দৃঢ়তার জয়গান

বিবিসি হানড্রেড উইম্যান ২০২৪

সুমাইয়া বিনতে রশিদ | শনিবার , ১ মার্চ, ২০২৫ at ১১:০৮ পূর্বাহ্ণ

পর্ব ৯

লেখক ও অনুবাদক শাহরনুশ পারসিপুর, ইরান/যুক্তরাষ্ট্র

ইরানের অন্যতম প্রধান ঔপন্যাসিক, শাহরনুশ পারসিপুর তার লেখায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর যৌন নিপীড়ন ও বিদ্রোহ এমন নানা নিষিদ্ধ বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি ইরানের জাতীয় টেলিভিশন ও রেডিওতে কথাসাহিত্যের লেখক এবং প্রযোজক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। তবে ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের আগে দ’ুজন কবিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন। এর ফলে তিনি প্রথমবার কারাগারে যান। বিপ্লবের পর, ইরানে তার কাজ ব্যাপকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং ‘ওমেন উইদাউট ম্যান’ উপন্যাসে কুমারীত্ব নিয়ে খোলাখুলিভাবে উল্লেখ করার জন্য তাকে আবার কারাবন্দী করা হয়। এটি পরে ইরানের বাইরে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়। পারসিপুর তার লেখায় কারাগারে থাকার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন এবং ১৯৯৪ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনে আছেন।

মানবাধিকার কর্মী শেৎলানা আনোখিনা, রাশিয়া

শেৎলানা আনোখিনা রাশিয়ার উত্তর ককেশাস, পূর্ব ইউরোপ এবং এশিয়ায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারীদের সাহায্য করতে বহু বছর ধরে কাজ করছেন। ২০২০ সালে তিনি ‘মেরেম’ প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করেন, যার মাধ্যমে তিনি দাগেসস্তান, চেচনিয়া এবং অন্যান্য উত্তর ককেশিয় অঞ্চলের ঝুঁকিপূর্ণ নারীদের নিরাপদে অন্যত্র স্থানান্তর করতে সাহায্য করেন, তাদের আইনগত এবং মানসিক সহায়তা প্রদান করেন। যখন চেচেন ও দাগেস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী তার নারী আশ্রয়কেন্দ্রে অভিযান চালায় তখন আনোখিনা নিজে ২০২১ সালে রাশিয়া ছেড়ে চলে যান। গত বছর, রুশ কর্তৃপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর সুনাম নষ্ট করার অভিযোগে একটি অপরাধ তদন্তও শুরু করেছিল।

নারী অধিকার কর্মী ঝিনা মোদারেস গোরজি, ইরান

কুর্দি সাংবাদিক ও নারী অধিকার কর্মী ঝিনা মোদারেস গোরজি ২০১৯ সালে ঝিভানো উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন, যা শিখন, প্রতিবাদ প্রদর্শন এবং নারীদের সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে নারীদের প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াই করে। ইরানের “উইমেন, লাইফ, ইন্ডিপেন্ডেন্স” আন্দোলনের শুরু থেকে তাকে দুইবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রথমে তাকে ‘সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা’ সহ বিভিন্ন অভিযোগে ২১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে সেই সাজা কমে এসেছে ২ বছর ৪ মাসে, ঝিনা সেই সাজা ভোগ করছেন এখন। মোদারেস গোরজি ইরানে আইন সংস্কারের জন্য জনসমর্থন সংগ্রহকারী ওয়ান মিলিয়ন সিগনেচার ক্যাম্পেইনের সদস্য ছিলেন, যা নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আইনগুলোর সমাধানে কাজ করে। তিনি কুর্দি নারীদের নিয়ে একটি ফটোগ্রাফি গ্রুপ, একটি পডকাস্ট এবং শিশুদের জন্য অনুপ্রেরণামূলক একটি ব্লগ প্রকাশেরও উদ্যোগ নিয়েছেন।

দূরপাল্লার দৌড়বিদ জোয়ান চেলিমো মেলি, কেনিয়া/ রোমানিয়া

দীর্ঘদূরত্বের দৌড়ে সাফল্যের জন্য প্রশংসিত, কেনিয়ায় জন্মগ্রহণকারী রোমানিয়ান অলিম্পিয়ান জোয়ান চেলিমো গত বছর ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের হাফ ম্যারাথনে রৌপ্য পদক জিতেছেন। খেলার বাইরেও তিনি লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার এবং স্বীয় অভিজ্ঞতার আলোকে নারী খেলোয়াড়রা যেধরনের হুমকির মুখে পড়েন তা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে আগ্রহী। তিনি ‘‘টিরোপ’স এনজেলস’’এর সহপ্রতিষ্ঠাতা, প্রতিষ্ঠাননি কেনিয়ার অ্যাথলেটদের একটি সংগঠন। এই সংগঠনটি ২০২১ সালে, দৌড়বিদ এবং বিশ্ব রেকর্ডধারী অ্যাগনেস টিরোপের নৃশংস্য হত্যার পরে গঠিত হয়। এটি লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে। এই বছর অলিম্পিক রানার রেবেকা চেপটেগেইকে তার প্রাক্তন সঙ্গী দ্বারা হত্যার ঘটনা কেনিয়ায় নারীনিধনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার লক্ষ্যে নতুন করে আহ্বান জানিয়েছে।

শিল্পী এবং জলবায়ু কর্মী ইনা মুজা, মালি

জলবায়ু বিষয়ক আইনজীবী, সঙ্গীতশিল্পী এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা ইনা মুজা নারী যৌনাঙ্গ বিকৃতি প্রতিরোধ এবং নারীর খৎনা থেকে মুক্তি এবং টেকসই উন্নয়ন প্রচারের কাজ পর্যন্ত বহু ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন। তিনি ‘দ্য গ্রেট গ্রিন ওয়াল’ ডকুমেন্টারিটি প্রযোজনা করেছেন, এবং এতে অভিনয় করেছেন। এই ডকুমেন্টারিটি আফ্রিকার মরুভূমি বেড়ে যাওয়া রোধ এবং সাহেল অঞ্চলের ক্ষয় হতে থাকা ভূমি পুনরুদ্ধারের কঠিন কাজটি করে চলেছেন। সাহেল অঞ্চলটি ১২টি দেশজুড়ে বিস্তৃত সাহারা মরুভূমির দক্ষিণে অবস্থিত। জাতিসংঘের কনভেনশন টু কমব্যাট ডেজার্টিফিকেশনএর শুভেচ্ছাদূত হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত সমপ্রদায়দের কণ্ঠস্বরকে তুলে ধরেন মুজা। তিনি ‘কোড গ্রিন’ নামের একটি অলাভজনক সংস্থার সহপ্রতিষ্ঠাতা, যা উদ্ভাবনী প্রযুক্তি এবং গেমিংয়ের সমন্বয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপকে এগিয়ে নিতে অনুপ্রাণিত করে থাকে।

কবি মারিয়া তেরেসা হর্টা, পর্তুগাল

লেখক এবং সাংবাদিক মারিয়া তেরেসা হর্টা পর্তুগালের অন্যতম প্রধান নারীবাদী এবং বহু পুরস্কারপ্রাপ্ত বইয়ের লেখক, তবে তিনি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি পরিচিত ‘নোভাস কার্টাস পর্তুগুয়েসাস’ (নিউ পর্তুগিজ লেটারস)-এর সহলেখক হিসেবে। তার গল্প, কবিতা এবং ইরোটিকার এই সংকলন ১৯৭২ সালে পর্তুগালের স্বৈরাচারী সরকার নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। হর্টা এবং তার সহলেখকদের ‘‘অশ্লীলতা’’ এবং ‘‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অপব্যবহার’’এর জন্য বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। তাদের মামলাটি ‘‘থ্রি মারিয়াস’’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে, যা বিশ্বব্যাপী শিরোনাম হয়ে ওঠে এবং প্রতিবাদের সূচনা করে। ১৯৭৪ সালের কার্নেশন বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সরকার উৎখাতের পর তাদের মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। গত বছর ছিল সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের ৫০তম বার্ষিকী।

কনটেন্ট মডারেটরদের ইউনিয়নের নেতা

কাউনা মালগউই, নাইজেরিয়া

কাউনা মালগউই প্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) শিল্পে শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে জোরালো প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট মালগউই নাইজেরিয়ার কনটেন্ট মডারেটর ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং এআই সিস্টেম প্রশিক্ষণে প্রয়োজনীয় হিডেন লেবার বা অদৃশ্য শ্রমের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছেন। ফেসবুকের জন্য আউটসোর্স কনটেন্ট মডারেটর হিসেবে কাজ করার সময় মালগউই ধর্ষণ, আত্মহত্যা এবং শিশু নির্যাতনের কিছু ভিডিও ফুটেজের মুখোমুখি হন, যা দেখার পর তিনি অনিদ্রা এবং প্যারানয়ায় ভুগতে শুরু করেনে। তিনি সেই ১৮৪ জন প্রাক্তন মডারেটরের একজন, যারা ফেসবুকের মূল কোম্পানি মেটা এবং কেনিয়ার সাবকন্ট্রাক্টরদের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুতির জন্য মামলা করেছেন। তিনি কনটেন্ট মডারেটরদের অধিকার রক্ষায় ইউরোপীয় পার্লামেন্টে এনিয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন।

ফটোগ্রাফার মাহেদার

হাইলেসেলাসি, ইথিওপিয়া

ইথিওপিয়ার ফটোগ্রাফার মাহেদার হাইলেসেলাসি শুকিয়ে যাওয়া নদী এবং ধ্বংস হওয়া শস্যক্ষেত্র নিয়ে কাজ করেন। তিনি তার ছবিতে তুলে ধরেছেন যে কীভাবে মারাত্মক খরা সেখানকার পরিবারগুলোকে তাদের কন্যাশিশুদের বাল্যবিবাহ দিতে বাধ্য করছে। এই কাজের জন্য তিনি ২০২৩ সালে কনটেম্পোরারি আফ্রিকান ফটোগ্রাফি পুরস্কার জিতেছেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, জলবায়ু সংকটের কারণে বিশ্বব্যাপী বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে থাকা মেয়েদের সংখ্যা ২০৫০ সালের মধ্যে একতৃতীয়ংশ বৃদ্ধি পাবে। হাইলেসেলাসির আলোকচিত্রে মানুষের ইতিহাস এবং দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতার বিষয় উঠে আসে। তার কাজ বহু মর্যাদাপূর্ণ প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০২৪ সালের আফ্রিকান বিয়েনাল অফ ফটোগ্রাফি।

হেভি মেটাল ব্যান্ড সংগীতশিল্পী ফিরদা

মারসিয়া কুরনিয়া, ইন্দোনেশিয়া

লিঙ্গ পার্থক্য এবং ধর্মীয় নিয়মের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করা, প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়াটা ফিরদা মারসিয়া কুরনিয়ার স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা। তিনি হিজাব পরিহিত নারীদের হেভি মেটাল ব্যান্ড ভয়েস অফ বাচেপ্রতএর প্রধান গায়িকা এবং গিটারিস্ট। ইন্দোনেশিয়ার বহুল ব্যবহৃত ভাষাগুলির মধ্যে ইংরেজি এবং সুন্দানিজে গান করার মাধ্যমে দলটি পুরুষতন্ত্রের প্রতি তাদের হতাশা প্রকাশ করেন। অনেকেই, বিশেষত রক্ষণশীল মুসলিমরা তা ভালোভাবে নেয়নি এবং এই ব্যান্ডের হেভি মেটাল গানগুলোতে আপত্তি জানিয়েছে। কিন্তু পশ্চিম জাভার গারুতে তাদের গ্রামের স্কুলে এক দশক আগে পথচলা শুরু করা ব্যান্ডটি ইতোমধ্যে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এই বছর তারা সঙ্গীত উৎসবের ৫৪ বছরের ইতিহাসে প্রথম ইন্দোনেশিয় ব্যান্ড হিসেবে গ্লাস্টনবুরিতে পারফর্ম করেছে।

নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী

নাদিয়া মুরাদ, ইরাক

নাদিয়া মুরাদ যৌন সহিংসতার শিকার নারীদের অধিকার আদায়ে কাজ করছেন। একাধারে মানবাধিকার কর্মী এবং নোবেলজয়ী নাদিয়া ইরাকে ইয়াজিদি গণহত্যার শিকার থেকে পালিয়ে আসা। ২০১৪ সালে ইসলামিক ষ্টেট গোষ্ঠীর হাতে বন্দি হয়ে নির্যাতিত অবস্থায় পালিয়ে এসে সাহসিকতার সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা বিশ্বকে জানিয়েছেন। তাকে আইএস জঙ্গিরা বন্দী করে দাসত্বে বাধ্য করে এবং তাকে ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। পালিয়ে এসে, সংঘাতের সাথে সম্পর্কিত যৌন সহিংসতা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে বিশ্বের কাছে তার অগ্নিপরীক্ষার কথা সাহসের সাথে বর্ণনা করেছেন। তিনি মানবাধিকার আইনজীবী আমাল ক্লুনির সঙ্গে কাজ করে আইএসকে জবাবদিহি করার চেষ্টা করেছেন এবং নাদিয়া’স ইনিশিয়েটিভ শুরু করেছেন, যা সমপ্রদায়গুলো পুনর্গঠনে এবং নির্যাতিতদের ক্ষতিপূরণের জন্য কাজ করে। ইয়াজিদি গণহত্যার একদশক পর, মুরাদ দৃঢ়তার এক বৈশ্বিক প্রতীক হয়ে উঠেছেন।

ক্রমশ

পূর্ববর্তী নিবন্ধফিনলে সাউথ সিটি শপিং মলে শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা
পরবর্তী নিবন্ধভাষা আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা যেন ভুলে না যাই