বিশেষজ্ঞদের ধারণা, রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামে সহনীয় মাত্রার দেড় থেকে দু’গুণ বেশি শব্দ বিরাজ করছে। শব্দদূষণের কারণে উচ্চরক্তচাপ, অনিদ্রা, শ্রবণশক্তি হ্রাস, মনসংযোগ কমে যাওয়া, মাথাব্যথা ও মাথা ধরার জটিলতায় ভুগছে নগরবাসী। শুধু তাই নয়, নগরবাসীকে খিটখিটে মেজাজ, বিরক্তি বোধসহ অস্বাভাবিক আচরণ করার মতো মানসিক ও দৈহিক নানা সমস্যার পড়তে হচ্ছে।
গত ১ অক্টোবর ‘শব্দ দূষণে অতিষ্ঠ নগরবাসী, বাড়ছে বধিরতাসহ নানা রোগ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বন্দর নগরী চট্টগ্রাম এখন শব্দ দূষণের নগরীও। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত যানবাহনের উচ্চ শব্দে নাগরিক জীবন রীতিমতো অতিষ্ঠ। সহনীয় মাত্রার ২২ থেকে ৩৮ ডেসিবল বেশি শব্দের দূষিত সমুদ্রে রাতদিন হাবুডুবু খাচ্ছেন নগরবাসী। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে এ দূষণকে অনেকে বলছেন ‘শব্দ সন্ত্রাস’। শব্দ দূষণ প্রতিনিয়তই নাগরিক জীবনকে প্রভাবিত করছে। সকালে ঘর থেকে বের হয়ে কর্মস্থলে, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া থেকে আবার ঘরে ফিরে আসা অবধি শব্দ দূষণের যন্ত্রণায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে নানান স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বয়স্ক ও শিশুরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সব থেকে বেশি।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নগরী চট্টগ্রামে এখন আর চারদিকে পাখির কিচিরমিচির শোনা যায় না। শোনা যায় গাড়ির বিকট হর্নের শব্দ (বাসের শব্দ ৯৫ ডেসিবল ও মোটরসাইকেলের ৮৭ থেকে ৯০ ডেসিবল), কলকারখানার মেশিনের শব্দ (৮০ থেকে ৯০ ডেসিবল) এবং বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে সৃষ্ট শব্দ। শুধু যে বাইরের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে শব্দ দূষণ হয়, তা নয়; বরং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেও শব্দ দূষণ হয়।
প্রায়শই দেখা যায়, নগরীর বিভিন্ন সড়ক ও মহাসড়কে কেবল গাড়ি চলমান অবস্থায়ই নয়, যানজটের সময়ও চালকরা অহরহ হর্ন বাজিয়ে চলেন। হর্নের শব্দে রাস্তার পাশে চলা কিংবা দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। তেমনই একটি দৃশ্য দেখা যায় গত ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সিআরবি সাত রাস্তার মোড়ে। শুধু এই মোড়েই নয়, নগরীর সকল সড়কে বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে চলেন চালকরা, যার বেশিরভাগই বাজানো হয় অপ্রয়োজনে। কিন্তু চালকরা মনে করছেন, বিকট শব্দে হর্ন বাজানোর প্রয়োজন আছে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত জরিপ থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তা মানুষের মানসিক ও শারীরিক সমস্যার জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। এভাবে শব্দদূষণ চলতে থাকলে শিশুদের মধ্যে বধিরতার হার ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে। আর লেখাপড়ায় অমনোযোগী ও বিকার মানসিকতাসম্পন্ন হয়ে গড়ে উঠবে। জরিপের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, উচ্চশব্দ শিশু, গর্ভবতী মা এবং হৃদরোগীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। আকস্মিক উচ্চশব্দ মানবদেহে রক্তচাপ ও হৃদকম্পন বাড়িয়ে দেয়, মাংসপেশীর সঙ্কোচন করে এবং পরিপাকে বিঘ্ন ঘটায়। কণ্ঠনালীর প্রদাহ, আলসার ও মস্তিস্কের রোগও হতে পারে। হঠাৎ খুব জোরে শব্দ, যেমন যানবাহনের তীব্র হর্ন বা পটকা ফাটার আওয়াজ মানুষের শিরা ও স্নায়ুতন্ত্রের ওপর প্রচণ্ড চাপ দেয়। উচ্চশব্দ সৃষ্টিকারী হর্ন মোটরযানের চালককে বেপরোয়া ও দ্রুতগতিতে যান চালাতে উৎসাহিত করে। এতে সড়ক দুর্ঘটনার আশঙ্কাও বৃদ্ধি পায়।
শব্দদূষণের কারণে নাগরিক যন্ত্রণা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও তা চলছে নির্বিবাধে। হাইকোর্ট ইতোপূর্বে হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। আসলে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিধান থাকলেও তা প্রয়োগ হচ্ছে না। ফলে আইনকে উপেক্ষা করে বা তোয়াক্কা না করে অধিকাংশ যানবাহনে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এসব হর্নের ব্যবহার চলছে।
এছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও সভা-সমাবেশের নামে শব্দ-দূষণের নামে যে অত্যাচার সহ্য করতে হয়, তা রীতিমত অসহনীয়। যে মাঠ বা প্রাঙ্গণে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করা হয় শব্দযন্ত্র যদি সেই প্রাঙ্গণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তাতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু তা না করে ঐ প্রাঙ্গণের এক কিলোমিটার পর্যন্ত জায়গায় মাইক স্থাপন করে নাগরিকদের কর্ণকে ব্যথিত করে তোলা হয়। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কারণে প্রশাসন ছাড় দিলেও এ ধরনের অত্যাচার দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। শব্দ দূষণ কমানোর জন্য প্রথমেই প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে। দূষণের বিরুদ্ধে যত আইন আছে, তার প্রয়োগ থাকা চাই।