সুদীর্ঘ একুশ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে, নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করে লড়াই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সকল ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করে ১৯৯৬ সালে জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসীন হন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামিলীগ। দেশ তখন অর্থনৈতিকভাবে ছিল পর্যুদস্ত, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের বিপরীতে ধাবিত। শহিদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে গণ আদালতের ২৪ বিশিষ্ট নাগরিকের বিরুদ্ধে তখন রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা।
এই মামলা মাথায় নিয়ে বীর জননী জাহানারা ইমাম প্রয়াত হন। এই প্রতিকূল পরিবেশে বাংলাদেশের মানুষের আশার প্রতীক হয়ে উঠলেন শেখ হাসিনা। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষামুখী অর্থনীতি, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে হাল ধরলেন তিনি। ১৯৯৬–২০০১ এই পাঁচ বছরে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের মাধ্যমে তিনি দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হলেন। ২০০১ সালে আবার হোঁচট খেলেন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কাছে। অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া, জননেতা আহসানউল্লাহ মাস্টার সহ দলের অসংখ্য নেতা কর্মী হারাতে হয় তাঁকে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তাঁকে প্রকাশ্যে গ্রেনেড মেরে হত্যা করার অপচেষ্টা করা হয়।
হারাতে হয় আইভী রহমানসহ দলের অনেক নেতা কর্মীকে। জর্জ মিয়া নাটক সাজানো হয়। আসে ১/১১ এর নতুন ষড়যন্ত্র। সব ষড়যন্ত্রের মূল উপড়ে ফেলে ২০০৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় সংসদের দুই তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করে তিনি সরকার গঠন করেন। শুরু হয় দিনবদলের অবিরত স্বপ্নযাত্রা বাস্তবায়নের পালা।
২০১৬ সালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী নিম্ন মধ্যম আয়ের অর্থনীতির দেশের বছরে মাথাপিছু জাতীয়আয়ের পরিমাণ হতে হবে ১০২৫– ৪০৩৫ ডলার। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৬ অনুযায়ী ২০১৫–২০১৬ অর্থ বছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল ১৪৬৬ মার্কিন ডলার। ফলে বিশ্বব্যাংকের তালিকাভূক্ত ৫১ টি নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ এর তালিকায় বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত ও ক্রমবর্ধমান অগ্রগতির জন্য শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রশংসিত হয়েছেন।
পরিণত হয়েছেন প্রথম সারির বিশ্বনেতা। যার ফলশ্রুতিতে তিনি অর্জন করেছেন ‘সাউথ সাউথ এওয়ার্ড’ নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার, ক্ষুধার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য FAO এর ‘CERS’, শ্রেষ্ঠ টিকা প্রদান কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য এধার Gavi Alliance ‘স্বীকৃতি, লাভ করেছেন’ মাদার তেরেসা লাইফটাইম এচিভমেন্ট এওয়ার্ড ‘ইউনেস্কো পিস প্রাইজ’, ‘ইন্দিরা গান্ধী পিস প্রাইজ’ ‘রোটারী পিস প্রাজ, নারীর ক্ষমতায়নে অসামান্য অবদানের জন্য জাতসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউএন উইমেন’ প্ল্যানেট ৫০– ৫০ ‘পুরস্কার, তৃণমূল পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তি প্রসার, সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা চালু, সাধারণের মাঝে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়া সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার এর জন্য জাতিসংঘের ‘সাউথ সাউথ ভিশনারি’ পুরস্কার, জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মান ‘চ্যাম্পিয়ন অফ দ্যা আর্থ ২০১৫, শিশু মৃত্যু হার ৫০ ভাগ কমিয়ে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য জাতিসংঘ পুরস্কার ২০১০ সহ অসংখ্য পুরস্কার। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করেছেন, শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে রক্ষা করেছেন। নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্যার জিম বলজার বলেছেন ‘শেখ হাসিনা তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্ব প্রদর্শনের মাধ্যমে এমডিজির লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশকে সক্ষম করেছেন এবং অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে পৃথিবীতে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন’।
কোভিড ১৯ বৈশ্বিক মহামারীতে বিশ্ব নেতৃত্ব যখন দিশেহারা ঠিক সেইসময় দূরদর্শীতার পরিচয় রেখেছিলেন শেখ হাসিনা।একদিকে লকডাউনেও পোশাক শিল্পকে বিশেষ ব্যবস্থায় চালু রেখে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছিলেন, করোনার সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলায় শিল্প কারখানায় নিয়োজিত জনবলকে কাজে বহাল, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যেক্তাদের সক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখার প্রয়োজনে মে ২০২০ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন অন্যদিকে করোনার প্রতিষেধক গবেষণার সময়েই ভ্যাক্সিন এর জন্য আগাম অর্থ বরাদ্দ রেখেছিলেন বলেই দেশের সব মানুষই বিনামূল্যে টিকা পেয়েছেন, ফলে সফলভাবে করোনা মোকাবেলা করার কারণে তিনি বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কাছে সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন।
শুধু কি তাই? শেখ হাসিনার সুদৃঢ় নেতৃত্বের কারণে করোনা মোকাবেলায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশের মধ্যে শীর্ষ এবং বিশ্বের মধ্যে ২০তম দেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে বাংলাদেশ। করোনাকালে বাঘা বাঘা রাষ্ট্রগুলো যখন প্রকল্পের গতি ধীর করে দিয়েছিল ঠিক সেই সময়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ ও বঙ্গবন্ধু টানেল এর নির্মাণ কাজ অমিত সাহসে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। পদ্মা সেতু এখন স্বপ্ন নয় বাস্তব। জানুয়ারি ২০২৩ সালে চট্টগ্রামের মানুষ দেখবে আরেক বাস্তবতা, ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ এর বঙ্গবন্ধু টানেল।
২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস দিয়েছে জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংক। এই কথাটিই বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়ে সর্বক্ষেত্রে সাশ্রয়ী ও খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর আহবান জানিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। তাঁর এই আহবান সতর্কবাণী কিন্ত দুর্মুখেরা এর উল্টো বিশ্লেষণ করছেন। শুরু থেকেই তিনি আগাম পদক্ষেপ নিয়েছেন।
সরকারি কর্মকর্তাদের খুব প্রয়োজন ব্যতিরেকে বিদেশ সফর স্থগিত করেছেন। বিদ্যুৎ সাশ্রয় এর জন্য অফিস সময় পরিবর্তন করেছেন। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দাক্রান্ত সময়ে বাংলাদেশ আই এম এফ এর কাছ থেকে ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা পাচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংক, এডিবি, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা থেকে সহজেই ঋণ পাবে যা সংকটকালীন সময়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। অবৈধভাবে পাচারকৃত দেশীয় অর্থ ফেরত আনতে ইতিমধ্যে সরকার ৮ টি দেশের সাথে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, দেশে দুইটি নতুন বিভাগ চালু প্রকল্প স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।
শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে বিশ্বমন্দার দুঃসময়ে বাংলাদেশ লড়াই করছে, আবার এগিয়েও যাচ্ছে, যেই কারণে তিনি দেদীপ্যমান বিশ্বনেতা। এই প্রতিকূল অবস্থা পাড়ি দিতে জনগণকেও সাশ্রয়ী হতে হবে।
চট্টগ্রামসহ সারা দেশে হাজার হাজার বরযাত্রী সমৃদ্ধ বিয়ের অনুষ্ঠান বন্ধ করে অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইন চালু করা এখন সময়ের প্রয়োজন।
লেখক : ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক