পর্ব ১০
আজকের দশম পর্বে আমরা জানব এমন দশজন নারীর কথা যারা প্রত্যেকেই তাদের নিজনিজ ক্ষেত্রে অনন্য। তাদের কেউ প্যারাঅলিম্পিয়ান, কেউ রোড ট্রিপার, কেউ প্রকৌশলী, কেউবা অভিনেত্রী কিংবা বন্দী মুক্তির প্রচারক! চলুন তাহলে শুরু করি আজকের পর্ব কলম্বিয়ার জীববিজ্ঞানী ব্রিজিত ব্যাপতিস্তের সাথে।
জীববিজ্ঞানী ব্রিজিত ব্যাপতিস্তে, কলম্বিয়া
জীববিজ্ঞানী ব্রিজিত ব্যাপতিস্তে, জীববৈচিত্র্য এবং লিঙ্গ পরিচয়ের মধ্যেকার সাধারণ প্যাটার্ন খুঁজতে কাজ করে থাকেন। তিনি একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রকৃতি এবং প্রজাতি বিশ্লেষণ করেন, যাতে ‘প্রকৃতি’ ধারণা সমপ্রসারিত করা যায় এবং বাস্তুতন্ত্রকে আরও ভালোভাবে রক্ষা করা যায়। ২০১৮ সালের টেডএঙ আলোচনায় তিনি কলম্বিয়ার জাতীয় গাছ ‘কুইন্দিও মোম পাম’–এর উদাহরণ দিয়েছিলেন, যা জীবনের বিভিন্ন সময়ে পুরুষ থেকে নারী লিঙ্গ পরিবর্তন হওয়ার জন্য পরিচিত। একজন স্বনামধন্য একাডেমিক ব্যাপতিস্তে দশ বছর আলেকজান্ডার ভন হামবোল্ট ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে বোগোতা’র ইউনিভার্সিদাদ ইএএন–এ সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন যেটি টেকসই উদ্যোগে জোর দেয়া একটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
ঐতিহ্য সংরক্ষণ প্রকৌশলী হারবিয়া আল হিমিয়ারি, ইয়েমেন
ইয়েমেনে বছরের পর বছর চলা যুদ্ধে অনেক ঐতিহাসিক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, প্রকৌশলী হারবিয়া আল হিমিয়রি এগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার মিশনে নেমেছেন। জাতিসংঘের সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কোসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে অংশীদার হয়ে, তিনি পুরানো সানার এবং দেশের বিভিন্ন স্থানের কয়েক ডজন আবাসিক এবং ঐতিহ্যবাহী ভবন পুনঃনির্মাণ করেছেন। ইউনেস্কোর ষোল হাজারেরও বেশি সাইটে ক্ষয়ক্ষতির জরিপ করেছে। ঐতিহ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তার কাজ কেবল ঐতিহাসিক সাইটগুলোকেই রক্ষা করেনি বরং অনেকের জীবনমানও উন্নত করেছে। আল হিমিয়ারি স্থানীয় বাসিন্দাদের ঐতিহ্যবাহী নির্মাণশৈলীতে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং তরুণীদের এই শিল্পে অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন।
কৃষক এবং প্রশিক্ষক নাওমি চান্ডা, জাম্বিয়া
একটি প্রশিক্ষণ খামারের কৃষি গাইড হিসেবে নাওমি চান্ডা তার গ্রামবাসীকে এমন পদ্ধতিতে কাজ করতে উৎসাহিত করছেন যা জমিকে যত্নের সাথে সংরক্ষণ করে। তিনি ‘জলবায়ু–স্মার্ট’ দক্ষতার ওপর জোর দেন–যেমন কম পানি ব্যবহারকারী ড্রিপ সেচ, অথবা স্বল্প–সময়ের ফসল চাষ। তার এই কাজে নারীদেরকে জলবায়ু পরিবর্তনের সমাধানের কেন্দ্রে রাখা হয়। মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করা এনজিও ‘ক্যামফেড’–এর সঙ্গে চান্ডা প্রায় দেড়’শ তরুণীকে কৃষি প্রযুক্তিতে মানিয়ে নেওয়া এবং তা জলবায়ু সংকটের মুখে টিকে থাকার উপযোগী করে তোলার প্রশিক্ষণ দেন, বিশেষত জাম্বিয়ার উত্তর–পূর্ব অংশে যেখানে দীর্ঘ খরা এবং ঋতুগত পরিবর্তন ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলেছে।
বন্দি মুক্তি কর্মকাণ্ডের প্রচারক এইনাভ জাংগাউকের, ইসরায়েল
এইনাভ জাংগাউকেরের চব্বিশ বছর বয়সী ছেলে মাতানকে হামাস বাহিনীর আক্রমণে জিম্মি করা হয়। তার ছেলের সঙ্গী ইলানাকে আলাদা করে অপহরণ করা হয়, যাকে পরে বন্দি বিনিময়ের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা হয়। এরপর থেকে, তিনি জিম্মি সংকট নিয়ে অবিরাম সচেতনতা বৃদ্ধি করে চলেছেন, নেতাদের পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানাচ্ছেন এবং জনসাধারণকে প্রতি সপ্তাহে বিক্ষোভে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করছেন। জাংগাউকের ইসরায়েল সরকারের কড়া সমালোচক হয়ে উঠেছেন, যদিও এর আগে তিনি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর শাসক দলের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত করতে একটি অস্ত্রবিরতি চুক্তির দাবি জানাচ্ছেন।
তায়কোয়ান্দো প্যারালিম্পিয়ান জাকিয়া খুদাদাদি, আফগানিস্তান
২০২৪ সালের প্যারিস গেমসে প্যারালিম্পিক শরণার্থী দলের প্রথম সদস্য হিসেবে পদক জিতে ইতিহাস গড়েছেন জাকিয়া খুদাদাদি। এক হাত কনুই থেকে নিচের অংশ ছাড়াই জন্ম নেয়া এই অ্যাথলেট পশ্চিম আফগানিস্তানের হারাতে তার নিজ শহরে একটি গোপন জিমে ১১ বছর বয়সে তায়কোয়ান্দো চর্চা শুরু করেন। ২০২১ সালে তালেবানের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পর টোকিওতে তার প্রথম প্যারালিম্পিকে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক প্যারালিম্পিক কমিটি এবং ফ্রান্সের সহায়তায় তাকে আফগানিস্তান থেকে নিরাপদে সরিয়ে আনা হয় এবং তিনি তালেবান শাসনের পর আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ইভেন্টে অংশ নেওয়া প্রথম আফগান নারী ক্রীড়াবিদ।
স্থপতি লেসলি লোকো, ঘানা/যুক্তরাজ্য
‘স্থাপত্যের গণতান্ত্রায়ণ’ শীর্ষক কাজের জন্য লেসলি লোকো ২০২৪ সালে রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টস–এর স্বর্ণপদক পেয়েছেন। এটি এই ক্ষেত্রে বিশ্বের সর্বোচ্চ পুরস্কারগুলোর একটি। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার পর তিনিই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে এই পুরস্কার পেলেন। তিনি গত দুই দশক ধরে, স্থাপত্য শিল্পে যাদের প্রতিনিধিত্ব কম রয়েছে এমন ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে সমর্থন আদায়ে কাজ করছেন। ঘানার স্কটিশ শিক্ষাবিদ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত প্রথম নারী হিসেবে ভেনিস বিয়েনাল দ্য আর্কিটেকচারের কিউরেটর হয়েছিলেন, যেখানে তিনি ডেকার্বনাইজেশন এবং ডিকলোনাইজেশনের থিমগুলিতে মনোযোগ দিয়েছিলেন। আক্রায় আফ্রিকান ফিউচার ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। স্থাপত্য, জাতিসত্তা ও আত্মপরিচয়ের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে কাজ করে এই প্রতিষ্ঠানটি।
ইহুদি পণ্ডিত শ্যারন ক্লাইনবাম, যুক্তরাষ্ট্র
নিউ ইয়র্কের ইহুদি সমপ্রদায়ের একজন পথিকৃৎ, রাবাই শ্যারন ক্লাইনবাম তিন দশক ধরে এলজিবিটিকিউ অধিকার ও ধর্মের গাটবন্ধনে পরিবর্তন আনার প্রেরণা হয়ে উঠেছেন। ১৯৯২ সালে প্রথম নারী রাবাই হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি এই সমপ্রদায়কে নানা উত্থান–পতনের মধ্য দিয়ে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন–যার মধ্যে রয়েছে নব্বইয়ের দশকের এইডস সংকট। তিনি সমপ্রদায়ের সদস্যদের পরিধি বাড়িয়ে তাতে ট্রান্স এবং নন–বাইনারি ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যা এখন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় এলজিবিটিকিউ সহনশীল সিনাগগ বলে মনে করা হয়। এই বছর অবসর নেওয়া ক্লাইনবাম ছিলেন সামাজিক ন্যায়বিচার প্রকল্পগুলোর প্রধান চালিকাশক্তি এবং প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাকে ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম–এ নিয়োগ দিয়েছিলেন।
রোড ট্রিপার ও ইনফ্লুয়েন্সার সু মিন, চীন
৫৬ বছর বয়সে, অসুখী দাম্পত্য থেকে মুক্তি পেতে সু মিন একটি গাড়ি, একটি তাঁবু নিয়ে নিজের পেনশনের টাকায় একাই চীন ভ্রমণে বের হন। ২০২০ সাল থেকে সেই ভ্রমণ তাকে ২০টিরও বেশি প্রদেশের ১০০টিরও বেশি শহরে নিয়ে গেছে। তিনি তার পুরো যাত্রা নথিভুক্ত করেছেন এবং তার গল্প সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনার ঝড় তুলেছে। কারণ তিনি অন্য মধ্যবয়সী নারী, যাদের প্রায়ই ‘আন্টি’ বলে ডাকা হয়, তাদেরকে বিদ্যমান সামাজিক নিয়ম ভাঙার সাহস দেখিয়ে অনুপ্রাণিত করেছেন। বর্তমানে, তার সোশ্যাল মিডিয় প্ল্যাটফর্মগুলিতে ষাট লাখ অনুসারী রয়েছে এবং তার জীবন নিয়ে একটি চলচ্চিত্র–লাইক আ রোলিং স্টোন– এই বছর মুক্তি পেয়েছে।
অভিনেত্রী শ্যারন স্টোন, যুক্তরাষ্ট্র
হলিউড তারকা শ্যারন স্টোন গত তিন দশক ধরে রূপালী পর্দা ও পর্দার বাইরে সক্রিয় আছেন। এই অভিনেত্রী নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে ‘বেসিক ইনস্টিংক্ট’ সিনেমার মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করেন এবং ‘টোটাল রিকল’, ‘ক্যাসিনো’–এর মতো ব্লকবাস্টার সিনেমায় অভিনয় করেন, যার জন্য তিনি গোল্ডেন গ্লোব জিতেছিলেন এবং অস্কারের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তার সমৃদ্ধ অভিনয় জীবনের পাশাপাশি, স্টোন অনেক বিষয়ের সমর্থনে দাতব্য কাজ করেছেন। তিনি এইচআইভি রোগীদের সহায়তায় তার কাজের জন্য নোবেল লরিয়েটদের কাছ থেকে পিস সামিট এওয়ার্ড পেয়েছেন। এ বছর প্রথম গোল্ডেন গ্লোব ইন্টারন্যাশনাল আইকন এওয়ার্ড দিয়ে তার সাফল্য আরও এক ধাপ সমাদৃত হয়।
নারীর অধিকার আন্দোলনকর্মী ফেং ইউয়ান, চীন
দীর্ঘদিন ধরে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করছেন চীনের ফেং ইউয়ান। তিনি ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ইক্যুয়ালিটি বেইজিং’–এর পরিচালক। এই সংগঠনটি আইনি সংস্কার, সক্ষামতা বৃদ্ধি এবং একটি হেল্পলাইন ব্যবহার করে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিবেদিত। সামপ্রতিক বছরগুলিতে তিনি চীনের ‘মি টু’ আন্দোলনের শিকারদের সমর্থন জুগিয়ে আসছেন এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নিয়োগকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে, তিনি গণমাধ্যম, এইচআইভি/এইডস, নেতৃত্ব এবং যুব ক্ষমতায়ন বিষয়ে নারী সংক্রান্ত বিভিন্ন এনজিও উদ্যোগ স্থাপনে সহায়তা করেছেন। তিনি চীন এবং এর বাইরেও প্রকাশনা লিখেছেন এবং সম্পাদনা করেছেন।
(আগামী পর্বে সমাপ্ত)