল। এখন নতুন করে ওয়েভার নিয়ে মাতামাতি শুরু হলে পরিস্থিতি কোনদিকে যায় কে জানে! আমরা খুব নিবিড়ভাবেই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি বলেও ওই কর্মকর্তা বলেন।







