দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার মাধ্যমেই দুর্নীতিকে কমিয়ে আনা সম্ভব

| শনিবার , ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৬:৩৯ পূর্বাহ্ণ

দেশের সরকারি সেবা খাতগুলোর মধ্যে দুর্নীতির শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ঘুষ দেওয়ানেওয়া হয় নোয়াখালীতে। আর সরকারি সেবা নিতে গিয়ে শীর্ষ ধনীরাই সবচেয়ে বেশি ঘুষ দিচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে (সিপিএস) ২০২৫’ এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বিবিএস অডিটোরিয়ামে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। বিবিএস জানায়, গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের ৬৪ জেলার ৪৫ হাজার ৮৮৮টি খানার ১৮ বছর ও তার বেশি বয়সের ৮৪ হাজার ৮০৭ নারীপুরুষ এই জরিপে অংশ নেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিআরটিএতে সেবা নিতে গিয়ে ৬৩ দশমিক ২৯ শতাংশ নাগরিক দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। এর পরেই রয়েছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। যেখানে সেবাগ্রহীতার ৫৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ, পাসপোর্ট অফিসে ৫৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং ভূমি অফিসে ৫৪ দশমিক ৯২ শতাংশ সেবা গ্রহীতা দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৩১ দশমিক ৬৭ শতাংশ নাগরিক গত ১২ মাসে কোনো না কোনো সরকারি সেবা নিতে গিয়ে সরাসরি ঘুষ দিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন।

জরিপের তথ্য বলছে, ঘুষ দেওয়ার মধ্যে পুরুষদের দেওয়ার হার ৩৮ দশমিক ৬২ শতাংশ, নারীদের ২২ দশমিক ৭১ শতাংশ। প্রায় ৯৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ জনগণ ঘুষ হিসেবে ‘টাকা’ দেওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। এক বছরে ঘুষ লেনদেনে শীর্ষে আছে নোয়াখালী জেলা। এই জেলায় সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগকারী নাগরিকদের মধ্যে ৫৭ দশমিক ১৭ শতাংশ ঘুষ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কুমিল্লা জেলা, যেখানে ঘুষ দেওয়ানেওয়ার হার ৫৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এরপর ফরিদপুরে ৫১ দশমিক ৭০ শতাংশ, ভোলায় ৪৯ দশমিক ০১ শতাংশ এবং সিরাজগঞ্জে ৪৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ মানুষ ঘুষ দেন। এসব জেলায় সরকারি সেবা পেতে ঘুষ দেওয়ার হার জাতীয় গড়ের (৩১ দশমিক ৬৭ শতাংশ) চেয়ে অনেক বেশি। জরিপে নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিরাপত্তা, সুশাসন, সরকারি সেবার মান, দুর্নীতি, ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকার এবং বৈষম্য বিষয়ক এসডিজি ১৬ এর ছয়টি সূচকের অগ্রগতি মূল্যায়ন করা হয়েছে। জাতীয়ভাবে, নমুনাভুক্ত খানার মধ্যে গড়ে সদস্য সংখ্যা ৪ জন, যার মধ্যে ৮১ দশমিক ৯৭ শতাংশ পুরুষপ্রধান পরিবার এবং ১৮ দশমিক ০৩ শতাংশ নারীপ্রধান পরিবার।

দুর্নীতিকে যতই আমরা না বলি, ততই যেন আমাদের জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। দুর্নীতি সবাইকে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। দেশে এমন কোনো খাত নেই যেখানে দুর্নীতির অশুভ থাবা প্রভাব বিস্তার করেনি। প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে উঁকি দিচ্ছে, চোখ পাকাচ্ছে। সমাজের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। কেবল অভাবের তাড়নায় মানুষ দুর্নীতি করেএটি সত্য নয়। বিত্তশালী কর্মকর্তা বা ব্যক্তি আরো অর্থ সম্পদের জন্য দুর্নীতি করে। মানুষের মধ্যে নীতিনৈতিকতার ঘাটতি হলেই দুর্নীতি জেঁকে বসে। দুর্নীতির দুষ্টচক্র দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিরাট বাধা হিসাবে কাজ করছে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকর্মচারীদের দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার জন্য সরকার বেতনভাতা বৃদ্ধি করলেও তা না কমে বরং আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী এ কনভেনশন বা সনদে বলা হয়েছে যে, দুর্নীতি সমাজের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করে, গণতান্ত্রিক কাঠামো, নৈতিক মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচারকে ক্ষুণ্ন করে এবং টেকসই উন্নয়ন ও আইনের শাসনকে বিপন্ন করে। সুতরাং এ কনভেনশনকে দক্ষতার সঙ্গে দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রযুক্তিগত সহায়তা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগত দক্ষতা উন্নয়নে সহায়তা করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দুর্নীতি দমনের অভিযানকে সফল করতে হলে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগউদ্যমকে একযোগে কাজে লাগাতে হবে। তবে এই কঠিন লক্ষ্যে সফলতা অর্জনের একটি পূর্বশর্ত হচ্ছে দুর্নীতি সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। যদি সংঘবদ্ধ ও সমন্বিতভাবে দুর্নীতির কদর্য চেহারাকে পরিচিত করে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এবং জনস্বার্থে এর কুফল সম্পর্কে তথা জনসচেতনতা সৃষ্টি করা যায়, তাহলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে।

সাধারণ মানুষের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা তৈরির ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা । তাঁরা বলেন, দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার মাধ্যমেই কেবল দুর্নীতিকে সহনশীল মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিকল্প নেই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে