দেশজুড়ে নিম্নমানের জ্বালানি সরবরাহ করার অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) তিন বিপণন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। পদ্মা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম ও যমুনা অয়েল কোম্পানির চারটি ডিপো পরিদর্শন করে বিপিসির তদন্ত টিমের মানহীন অকটেন ও জ্বালানি পাওয়া নিয়ে পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে চার ডিপো ইনচার্জকে শো’কজ করেছে বিপিসি। পাশাপাশি মানহীন জ্বালানি পাওয়ার বিষয়ে তিন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মতামত চাওয়া হয়েছে বিপিসির পক্ষ থেকে।
জানা যায়, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে বিএসটিআই মানের জ্বালানি পণ্য গ্রহণ করছে বিপিসি। বিএসটিআইয়ের নির্দেশনা মতে অকটেনের আরওএন (রিচার্স অকটেন নাম্বার) মান ন্যূনতম ৯৫ ও পেট্রলের আরওএন মান ৮৯ নির্ধারণ করা হয়। বিপিসির নিয়ন্ত্রণাধীন বিপণন কোম্পানিগুলোকে (পদ্মা, মেঘনা, যমুনা) ওই মান মাত্রায় জ্বালানি পণ্য গ্রহণ ও সরবরাহের জন্য ১৬ আগস্ট নির্দেশনা দেয় বিপিসি।
পরে ২১ সেপ্টেম্বর মেঘনা পেট্রোলিয়ামের গোদনাইল ও ফতুল্লা ডিপো, পদ্মা অয়েলের গোদনাইল ডিপো এবং যমুনা অয়েলের ফতুল্লা ডিপো পরিদর্শন করে বিপিসির আকস্মিক তদন্ত দল। ডিপো পরিদর্শন শেষে তদন্ত টিম বিপিসিতে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেয়। এরপর ১১ নভেম্বর বিপিসির সচিব মো. লাল হোসেন স্বাক্ষরিত পৃথক পত্রে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের গোদনাইল ডিপো ইনচার্জ ম্যানেজার (অপারেশন) মো. লুৎফর রহমান, ফতুল্লা ডিপো ইনচার্জ ম্যানেজার (অপারেশন) আশফাক উল হক, পদ্মা অয়েল কোম্পানির গোদনাইল ডিপো ইনচার্জ শাহজাহান কবির চৌধুরী, যমুনা অয়েলের ফতুল্লা ডিপো ইনচার্জ নজমুল হাসানকে শো’কজ করা হয়। পাশাপাশি তিন বিপণন ৫ম পৃষ্ঠার ৭ম কলাম
প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের কাছ থেকে মানহীন জ্বালানি পাওয়ার বিষয়ে মতামত চায় বিপিসি। এর আগে সারা দেশে বিএসটিআই নির্দেশিত মানসম্মত জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতের জন্য ১ সেপ্টেম্বর থেকে বেসরকারি ১২ কনডেনসেট ফ্র্যাকশনেশন প্লান্ট থেকেও ডিজেল ও পেট্রোল নেওয়া বন্ধ করে দেয় বিপিসি।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সারা দেশে জ্বালানি তেল নিয়ে অসংখ্য সিন্ডিকেট রয়েছে। কালোবাজারেও চোরাই জ্বালানির একটি অংশ নিয়ন্ত্রিত হয়। কালোবাজারিদের সাথে বিপণন কোম্পানিগুলোর কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে। বেশি দামের অকটেন পেট্রোলের সাথে কম দামের কেরোসিন মিশিয়ে বিক্রির অভিযোগও পুরনো।
এদিকে দৈনিক আজাদীর হাতে আসা ১১ নভেম্বর বিপিসি সচিব মো. লাল হোসেন স্বাক্ষরিত মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে দেওয়া পত্রে (সূত্র- ২৮.০৩.০০০০.০০৮.৩৪.০০২.১০.১১৩৮) উল্লেখ করা হয়েছে, গত ২১ সেপ্টেম্বর বিপিসির অনুসন্ধানী টিম গোদনাইল ও ফতুল্লা ডিপো পরিদর্শন করে অকটেন, পেট্রোল ও ডিজেলের নমুনা সংগ্রহ করে। ইআরএলের (ইস্টার্ন রিফারিইনারি লি.) ল্যাবে পরীক্ষা করে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের গোদনাইল ডিপোতে অকটেনের আরওএন ৯১.৭, পেট্রোলের আরওএন ৮৭, ফতুল্লা ডিপোতে অকটেনের আরওএন ৯৩.২ এবং পেট্রোলের আরওএন মান ৮২ পাওয়া যায়, যা বিএসটিআই নির্ধারিত মানের চেয়ে কম। পত্রের আরেক অংশে উল্লেখ করা হয়, মানহীন অকটেন ও পেট্রোল পাওয়া অনাকাক্সিক্ষত, যা সরকারি আদেশ ভঙ্গের সামিল। বিএসটিআই নির্ধারিত মানের চেয়ে নিম্নমানের অকটেন ও পেট্রোল মজুদ রাখার বিষয়ে প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মতামত চাওয়া হয় ওই চিঠিতে।
বিপণন কোম্পানিগুলোর ডিপো পরিদর্শন করা বিপিসির উপ-মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) মোরশেদ হোসেন আজাদ গতকাল সন্ধ্যায় আজাদীকে বলেন, আমি চারটি ডিপো ভিজিট করে আরওএন মান কম পেয়েছি। আমার কর্তৃপক্ষ বরাবরে প্রতিবেদন দিয়েছি। প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে অনুশাসন দিয়েছে।
বিপিসির পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) সৈয়দ মেহদী হাসান আজাদীকে বলেন, পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েলের কয়েকটি ডিপো ভিজিট করে বিপিসির আকস্মিক তদন্ত টিম। ডিপোগুলোতে পরীক্ষা করে মানহীন পেট্রোল, অকটেন পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে বিপিসির পক্ষ থেকে চার ডিপো ইনচার্জকে শো’কজ করা হয়েছে। ওই শো’কজে তিন বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েলের এমডিদের (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) মতামত চাওয়া হয়েছে।
এদিকে বিপিসির পক্ষ থেকে সরাসরি ডিপো ইনচার্জদের শো’কজ করার বিষয়ে বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলোতে অসন্তোষ তৈরির খবর পাওয়া গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা বিপিসির নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হলেও আলাদা আলাদা নিবন্ধিত কোম্পানি। মানহীন জ্বালানি সরবরাহ কাম্য নয়। পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছে মানহীন জ্বালানি পাওয়ার বিষয়ে বিপিসি জানতে পারে। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দিতে পারে। কিন্তু সরাসরি কোম্পানির কর্মকর্তাদের শো’কজ করা আইনসিদ্ধ নয়।
জানতে চাইলে বিপিসির সচিব মো. লাল হোসেন আজাদীকে বলেন, কয়েকজন ডিপো ইনচার্জকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আমি দাপ্তারিক কাজে ঢাকায় আছি। চিঠিতে কী লেখা আছে তা না দেখে বলা সম্ভব নয়।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে বছরে দেশে পেট্রোলিয়াম জ্বালানির চাহিদা রয়েছে ৬৫ লাখ টনের অধিক। বাজারে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি লিটার অকটেন ৮৯ টাকা, পেট্রোল ৮৬ টাকা, ডিজেল ও কেরোসিন ৬৫ টাকা বিক্রি হয়।