সেদিন আগুনের গোলার আজব এক রঙের সঙ্গে আশ্চর্য এক সন্ধ্যা নেমেছিল। দেখে তাজ্জব বনে গিয়েছিল দেওবন্দের মানুষগুলো। সূর্যটাকে গনগনে আগুনের গোলার মতো দেখাচ্ছিল। প্রচণ্ড আক্রোশে ফুঁসতে ফুঁসতে তামাম আসমান প্রদক্ষিণ করে সেই গোলা পশ্চিম কোণায় এসে থির হয়েছিল।
আসমানের অমন রঙ ঢঙ কোনোদিন দেখেনি ঐ বৃদ্ধ। আলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কয়েক টুকরা মেঘও চলছিল, যেন ঝাঁকে ঝাঁকে উদভ্রান্ত কালো পাখি ছুটছিল। সেই সময়ে বড় মাঠে দাঁড়িয়ে ছিল বৃদ্ধ। সূর্যের ফুঁসে ওঠা দেখে চামড়া কুঁচকানো কপাল আরও কুঁচকে ওপরে তাকিয়ে সে বিড়বিড় করছিল, ‘আসমান ফুঁইড়া দেও নামতেছে…দেও নামতেছে…।’
শৈশব থেকে দেওর কথা শুনে আসছে বৃদ্ধ। কখনো দেখেনি। তার পূর্বসূরিরা দেখেছে। পাপ টলমল দেওবন্দের মানুষকে নিজের রুদ্রমূর্তি দেখাতে গর্ভেশ্বরী নদীর গর্ভ ফুঁড়ে শত বছরে একবার আবির্ভূত হয় ভয়ালদর্শন সেই দেও। নদীতে প্রলয় তুলে মাছ ধরার নৌকা উল্টে দেয়। মাঠে ঘাটে কর্মমগ্ন মানুষকে নখের ডগা দিয়ে তুলে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখে। তার রূপ যেই মানুষ নিজের চোখে দেখে সে সহ্য করতে পারে না। মুখে ফেনা তুলে অজ্ঞান হয়ে যায়। হুঁশ ফেরে না সহজে। আর যখন তার দিনদুনিয়ার বুঝ ফেরে তখন সে কিছুতেই দেওয়ের রূপের কোনো বর্ণনাই দিতে পারে না।
বৃদ্ধের মনে হচ্ছিল সে জ্ঞান হারাবে। আচমকা দেওবন্দের দেও পানি থেকে কবে কী করে আসমানে উঠল– এই জোড়া প্রশ্ন মনে উঁকি দিতেই কেমন যেন বিকারগ্রস্ত হয়ে উঠেছিল বৃদ্ধ। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার সে করে উঠেছিল, ‘এইটা দেও না…এইটা কেয়ামতের সিলসিলা। ইস্রাফিল শিঙায় ফুঁ দিলো বইলা! পালা পালা…তোরা পালা।’
পালাবার শক্তি ছিল না বৃদ্ধের। ছোটার শক্তিও ছিল না। ধীর পায়ে সে শুধু মাঠ পেরোনোর চেষ্টা করছিল। এই মাঠের দৈর্ঘ্য এতই দীর্ঘ যে পথ ফুরাচ্ছিল না কিছুতেই। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত বৃদ্ধ একবার ওপরে তাকানোর চেষ্টা করছিল। আশায় ছিল সে, যদি কেয়ামতের লক্ষণসমূহ সাত আসমানের উর্ধ্বে উঠে যায়। যদি জমিন, আসমান, পবন ভেদ করে বান্দার আহাজারি তাঁর কাছে পৌঁছে যায়! কিন্তু না, সূর্যের ভঙ্গিমায় কোনো রদবদল ঘটেনি। বরং আলোর ফণা বৃদ্ধের মাথা ছুঁই ছুঁই করছিল।
ভয়ে উর্ধ্বমুখী দৃষ্টি ঝটকায় নিচে নামিয়েছিল সে। নিজেকে প্রশ্ন করছিল, তবে কী সত্যিই মহাপ্রলয় আসন্ন? মনে পড়ে গিয়েছিল তার, অগুনতি বছর ধরে শিঙার ধারক ফেরেশতা ইস্রাফিল মহাপ্রলয়ের অপেক্ষায় আরশের দিকে তাকিয়ে আছেন। অপেক্ষা করছেন, কখন নির্দেশ আসে। পৃথিবী ধ্বংসের বাঁশি বাজাতে যেন কালবিলম্ব না হয় সেই সতর্কতায় তার চোখ দুটি নক্ষত্র গোলকের মতো ঘুরছে তো ঘুরছেই।
কড়া পড়া হাতের তালু মেলে কড় গুনেছিল বৃদ্ধ। দিনটিকে শুক্রবার হিসেবে আবিষ্কার করে পুনর্বার আঁতকে উঠেছিল সে। মহাপ্রলয় ঘটবার দিনই তো এ! কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত চৌদিকে কোনো অপার্থিব আওয়াজ শোনা যায়নি। শিঙার মৃদু বা তীব্র আওয়াজের ঝটকায় দিশেহারা হয়ে মানুষ ছুটতেও শুরু করেনি। তবে কি কেয়ামত নয়, দেওবন্দের দেওই আসছে? গর্ভেশ্বরীর গহীন থেকে উঠে সে সবার অলক্ষ্যে আগেই আসমানে উঠে গিয়েছিল? এখন আসমান কাঁপিয়ে পুনরায় ভূপৃষ্ঠে নামছে?
নানা শঙ্কায় বৃদ্ধ যখন বেতাল, বেদিশ ঠিক তখনই বৃদ্ধকে ধাক্কা দিয়ে দুটো তাগড়া শরীর মাঠের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। পরস্পরকে আগ্রাসী ভঙ্গিতে আক্রমণ করছিল ওরা। ফকফকা মাঠের ওপরে নিজেদের গড়িয়ে মাড়িয়ে যেন কিছু একটা খুঁজছিলও। নিবিড় দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছিল বৃদ্ধ, জানার চেষ্টা করছিল কী খুঁজছে দ’ুজন। বহুক্ষণ পর সে উপলব্ধি করেছিল, ওরা সত্যকে না, শত্রুকে খুঁজছিল। মারামারিরত মানুষ দ’ুজন একবারও চোখ তুলে আসমানের রঙের জোয়ার দেখেনি। একে অন্যের কল্লা নামাতে ব্যস্ত থাকায় দৈত্যাকৃতির সূর্যটাও এদের চোখে পড়ছিল না। আচমকা পাল্টে গিয়েছিল বড় মাঠের দৃশ্যপট। বৃদ্ধ বিমূঢ় হয়ে দেখছিল কী করে শত শত মানুষ ছুটে আসছে মাঠের দিকে। দেখতে দেখতে দেওবন্দের মানুষেরা পরস্পরকে আক্রমণ করতে করতে মাঠের ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। সে এক দেখার মতো দৃশ্য ছিল। আঁচড়ে–কামড়ে একে অন্যকে ঘায়েল করতে চেষ্টারত মানুষেরা অশ্রাব্য খিস্তিও করছিল। কেউ পালাতে চাইলে তাকে পেছন থেকে টেনে ধরছিল। কেউ কেউ হাতে অস্ত্র নিয়ে আগ্রাসী ভঙ্গিতে এগোচ্ছিল। যাকে সামনে পাচ্ছিল তাকেই বধ করছিল।
এসব বিভ্রম না, সত্যি সত্যি ঘটছে বুঝে ওঠার পর বৃদ্ধ ফ্যালফ্যালিয়ে দেখছিল মানুষের আদিমতা, রক্তের জোয়ার। তারপর নিজের অদ্দিষ্টকে দেখবে বলে আসমানের দিকে তাকিয়েছিল। তাকিয়ে সবজান্তা ভঙ্গিতে হেসেছিল সে। যেন সুদূর আকাশের স্লেটে প্রকাশিত ইঙ্গিতের সবটাই এক লহমায় বুঝে গিয়েছিল। বুঝে গিয়েছিল, দেওবন্দের দেও আসলে কে বা কারা। তাই হয়তো দেওবন্দ ধ্বংস হওয়ার মুহূর্তেও দু’ঠোঁটের ওপর রগভাসা ডান হাতের তর্জনি গেঁথে নিয়ে শেষবারের মতো খানিকটা হেসেছিল।