বাহিরপানে তাকায় না যে কেউ,
দেখে না যে বাণ ডেকেছে
জোয়ার–জলে উঠছে প্রবল ঢেউ।
….
‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’।
এ কথাগুলো তারুণ্য আর যৌবনের জয়গানে রচিত কবিতার পঙ্ক্তি। আমাদের কৈশোর তারুণ্য উত্তাল সময়ে নব্বইয়ের গণআন্দোলনের জোয়ারে ভেসেছি এই কবিতার পঙ্ক্তিতে। স্বৈরাচারের অপশাসন থেকে মুক্তি দিতে কামরুল হাসানের তুলিতে ঐতিহাসিক সেই স্কেচ রচিত হয়, যাতে লেখা ছিল, দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে। এই সাহসী কথাগুলো একাত্তর থেকে নব্বই দুরন্ত সাহসে উচ্চারণ করেছেন পটুয়া কামরুল হাসান। বয়স তাঁর তারুণ্য দমাতে পারে নি। তাঁর দুর্দমনীয় সাহসও দমাতে পারে নি।
একাত্তরের তিরিশ লাখ শহীদ, বর্বরোচিত অত্যাচারের শিকার নারী, পুরুষ যতো আত্মদান, আমাদের প্রতিটি ধুলিকণা রক্তস্নাত–একথা আমরা ভুলিনি। ভুলতে পারেনি কোনও প্রজন্ম। তবু আমাদের সন্তানেরা কতোটা রাজনীতি সচেতন? সচেতন হলেও তাদের দায়বদ্ধতার কতোটা মূল্যায়ন আমরা করতে পেরেছি?
আমরা এ সমাজের যেখা নেই বসবাস করি না কেন, দায় আমাদের সকলেরই থাকে। যার যার মতো পালনও করি অনেকেই।
সৎসাহসে প্রতিবাদে গর্জে ওঠা, সত্য বলবার তারুণ্য সকলের থাকে না বটে, অনেকের থাকে। সেটা যুগে যুগে কালে কালে ইতিহাসের পাতায় উঠে এসেছে।
ঊনসত্তরের আগুন ঝরা দিনে দেশপ্রেমের জন্য খুনি হতে হয়েছিলো মুক্তিকামী তরুণদের আর তাদের প্রেরণা ছিল উত্তাল ঊনসত্তরের দামাল তরুণ হেলাল হাফিজের কালজয়ী সেই কবিতাটির রচনার নেপথ্যে ছিল এক শ্রমজীবীর একটি উক্তি।
সুদীর্ঘ ৫৪ বছরের বেশি সময় ধরে তরুণ তরুণীর মুখে মুখে ফেরা জনপ্রিয় সেই কবিতাটি এ দেশের মানুষের মুখে মুখে ফেরে এখনো।
কবিতাটির প্রথম দুই পঙক্তি, ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ প্রেরণা জুগিয়েছিল উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধীসহ প্রগতিশীল সব আন্দোলনে। জনপ্রিয় কবি হেলাল হাফিজের লেখা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ শিরোনামের কবিতাটি তুমুল আলোচনায়, রাজপথে, ঘরে বাইরে ভালোবাসায় ভাসিয়েছে সকল বয়সী মানুষকে।
পঞ্চাশ বছর আগে যুবকেরা প্রাণ বাজি রেখে লিখেছেন কলম খুলে। ভেবেছেন দেশমাতৃকার মুক্তির শপথ, লড়েছেন রাজপথে কাব্যকথায়।
প্রবীণ এক রিকশাচালককে বলতে শুনলেন, ‘মার, মার শালাদের। প্রেমের জন্য কোনো কোনো সময় মার্ডারও করা যায়।’ কবির মগজে ও মনে গেঁথে গেল কথাটি। দেশপ্রেমের জন্যও তো মার্ডার করা যেতে পারে। আর সেই ঘটনা থেকেই কালজয়ী এ কবিতাটির জন্ম।’
উনসত্তরে জনপ্রিয় কবি হেলাল হাফিজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন। পরাধীন মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে পাকিস্তানী সেনা এবং তাদের এদেশিয় দোসর রাজাকার আলবদর বাহিনীর নিপীড়নের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন কবিতায়।
‘উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান চলাকালে একদিন সন্ধ্যায় পুরান ঢাকা থেকে ইকবাল হলে (এখন সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ফিরছিলেন তিনি। কবির বর্ণনায়, গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়ায় আমার রিকশাটি থামল। সেখানে তখন সমানে মিছিল চলছে। ইপিআর (এখন বিজিবি) ও পুলিশ মিছিলকারীদের পেটাচ্ছে, ধাওয়া দিচ্ছে। মিছিল থেকেও ছোঁড়া হচ্ছে ইটপাটকেল। এর মধ্যে বয়স্ক এক রিকশাচালক বলে উঠলেন, ‘মার, মার শালাদের। প্রেমের জন্য কোনো কোনো সময় মার্ডারও করা যায়।’ রিকশাওয়ালারা মাঝেমধ্যে টুকটাক ইংরেজি শব্দও বলে। কথাটা আমার মগজে ও মনে গেঁথে গেল। আসলেই তো তাই! দেশপ্রেমের জন্যও তো মার্ডার করা যেতে পারে। ওই ঘটনা থেকেই কবিতাটির জন্ম।’
বর্তমান তরুণ সমাজকে প্রভাবিত করতে তেমন আগ্রহী নয় অনেক রাজনীতিক। তাদের উপর এ কারণে তরুণেরা আস্থা রাখতে পারেন না। অনেকে রাজনীতি এবং রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে সন্দিহান অথবা অনাগ্রহী। তাহলে সমাজের ছাপ শিল্প সাহিত্যে পরিস্ফুট হবার ধারাবাহিকতায় ব্যত্যয় ঘটে বটে।
কীর্তিমান নগর পরিকল্পনাবিদ আশিক ইমরানের মতে, সৃষ্টিশীল তরুণেরা সমাজ নিয়ে ভাবতে চায়। তবে, তাদের সুযোগ করে দিতে হবে। সেটা করবার চেষ্টা নগর নেতারা করলেও সম্মিলিত প্রচেষ্টা সেভাবে এগোয়নি জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বলাকা কাব্যের কথা স্মর্তব্য। এ কাব্যে ‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা’ কবিতায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,/ ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,/আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।/রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে/আজকে যে যা বলে বলুক তোরে,/সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ ক‘রে/ পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা।/ আয় দুরন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।”
বয়সের জোরে যারা তরুণদের দমিয়ে রাখতে চায়, তাদের নিয়ে কবিগুরু মজা করে বলেছেন, ‘ওই যে প্রবীণ, ওই যে পরম পাকা,/চক্ষুকর্ণ দুইটি ডানায় ঢাকা,/ঝিমায় যেন চিত্রপটে আঁকা/ অন্ধকারে বন্ধ করা খাঁচায়।/ আয় জীবন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।/ তোরে হেথায় করবে সবাই মানা।/ হঠাৎ আলো দেখবে যখন/ ভাববে এ কী বিষম কাণ্ডখানা।/সংঘাতে তোর উঠবে ওরা রেগে,/শয়ন ছেড়ে আসবে ছুটে বেগে,/ সেই সুযোগে ঘুমের থেকে জেগে/ লাগবে লড়াই মিথ্যা এবং সাঁচায়।/আয় প্রচণ্ড, আয় রে আমার কাঁচা।/ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।”
কবিগুরুর বাণী আমরা স্মরণ করলে হয়তো প্রজন্মান্তরে দায়বদ্ধতা পালনে সফল হতে পারে এ সমাজের নীতিনির্ধারকেরা।
সাহিত্যের আড্ডা ছাড়া কখনো সাহিত্য বিকশিত হয় না। কোনও অন্ধ কুঠুরিতে সাহিত্য বিকশিত হতে পারে না। লাইব্রেরিতে পড়ে বা রকে বসে আড্ডা দিয়ে সৃষ্টিশীল জগতে যে রাজত্ব করা যায়, তা আর কোনও ভাবেই হয় না। নারী পুরুষের বিভেদ নয়, কোনও জটিল কুটিল চিন্তা নয়, উন্মুক্ত মন নিয়ে তারুণের মেল বন্ধন ঘটাতে পারলে এ সমাজ হতে পারে এক সমৃদ্ধ সমাজ। যেখানে সাহিত্য, শিল্প আলো হাওয়ায় খেলবে। যুগে যুগে সেটা প্রতিষ্ঠিত সত্য।
চিন্তাশীল বিজ্ঞানমনস্ক রাজনীতি সচেতন সমাজ এগিয়ে নিতে পারে তার দেশ ও সমাজকে। এ কাজের দায়িত্ব চট্টগ্রামের নীতিনির্ধারকদের। খোলামেলা আড্ডার জায়গা জামালখান। গোলচত্বরে কয়েকটা বেঞ্চ বসালে সেখানেও আলোচনার ক্ষেত্র হতে পারে। সার্কিট হাউস, ডিসি হিল নিরাপদ আলোচনার স্থান হলে সান্ধ্য আড্ডায় সৃষ্টিশীল তরুণ তরুণীর বিকশিত জীবনের বীজ বপন হতে পারে।
ভালো মন্দ বিচারবোধ গড়ে উঠতে সহায়তা করতে হবে তরুণদের। তাতে তাদের দায়বদ্ধতা তৈরি হবে। এটুকু নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে দায়িত্বশীল সমাজসংস্কারকের শূণ্যতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বিশাল শূন্যতা তৈরি করতে পারে, যা অনিবার্য এবং দুঃখজনক পরিণতি। তরুণ সমাজকে যেন সেদিকে ধাবিত হতে না দিই আমরা।
লেখক: সাংবাদিক।