দেখি বাংলার মুখ : শফিক হাসানের ভ্রমণগ্রন্থ

আরিয়ান তূর্য | সোমবার , ২৪ মার্চ, ২০২৫ at ৬:২৯ পূর্বাহ্ণ

প্রত্যেক মানুষ নিজের দৃষ্টি দিয়েই দেখেন। কেউ কেউ দেখার সঙ্গে যুক্ত করেন অন্তর্দৃষ্টিও। একেকজনের বাংলার মুখ দেখার পদ্ধতি হয়তো ভিন্ন রকমের। শফিক হাসান উল্লিখিত দুই পদ্ধতিতেই দেখেন তার চিরচেনা কিংবা অচেনা বাংলাদেশকে। অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার ভ্রমণগ্রন্থ ‘দেখি বাংলার মুখ’। এতে রয়েছে ১৫টি ভ্রমণকাহিনী। স্থান পেয়েছে দেশের নানা প্রান্তে ছুটে বেড়ানোর গল্প। ভ্রমণকাহিনীগুলোর শিরোনামে চোখ বোলালেই বোঝা যাবে কেমন মালা গেঁথেছেন তরুণ এই লেখক।

বইয়ের শুরুতেই রয়েছে বড় পরিসরের ভ্রমণবৃত্তান্ত ‘বৃষ্টিভেজা নড়াইল, পল্লীকবির বাড়ি ও ঝিনাইদহের গল্প’। বৃহৎ পরিসরের আরও দুটি ভ্রমণগল্প হচ্ছে– ‘রঙ্গরসের রংপুরে কিছু আলো, কিছুটা অন্ধকারে’, ‘পুণ্ড্রনগরের পথেঘাটে, পুরাতত্ত্ব ও মিথের জাদু’। অন্য ভ্রমণকাহিনীগুলোর বিষয়বস্তুও শিরোনাম থেকেই অনুমেয়লালন ফকির ও রবীন্দ্রনাথ ভূমিতালাশে, কেওক্রাডং চূড়ায় উচ্চতার মেলায়, নদী পেরিয়ে বরিশালে, গীতিকার দেশে, শেকড়ের সন্ধানে মুজিবনগরে, কক্সবাজারে সমুদ্রভোজনে, স্মৃতি বিস্মৃতির চট্টগ্রামে, মাদারীপুরের স্বর্ণরেণু, তূর্ণা নিশিথায় নিশিযাপন, হাতিরঝিল ভেসে যায় জলজোছনায়, কাহারোলে অন্য রোল, ঝিম সবুজের হাতছানি দেয় শ্রীময়ী সিলেট ও শ্রীমঙ্গল।

ভ্রমণকাহিনী লেখার নেপথ্য সংযোগসূত্র উল্লেখ করে শফিক হাসান বলেন, ‘লোকে যেটাকে ভ্রমণকাহিনী বলে আখ্যায়িত করে, আমি বড়জোর সেটাকে ভ্রমণগদ্য নাম দিতে পারি! তবে বোঝা ও বোঝানোর সুবিধার্থে অধিকাংশ সময়ে ভ্রমণকাহিনীই উচ্চারণ করতে হয়। আমার ভ্রমণগদ্যে আর যাই থাকুক, ‘কাহিনী’ থাকে কম। এমনটাই ধারণা নিজের। আদতে কাহিনীকে ফেনিয়ে তোলার দক্ষতা বরাবরই কম। ভ্রমণ করা হয়তো সহজ কিন্তু কাহিনী বর্ণনা দুরূহ। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়াকতকিছুই! না সবুজ ঘাস, না শিশিরবিন্দু নামক টলমলে জল। এই অনেককিছু দেখতে না পারার আক্ষেপ কি কখনো ঘুচবে! সব ভোরই সমান, কিন্তু নতুন কোনো জায়গায় ভোর দেখার আনন্দ অন্যকিছুতে পাই না। চেনা পরিপার্শ্বের বাইরে এসে ভোর হয়ে সকাল ফোটার আনন্দ অনুভব সহজসাধ্য বিষয় নয়, অন্তত আমার পক্ষে। কত প্রতিবন্ধকতা চারদিকে!’

ভ্রমণে মূলত কী খোঁজেন, কেন ভ্রমণ করেন? জানতে চাইলে সৌন্দর্যবুভুক্ষু এই লেখক বলেন, ‘অদেখা সুন্দর ছাড়া আর কী খুঁজব ঘরের বাইরে গিয়ে! শস্যবতী ধানখেতে দোলা দেওয়া বাতাস, নীরবে ফুটে থাকা নাম না জানা ফুল, জলাশয়ে হাঁসের অবাধ সন্তরণ, গাছের ডালে মাছরাঙার ধ্যানীশিকারি দৃষ্টি, পাখির কিচিরমিচির, গৃহস্থের পোষা গবাদি পশুপাখির চাঞ্চল্য, হরেক রকম পাখপাখালির কূজনসর্বোপরি বিশাল বাংলার সবুজ শ্যামলিমা আমাকে বিস্ময়বিমূঢ় করে রাখে। দেখা বস্তু বারবার দেখেও মুগ্ধ হওয়ার বিরল গুণ বোধকরি রপ্ত করে ফেলেছি।’

ভ্রমণের অতুল আনন্দের কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘ভ্রমণে কী দেখি? ঐতিহ্যবাহী স্থান, প্রত্নপ্রাচীন নিদর্শন, সহজিয়া বাংলার অতুল সৌন্দর্যই তো! এর সঙ্গে বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদ চেখে দেখা, স্থানীয় কৃষ্টিসংস্কৃতি অবলোকন, জীবনাচার পর্যবেক্ষণআর দেখি মানুষ। একেকটি মানুষ মূলত পৃথক পৃথিবীসমতুল্য। অসংখ্য গল্পের আধার। কবিতার আলোকবিন্দু। প্রবন্ধের শাণিত খসড়া। নাটকের মঞ্চ। চলচ্চিত্রের কান্নাহাসি ভেদ করে হঠাৎ অবিশ্বাস্য রকমের কিছু একটা!’

ভ্রমণে বড় কোনো প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয়নি কখনো জানিয়ে ভ্রমণপিয়াসী এই লেখক বলেন, ‘জীবনের সঙ্গে লড়াইয়ের মাঠে মানুষ বরাবরই স্বতন্ত্র, একা। এই বিশ্বপ্রতিবিম্ব উপলব্ধির চেষ্টা করি। এটাও আবিষ্কার করি, যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী অতিথি আপ্যায়নের কী চূড়ান্ত নজিরইনা স্থাপন করেন রূপসী বাংলার ততোধিক সুন্দর মানুষ! পরোপকারি মনোভাবজনিত সহযোগিতা ও আতিথ্যের তুলনা হয় না। অল্পবিস্তর নেতিবাচক ঘটনা যে ঘটে না, তাও কিন্তু নয়! এসবই দেখি, উপলব্ধি করি; জাগিয়ে ও ভাসিয়ে রাখি নিজেকে। চিহ্নিত করে চলি স্বদেশসমকালের যাপনচিত্র। আর বুকভরে টেনে নিই নতুন বাতাস, বৈচিত্র্যপূর্ণ নবীন আলোজল।’

লেখক জানান, বইটিতে স্থান পাওয়া কোনো কোনো ভ্রমণকাহিনী বর্তমান সময়ে লেখা হলেও অধিকাংশই দশ থেকে পনেরো বছর আগের। আবার একাধিকবার গিয়েছেন এমন জায়গাও আছে। লেখাগুলো প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। সেই সময়টাকে ফ্রেমবন্দি করে রাখবেন বলে ‘হালনাগাদ’ করেননি। তাই কোনো কোনো বর্ণনা ও ঘটনা ওই সময়ের চোখ দিয়েই পড়তে হবে, বুঝতে হবে।

পাঠক প্রতিক্রিয়া আপাতত ভালোই। এই ভ্রমণবইয়ে পাঠক বাংলাদেশকে কতটুকু দেখতে সমর্থ হবেন, জানা নেই। কতটুকু আনন্দিত বা ব্যথিত হবেন, তাও তো বোঝার উপায় নেই লেখকের পক্ষে! তবে ইতিবাচক সাড়া পেলে শীঘ্রই দ্বিতীয় ভ্রমণগ্রন্থ লেখায় হাত দেবেন শফিক হাসান।

দেখি বাংলার মুখ বইটির প্রকাশক অনুপ্রাণন প্রকাশন। অমর একুশে বইমেলায় স্টল নম্বর : ৬৯৫৬৯৬৬৯৭।

১৪৪ পৃষ্ঠার (৯ ফর্মা) এই বইয়ের চমৎকার প্রচ্ছদটি এঁকেছেন আইয়ুব আল আমিন। মুদ্রিত মূল্য : ৪০০ টাকা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধপাহাড়ঘেরা শীতল স্বচ্ছ পানির ফয়’স লেক