বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও পরিবেশ মেলা ২০২৫ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় বলেছেন, ‘প্লাস্টিক পরিবেশের বিষ। এটা কেবল মানুষ নয়, পৃথিবীর সব প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর, যার জন্ম আছে, মৃত্যু নেই। প্লাস্টিক আমাদের ধ্বংস করে দেবে’। দূষণ রোধে শুধু পলিথিন বর্জন নয়, পলিথিন উৎপাদন বন্ধ করা প্রয়োজন। প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় আরও উল্লেখ করেন যে, গোড়াতে যদি উৎপাদন বন্ধ করতে পারি, তাহলে পলিথিন বর্জনের বিষয়টা আর থাকে না। পলিথিন ছাড়া পৃথিবী অচল নয় বলেও মন্তব্য করেন’। আমি স্যারের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনি কিন্তু প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্যারের বক্তব্যগুলো আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি নিজেও একজন কেনেডিয়ার নাগরিক, দীর্ঘ সময় পৃথিবীর কয়েকটি দেশে লেখাপড়া ও বসবাস করার সুযোগ হয়েছে। একটা শহরকে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখতে পলিথিন ব্যবহারের কোন বিকল্প নেই। উন্নত দেশগুলোতে পলিথিন ব্যাগের মাধ্যমে পচনশীল এবং অপচনশীল সব রকমের বর্জ্যকে আলাদা করে সিটি কর্পোরেশনের কর্মীদের হাতে নির্দিষ্ট দিনে, সঠিক সময়ে তুলে দেয়, বা বাড়ির সামনে নির্দিষ্ট প্লাস্টিকের পাত্রে রেখে দেয়। ময়লাগুলো পৃথক করে নির্দিষ্ট রঙের পলিথিনে বা পাত্রে না রাখলে পরিচ্ছন্ন কর্মীগণ সংগ্রহ করে না। তুলনামূলকভাবে উন্নত দেশগুলোতে পলিথিনের ব্যবহার আমাদের চেয়ে অনেক বেশি কিন্তু তারা নিয়ম–কানুন মেনে বর্জ্যগুলো নিষ্পত্তি করে বলে দূষণ আমাদের তুলনায় কম।
তথ্য অনুযায়ী, ১৯০৭ সালে লিও বেকল্যান্ড প্লাস্টিক আবিষ্কার করলেও ১৯৫৮ সালের পর থেকে পৃথিবীব্যাপী তার ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে তার বাজারজাতকরণ শুরু হয় ১৯৮২ সালে। প্রাকৃতিক উপায়ে মানুষের ব্যবহৃত পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের পুরোপুরি রূপান্তর হতে ৪০০–১০০০ বছর লাগে। আসলে ওরা পচে না, জীবাণু দ্বারা বিস্লেষিত হয় না, ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরায় পরিণত হয়, যাদের নাম মাইক্রোপ্লাস্টিক যা মানব স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। প্লাস্টিকের কণাগুলো দীর্ঘ সময় প্রকৃতিতে অবস্থান করে, যাদের অস্তিত্বের কোন বিলীন হয় না, তাই আমাদের প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় বলেছেন ‘প্লাস্টিকের জন্ম আছে কিন্তু মৃত্যু নেই’।
মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে, যাদের ক্ষয় হতে এত দীর্ঘ সময় লাগে, আমাদের পরিবেশে উক্ত স্বল্প সময়ের (৪৩ বছর) মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণার অস্তিত্ব কীভাবে আসলো, এর পেছনে রয়েছে, শিল্প কারখানা থেকে উৎপাদিত দূষক মিশ্রিত পানি, ব্যবহৃত এসিড, পলিথিন উৎপাদনের কারখানা বা রিসাইক্লিং প্রক্রিয়া এবং প্রসাধনীতে ব্যবহৃত মাইক্রোপ্লাস্টিক। আমাদের দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষের তুলনায় মাথাপিছু গড়ে ৭ গুণ কম কিন্তু প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ১০ নম্বরে।
সমপ্রতি এক গবেষণায় কর্ণফুলী নদীর প্রতি ঘনমিটার পানিতে প্রায় ১৪ থেকে ২৭টি এবং প্রতি কেজি পলিতে ৭৬ থেকে ২৭৩ টি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে (জুঁই এটেল, ২০২৫)। উক্ত গবেষক দলের প্রধান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডঃ শফিকুল ইসলাম উল্লেখ করেন যে, কর্ণফুলীতে বসবাসকারী মাছ, শামুক, কাঁকড়া প্রভৃতি জলজ প্রাণীতেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছে। তিনি প্লাস্টিক বর্জ্য যাতে অবাধে নদীতে গিয়ে পড়তে না পারে তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট মহলকে আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে কর্ণফুলী নদীকে রক্ষা ও প্লাস্টিক দূষণ কমাতে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে শহরের বর্জ্য যাতে কোনোভাবে নদীতে যেতে না পারে তার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এই উদ্যোগের ফলে গত এক বছরের ব্যবধানে ৫২টি এলাকায় জলাবদ্ধতা অনেকাংশে কমেছে। সমপ্রতি ইংল্যান্ডে সফররত অবস্থায় চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বীকৃতি স্বরূপ গত ৯ নভেম্বর, চট্টগ্রাম সমিতি লন্ডন, ডা. শাহাদাতকে ‘লেটার অফ অ্যাপ্রিসিয়েশন’ প্রদান করেন।
প্লাস্টিক আমাদের গ্রহের শত্রু নয় – আমরা কোনভাবেই এটি ছাড়া বাঁচতে পারি না, তার ব্যবহার অত্যন্ত ব্যাপক। কিন্তু প্লাস্টিক দূষণ এবং অপব্যবহারের বিরুদ্ধে আমাদেরকে লড়াই করতে হবে। কিন্তু প্লাস্টিকের উৎপাদন বন্ধ করে দিলে বা একক প্লাস্টিকের উপরে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলো যেমন খাদ্য উৎপাদন সামগ্রী, পরিবহন, সংরক্ষণ, জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং ব্যবহারের স্থানে জীবাণুমুক্ত থাকার জন্য পলিথিন এবং প্লাস্টিকের প্যাকেজিংয়ের কাজগুলো দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের মতো, প্লাস্টিক শিল্পও দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং বহু মানুষের জীবিকার উৎস, সেগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। প্লাস্টিক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ১২তম এবং ১২৬ টি দেশে আমাদের এই পণ্যের বাজার রয়েছে। আমাদের সরকারেরও লক্ষ্য, ২০৩০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক এবং প্যাকেজিং শিল্পের বাজার ২০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত করা।
প্লাস্টিক দূষণ কমাতে আমাদের করণীয়: ১. শহর এবং গ্রামগঞ্জে নির্বাচন প্রচারণায় প্রচুর পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয় যা পরিবেশের জন্য হুমকি স্বরূপ। গত ২৯ শে মার্চ ২০২৫ (ঢাকা প্রকাশ ডেক্স) নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনে প্রার্থীর প্রচারে পোস্টার রাখছেন না, শুধু কাপড়ের ব্যানার ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছেন। লিফলেট ও হ্যান্ডবিল প্রচার পত্রে পলিথিনের আবরণ বা প্লাস্টিক ব্যানার (পিভিসি) লেমিনেটিং করা যাবে না। তাছাড়া, বাংলাদেশ সরকার ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর থেকে যে ১৭ ধরনের সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক সামগ্রীকে নিষিদ্ধ করেছেন ঐ তালিকায়ও প্লাস্টিকের দাওয়াত কার্ড ও ব্যানারের কথা উল্লেখ আছে। বাস্তবে এই আইনের দরকার কেউ করছে বলে মনে হচ্ছে না। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অনেক জায়গায় ছেয়ে গেছে নিষিদ্ধ পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার, আর ডিজিটাল পিভিসি ব্যানার। নির্বাচন কমিশনের পরামর্শ অনুযায়ী, ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়ায় হাতের লেখা কিংবা কাপড়ের তৈরি ব্যানার খুব একটা চোখে পড়ছে না। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। নইলে প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করা যাবে না। আশা করি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দগণ দেশের স্বার্থে চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলমের নির্বাচনী প্রচারণার কৌশলটি অবলম্বন করবেন। তিনি পরিবেশকে ভালোবেসে নির্বাচনী প্রচারণায় হাতের লেখা কাপড়ের ব্যানার ব্যবহার করে মানুষের মন জয় করেছিলেন। এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামও এ ব্যাপারে খুব সোচ্চার, গত কয়েক বছর যাবত পরিবেশ দিবসের অনুষ্ঠানগুলোতে কোন প্লাস্টিকের ব্যানার ব্যবহার না করে কাপড় ও পাটের চটে হাতে লেখা ব্যানার করে আসছেন।
২. সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের পরিবর্তে পুনর্ব্যবহারযোগ্য বিকল্পগুলো জনগণের জন্য সহজলভ্য করা, যেমন: নন–ওভেন পলিপ্রোপিলিন: একটি খুব সাধারণ এবং সাশ্রয়ী মূল্যের বিকল্প, এই ব্যাগগুলি হালকা এবং টেকসই। পাট: একটি শক্তিশালী, প্রাকৃতিক আঁশযুক্ত, পাটের ব্যাগ খুবই টেকসই। শণ: আরেকটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক আঁশ। শণ প্রায়শই টেক্সটাইল এবং শিল্প ব্যবহারের জন্য ব্যবহৃত হয়। ৩. পুনর্ব্যবহৃত পিইটি: পুনর্ব্যবহৃত প্লাসটিক পুনরায় ব্যবহারের একটি উপায় বাহির করা। ৪. পাটজাত পণ্য, কাগজ, কাপড়, বাঁশ বা অন্যান্য পরিবেশবান্ধব পণ্যে ভর্তুকি বা কর ছাড় দেওয়া।
৫. প্লাস্টিকের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার জন্য প্লাস্টিক পণ্যের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করা। ৬. ৫৫ মাইক্রনের চেয়ে পুরু ব্যাগের ওপর বাধ্যতামূলক ফি আরোপ করা এবং ৫৫ মাইক্রনের চেয়ে কম পুরুত্বের ব্যাগ নিষিদ্ধ করা। ৭. রপ্তানির জন্য তৈরি হলে, পলিথিন শিটের গায়ে শুধু রপ্তানির কাজে ব্যবহৃত হবে লিখে রাখা। ৮. নিষিদ্ধ একক ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিক্রেতা ও ক্রেতা উভয়কেই জরিমানার আওতায় নিয়ে আসা। ৯. ভারত ও জার্মানির অনুকরণে প্লাস্টিক বর্জ্য রাস্তায় ব্যবহার করা। ১০. অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মতো প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে তেল উৎপাদন করা।
১১. প্লাস্টিকের দূষণ রোধে টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পরিবেশ বার্তা, কর্মশালা ও র্যালির ব্যবস্থা করে জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করা। ১২. টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সরকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়েবের পরামর্শ অনুযায়ী বর্জ্যকে প্রাথমিকভাবে পচনশীল এবং অপচনশীল এই দুইটি ভাগে বিভক্ত করে জৈব সার ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। আমার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই (মাছির) ব্যবহারের মাধ্যমে পচনশীল বর্জ্য থেকে (এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন, চট্টগ্রাম, বিএসএফ মডেলের আদলে) জৈব সারসহ উচ্চ মানের প্রোটিন সমৃদ্ধ হাঁস– মুরগি ও মাছের খাবার তৈরি করা, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও জলাবদ্ধ নিরসনে ভূমিকা রাখবে। বিশ্বের অনেক দেশ পরিবেশ বান্ধব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও সার্কুলার অর্থনীতির লক্ষে ব্ল্যাক সোলজার ফ্রাইয়ের কৌশল ব্যবহার করছে। উক্ত প্রযুক্তি বাস্তবায়নের জন্য দরকার একটা পরিত্যক্ত জায়গা, পচনশীল আবর্জনা ও প্রয়োজনীয় কিছু কিছু সরঞ্জাম, যা বাস্তবায়নের সক্ষমতা চট্টগ্রামের সিটি কর্পোরেশনের আছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ পড়তে পারেন।
সবশেষে প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণে প্লাস্টিকের বিকল্প তৈরি, শক্তিশালী নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের জন্য সর্বস্তরের জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাই।
লেখক : প্রফেসর, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।











