পর্ব ৩
আজ আমরা জানব এমন দশজন নারীর কথা যারা প্রত্যেকেই তাদের নিজনিজ ক্ষেত্রে অনন্য। তাদের কেউ জিমন্যাস্ট, কেউ মহাকাশচারী, মানবাধিকার কর্মী কিংবা গীতিকার! চলুন তাহলে শুরু করি আজকের পর্ব ইরিত্রিয়ার বিজ্ঞান সামগ্রী নির্মাতা সারা বারকাই–এর সাথে।
বিজ্ঞান সামগ্রী নির্মাতা সারা বারকাই, যুক্তরাজ্য/ইরিত্রিয়া
ইরিত্রিয়ায় জন্মগ্রহণকারী এবং সুদানে বেড়ে ওঠা সারা বারকাই লন্ডনে বড় হয়েছেন। তার পরিবারে তিনিই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন এবং সেখানে শিশুর বিকাশ নিয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি অ্যামবেসা প্লে নামক একটি সামাজিক উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতা, যেটি শিশুদের জন্য বিভিন্ন ডিআইওয়াই (Do-it-yourself) শিক্ষা সামগ্রীর নকশা প্রণয়ন করে এবং তাদের খেলনার নকশা তৈরিতে অংশ নিতে উৎসাহিত করে। বারকাইয়ের কাজ বিভিন্ন দেশের বিদ্যালয়ের বাইরে থাকা শিশুদের খেলার মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগ প্রদান করে। তার উদ্ভাবনী প্রচেষ্টাগুলোর স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ফোর্বস ম্যাগাজিনের ‘থার্টি আন্ডার থার্টি’ তালিকায় সামাজিক প্রভাবশালী হিসেবেও স্থান পেয়েছেন।
অ্যাক্টিভিস্ট অরুণা রায়, ভারত
দরিদ্র জনগণের অধিকার নিয়ে কাজ করার জন্য বিখ্যাত অরুণা রায় তার সিভিল সার্ভিসের চাকরি ছেড়ে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সরাসরি কাজ শুরু করেন। মজদুর কিষাণ শক্তি সংগঠন (এমকেএসএস)-এর সহ–প্রতিষ্ঠাতা তিনি। এই সংগঠনটি স্বচ্ছতা এবং ন্যায্য মজুরির অধিকার বিষয়ে কাজ করে। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি জনগণ–নির্ভর উদ্যোগের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। এ জন্য তাকে এশিয়ার নোবেল হিসেবে পরিচিত র্যামন ম্যাগসেসেসহ বহু পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছে। অরুণা ন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান উইমেনের সভাপতি এবং গত বছর তিনি তার স্মৃতিকথা ‘দ্য পার্সোনাল ইজ পলিটিক্যাল’ প্রকাশ করেছেন।
জিমন্যাস্ট হেবেকা আন্দ্রাজি, ব্রাজিল
জিমন্যাস্ট হেবেকা আন্দ্রাজি মোট ছয়টি পদক জয়ের মধ্যে দিয়ে ব্রাজিলের সবচেয়ে সফল অলিম্পিয়ান হয়েছেন। তার ঝুলিতে রয়েছে নয়টি বিশ্ব শিরোপাও। তিনি ২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিকে ফ্লোর এক্সারসাইজে স্বর্ণপদক জিতেছেন, যেখানে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে সফল জিমন্যাস্ট সিমোন বাইলসকে পরাজিত করেন। পদক প্রদান অনুষ্ঠানে বাইলস এবং তার মার্কিন সহকর্মী জর্ডান চাইলস হেবেকার প্রতি সম্মান দেখিয়ে নড্ করেন যা অন্তর্জালে ভাইরাল হয়ে এবারের অলিম্পিকের একটি প্রতীক হয়ে ওঠে। দশ বছর বয়স পর্যন্ত আন্দ্রাজি সাও পাওলো শহরের বাইরের শহরতলির ঘিঞ্জিমতন এলাকায় বাস করতেন এবং সেখান থেকে হেঁটে রোজ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যেতেন। জীবনে বহু চড়াই–উৎরাই পার করে তার উত্থান এ–পর্যায়ে উত্থান এবং তিনি মানসিক স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়ে এক সোচ্চার ও বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর।
মহাকাশচারী সুনিতা উইলিয়ামস, যুক্তরাষ্ট্র
সুনিতা উইলিয়ামসের নাম কম–বেশি সবারই জানা। নাসার মহাকাশচারী সুনিতা উইলিয়ামস গত ৫ জুন বোয়িং স্টারলাইনার মহাকাশযানে চড়েন। তিনি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (ISS) মাত্র আট দিনের মিশনের জন্য প্রস্তুত হয়ে উড়াল দেন। কিন্তু মহাকাশযানে ত্রুটির কারণে তাঁকে জানানো হয় যে তিনি ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির আগ পর্যন্ত পৃথিবীতে ফিরতে পারবেন না! ফলে আপাতত তিনি মহাকাশেই অবস্থান করছেন ফিরে আসার জন্য।
যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর সাবেক হেলিকপ্টার পাইলট এবং নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মহাকাশযাত্রার রেকর্ডধারী সুনিতা। ২০০৭ সালে মহাকাশে প্রথমবারের মতো আয়োজিত ম্যারাথন দৌড়েও অংশ নেন তিনি। বর্তমানে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৪০০ কিলোমিটার উচ্চতায় পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে দূরে থাকলেও তিনি ইতিবাচক মনোভাব নিয়েই আছেন এবং মহাকাশযানটিকে তার ‘আনন্দের স্থান’ বলেই অভিহিত করছেন।
ধর্মীয় আন্দোলনকারী আনাত হফম্যান, ইসরায়েল
আনাত হফম্যান গত কয়েক দশক ধরে ইহুদি ধর্মের ভেতরকার লিঙ্গ সমতা ও ধর্মীয় বহুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি ‘উইমেন অফ দ্য ওয়াল’ নামক গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, যা জেরুজালেমের পুরনো শহরের পশ্চিম তীরে ইহুদি নারীদের জন্যও সমান প্রার্থনার অধিকার আদায়ে সক্রিয়। বছরের পর বছর ধরে, তিনি নারীকে প্রার্থনার সময় বাধ্যতামূলক চাদর পরিধান এবং সম্মিলিতভাবে তোরা (ধর্মগ্রন্থ) পড়তে নিষিদ্ধ করে এমন নিয়মগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। হফম্যান গত দুই দশক ধরে ইসরায়েল রিলিজিয়াস অ্যাকশন সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন, যা রিফর্ম মুভমেন্টের একটি আইনগত ও অ্যাডভোকেসি বিভাগ এবং সমতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রচারে কাজ করে যাচ্ছে।
এলজিবিটিকিউ অধিকার কর্মী অ্যান চুমাপর্ন (ওয়াদ্দাও), থাইল্যান্ড
এ–বছর বিবাহের সমতা বিষয়ক একটি বিল আইনে পরিণত হওয়ার পর থাইল্যান্ড দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে সমলিঙ্গের বিয়ে বৈধ করে। এই বিলটি সংসদ পর্যন্ত পৌঁছানোর যাত্রায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন চুমাপর্ন। সংসদের সিনেট ও নিম্নকক্ষে আইনি যাচাই কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। দক্ষিণ থাইল্যান্ডের বাসিন্দা, ব্যাংকক প্রাইডের সহ–প্রতিষ্ঠাতা ও সমকামী অধিকারকর্মী চুমাপর্ন এক দশকের বেশি সময় ধরে মানবাধিকার ও এলজিবিটিকিউ অধিকার নিয়ে সোচ্চার। ২০২০ সালে থাইল্যান্ডের তরুণদের বিক্ষোভের সময় তিনি গণতন্ত্রপন্থী ফেমিনিস্ট লিবারেশন ফ্রন্টের সমর্থক ছিলেন। তার কাজের জন্য তিনি ইতমধ্যে আটটি রাজনৈতিক মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন।
গায়ক–গীতিকার গ্যাবি মোরেনো, গুয়াতেমালা
লাতিন সঙ্গীত জগতে খ্যাতিমান গায়ক–গীতিকার গ্যাবি মোরেনো ২০২৪ সালে সেরা লাতিন পপ অ্যালবামের জন্য গ্র্যামি জিতে মূলধারায় প্রবেশ করেন। দুই ভাষায় রচিত তার সঙ্গীতে প্রভাব রয়েছে আমেরিকানা, সৌল এবং লাতিন লোকসংগীতের। আবেগময় কণ্ঠ দিয়ে তিনি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরেন। শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করে তিনি গুয়াতেমালার প্রথম ইউনিসেফের শুভেচ্ছা দূত মনোনীত হয়েছেন। সমপ্রতি একটি প্রচারণা শুরু করেছেন গ্যাবি, যার লক্ষ্য মানসম্মত শিক্ষামূলক সরঞ্জামের সরবরাহ বাড়ানো, কেননা গুয়াতেমালায় বর্তমানে প্রায় সাতাশ লাখ ছেলে–মেয়ে স্কুল তথা শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে রয়েছে।
ধর্ষণের পরিস্থিতি পার করে আসা ক্যাম্পেইনার জিসেল পেলিকট, ফ্রান্স
দীর্ঘ সময় ধ’রে তার ওপর চলতে থাকা ধর্ষণের হাত থেকে বেঁচে ফেরা ক্যাম্পেইনার জিসেল পেলিকট নিজের গোপনীয়তার অধিকার ত্যাগ করে এবং তার গল্প বিশ্বে পৌঁছানোর সুযোগ দিয়ে সাহস ও দৃঢ়তার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। তার প্রাক্তন স্বামী স্বীকার করেছে যে তিনি বিয়ের সময় তাকে মাদক সেবন করিয়ে ধর্ষণ করেছিলেন এবং অন্য অনেক পুরুষকে তাকে ধর্ষণ করার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন। এমনকি বেশিরভাগ অভিযুক্ত ধর্ষণের ভিডিও করা হয়েছিল। আইন অনুযায়ী, পেলিকট গোপনীয়তার অধিকার পেয়েছিলেন, তবে তিনি তা না করে বিচার প্রক্রিয়া শুরুর এবং ভিডিও দেখানোর অনুরোধ করেন যাতে লজ্জার দায় অভিযুক্তদের ওপর মানসিক চাপ তৈরি করে। মামলায় জড়িত ৫০ জনের মধ্যে কিছু পুরুষ ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন, তবে বেশিরভাগই বলেছেন তারা শুধুমাত্র যৌন কর্মকান্ডে অংশ নিয়েছিলেন। যখন বিচার প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে পৌঁছায় তখন বিশ্বজুড়ে নারীরা পেলিকটের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তিনি আশা করেন যে তার মামলা ফরাসি আইন এবং ধর্ষণ ও সম্মতির বিষয়ে সমাজের মনোভাব পরিবর্তন করবে।
আফ্রো–পপ সঙ্গীতশিল্পী নোয়েলো উইয়ালা এনওয়াদেই, ঘানা
নোয়েলা উইয়ালা এনওয়াদেই মঞ্চে ‘উইয়ালা’ নামে পরিচিত যার অর্থ তার স্থানীয় সিসালা ভাষায় ‘কর্মপরায়ণ’। তার অনন্য ফ্যাশন এবং স্টাইলের জন্য তিনি পরিচিত। মঞ্চের পোশাক–আশাক এবং আনুষঙ্গিক জিনিসগুলো নিজেই ডিজাইন করেন, যা তার নিজ শহর উত্তর ঘানার ঐতিহ্য প্রদর্শন করে। তার গানগুলোর অনেকটাই আফ্রিকান নারীদের শোষণ নিয়ে আলোকপাত করে। উইয়ালা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সঙ্গে এবং ঘানার প্রশাসনের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। কর্মসংস্থান এবং সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করতে তিনি নিজ শহর ফুনসিতে একটি আর্ট সেন্টার, একটি কমিউনিটি রেডিও স্টেশন এবং একটি রেস্তোঁরা প্রতিষ্ঠা করেছেন।
মানবাধিকার আইনজীবী ক্যাথরিন মার্টিনেজ, ভেনেজুয়েলা
ভেনেজুয়েলার কারাকাসে ‘হোসে ম্যানুয়েল দে লস রিওস’ শিশু হাসপাতালে অনেক শিশু রয়েছে যারা নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে আসা বা একক অভিভাবকের পরিবার। ক্যাথরিন মার্টিনেজের প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি সংস্থা ‘প্রেপারা ফ্যামিলিয়া’ তাদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র–যেমন পোশাক, চিকিৎসা সরঞ্জাম, খাবার এবং মানসিক সহায়তা প্রদান করে। একজন মানবাধিকার আইনজীবী হিসেবে, মার্টিনেজ এবং তার দল হাসপাতালে শিশু এবং নারী অভিভাবকদের উপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য রেকর্ড করেন, যাতে ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে। ভেনেজুয়েলায় উচ্চ মাত্রার অপুষ্টির মুখোমুখি হয়ে, প্রেপারা ফ্যামিলিয়া একটি কেন্দ্র খুলেছে যা শিশু এবং গর্ভবতী নারীদের বিনামূল্যে পুষ্টি সম্পূরক ও ভিটামিন সরবরাহ করে।
ক্রমশ…