প্রকৃতির ও সৌন্দর্য্যের রানী চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করে আলোকিত হয়েছেন ইতিহাসের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরী সে ক্ষণজন্মার বিখ্যাত আলোকিত ব্যক্তিত্বের অন্যতম। চট্টগ্রাম শহর হতে প্রায় আট মাইল উত্তরে সমুদ্র উপকূল হতে পূর্বে পাহাড় শৈলী পর্যন্ত বিস্তৃত ভাটিয়ারী গ্রাম এবং সমুদ্র উপকূলের ধার ঘেষে বেড়ে উঠা জনপদ সিতাকুণ্ড পর্যন্ত বিস্তৃত। বঙ্গোপসাগর বিধোত অপূর্ব সুন্দর জনপদ সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাটের ভাটিয়ারীর সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে ১৪ জুন ১৯০২ সালে ইমাম হোসেন চৌধুরীর জন্ম। পিতা এলাকার স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব খ্যাতনামা জমিদার রাজা মিয়া চৌধুরী পিতা–মাতার আলোকিত ঘরের দ্বিতীয় সন্তান তিনি।
স্থানীয় স্কুলে লেখাপড়ার হাতেখড়ি। পরবর্তীতে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা ক্ষেত্রে বিপ্লব সৃষ্টিকারী ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল হতে ১৯২১ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। স্বাভাবিক এ ঐতিহ্যবাহি স্কুলের ছাত্র হওয়ার সুবাদে আমি নিজেকে গৌরবাম্বিত বোধ করি। ১৯২৩ সালে চট্টগ্রামের আরেক ঐতিহ্যবাহি কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ হতে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন। ১৯২৬ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ হতে বি.এ অনার্স সহ এম.এ পাস করেন।
অতঃপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৩০ সালে আইন পরীক্ষায় মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে প্রথম স্থান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার্থীদের মধ্যে চতুর্থ স্থান অধিকার করে রেকর্ড সৃষ্টি করে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। আইন পরীক্ষায় পাস করার পর ১৯৩০ সালের ১ সেপ্টেম্বর ইমাম হোসেন চৌধুরী কলকাতা হাইকোর্টে ্আইন পেশায় যোগ দেন।
কলকাতায় অবস্থানকালীন সময়ে ১৯৪৩ সালে ‘আইএলআর’ এর ল রিপোর্টার এবং ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমে কলকাতা হাইকোর্টের অ্যাসিস্টা্যান্ট গভর্নমেন্ট প্লিডার ও পরে সিনিয়র গভর্নমেন্ট প্লিডার (এজিপি) হিসেবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত–পাকিস্তান দেশভাগের পর ইমাম হোসেন চৌধুরী নিজ জন্মস্থান প্রিয় জন্মভূমি পূর্ব–পাকিস্তানে চলে আসেন। পূর্ব পাকিস্তানে তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট গভর্নমেন্ট প্লিডার ও পরবর্তীতে সিনিয়র গভর্নমেন্ট প্লিডার (এজিপি) হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫০ সালের নভেম্বর মাসে তিনি কিছু দিনের জন্য পূর্ব–পাকিস্তান সরকারের অ্যাডভোকেট জেনারেল পদে কাজ করেন। আইন পেশায় তাঁর দক্ষতা ও যোগ্যতার বিচারে সরকার পরবর্তীতে ১৯৫০ এর ২৯ নভেম্বর ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি পদে নিয়োগ পান। ঢাকা হাইকোর্টে ১০ বছর দক্ষতা ও সুনামের সাথে বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন। বিচারপতি হিসেবে তিনি কয়েকটি ইতিহাস খ্যাত মামলার রায় প্রদান করেন। যা ইতিহাসে ও আইনের রেফারেন্স হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। রায়গুলোর মধ্যে প্রকাশিত কয়েকটি হলো,
১। State vs. M. Noman 16 DLR (১৯৬৪) (বিখ্যাত আদালত অবমাননা মামলা),
২। Foyzul Aki Khan vs. Commission of Wakf E. Bengal 16 DLR (১৯৬৪),
৩। Mufazal Ahmed vs. Addus Sttar 16 DLR (১৯৬৪) ৯২।
বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালিন সময়ে তিনি যথেষ্ট দক্ষতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেন এবং নিজ কর্মদক্ষতায় ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে ‘দেওয়ানী আইনের যাদুকর’ হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেন এবং কোনো সময়ই রাগ–অনুরাগের বশবর্তী হয়ে আইনকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করেননি।
১৯৬০ খ্রিষ্টাাব্দে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি বিচারপতি মির্জা আলী ইস্পাহানি অবসরে গেলে যোগ্যতার বিচারে বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরীকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরী প্রথম বাঙালি যিনি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন।
কারো দয়ার দান নয়, নিজস্ব মেধা–মননশীলতা ও যোগ্যতার বিচারে সকল প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তিনি এ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
১৯৬১ সালে তিনি সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের সদস্য এবং আইয়ুব খানের শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর লেফটেনেন্ট জেনারেল মুহাম্মদ আজম খান ও গভর্ণর আব্দুল মোনায়েম খানের আইন উপদেষ্টা হিসেবে দক্ষতা ও সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ এর ১৪ জুন বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরী প্রধান বিচারপতি পদ হতে অবসর নেন। ইমাম হোসেন চৌধুরী কখনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। ইমাম হোসেন চৌধুরী সাহসিকতার সহিত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উচ্চসিত প্রশংসা করেন। যে সময়ে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রসংশা করার সাহস করেছিলেন যখন পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর রচনাগুলো হুমকির মূখে ছিল।
নিজ এলাকায় তিনি অসংখ্য জনহিতকর কাজ করেছেন মাদ্রাসা, মসজিদ স্থাপনে ব্যাপকভাবে সহযোগিতা করেছেন। ১৯৩২ সালে চান্দগাঁও এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সমাজসেবী হিসেবে খ্যাত অছি মিয়ার জ্যেষ্ঠ কন্যার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ইমাম হোসেন চৌধুরী। আইনের পেশায় জড়িত থেকেও আইন বিষয়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নিয়মিত প্রবন্ধ ও নিবন্ধ লিখেছেন।
তিনি একজন ক্রিয়াবিদ হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন টেনিস ও ফুটবল খেলোয়ার হিসেবে দক্ষতা ছিল। ১৯৬১ সালে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে ঢাকায় যে তিনটি অনুষ্ঠান হয়েছিল সে সব অনুষ্ঠানের একটি অনুষ্ঠানে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। একজন প্রাজ্ঞ বিচারক ও আলোকজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি সমগ্র পাকিস্তানে সর্বমহলে সমাদৃত হয়েছেন। বাংলা ও বিশেষ করে চট্টগ্রামের সন্তান হিসেবে ও বিচার ব্যবস্থায় কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০০০ সালে চট্টগ্রাম সমিতি বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরীকে চট্টগ্রাম সমিতি পদকে ভূষিত করা হয় (মরণোত্তর)। চট্টগ্রামের সাথে এবং চট্টগ্রাম সমিতির সাথে সম্পর্কের বর্ণনা দিতে গিয়ে ওয়ালী মিঞা মাস্টারের কবিতায় যে পরিচয় পাওয়া যায় তা হলো ‘ইমাম হোসেন চৌধুরী আর একবালুর রহমান সমিতিতে তাঁরা–দোহে সেবার তরে থান।
এছাড়াও সমগ্র পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং আইন পেশায় ও সমাজ সেবায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরীকে মরণোত্তর ‘মহান স্বাধীনতা স্মারক সম্মাননা’ প্রদান করেন।
চট্টগ্রাম তথা বাংলার মহান আলোকজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব দেওয়ানী আইনের জাদুকর প্রথম বাঙালি প্রধান বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরী ২৩ এপ্রিল ১৯৭৮ সালে পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃত্যুতে ফুল কোর্ট রেফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। যা আইনের জগতে এক বিরল সম্মান হিসেবে খ্যাত।
তথ্যসূত্র: ১। চট্টগ্রাম সমিতি–ঢাকা হতে প্রকাশিত শতবর্ষে চট্টগ্রাম সমিতি (১৯১২–২০১১); ২। সুনীতি ভূষণ কানুনগো সম্পাদিত ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম হতে প্রকাশিত ‘চট্টগ্রাম চরিতাবিধান’; ৩। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক প্রদত্ত মহান স্বাধীনতা স্মারক সম্মাননা পদক ২০১৫ উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্যুভেনির; ৪। নাসিরুদ্দিন চৌধুরী সম্পাদিত ‘বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরীর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’; পুস্তক দ্রষ্টব্য।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদক–শিল্পশৈলী।