নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ, অসংখ্য নদ–নদী, খাল–বিল, জলধার নিয়ে সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ। কিন্তু নদীমাতৃক দেশের ইতিহাস ক্রমেই ম্লান হয়ে যাচ্ছে। দেশের নদনদীগুলোর অবস্থা যে শোচনীয়, তা নদীগুলোর সার্বিক চিত্র পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায়। এর পেছনে দখলদারিত্ব থেকে শুরু করে নানা অনিয়ম জড়িত। চট্টগ্রামের লাইফ লাইন খ্যাত কর্ণফুলী নদীতে সর্বোচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপক্ষো করে দখল ও দূষণের মহোৎসব চলছে। এমনকিক কর্ণফুলী রক্ষায় মাহামান্য হাইকোর্টের রায়কে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তোয়াক্কা করেনি। ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে আদালতের রায়কে উপেক্ষা করার প্রবণতা যা কোনভাবেই কাম্য নয়। ‘চট্টগ্রামের হৃদপিণ্ড’ খ্যাত কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে অনেকগুলোর অস্বিত্ব হুমকির সম্মুখীন। পরিবেশবাদী সংগঠন ‘ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান ওপেইনিয়ন’ পরিচালিত এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে কাপ্তাই পর্যন্ত কর্ণফুলীর দুই তীরে ৫২৮ প্রজাতির উদ্ভিদ শনাক্ত হয়েছে যার মধ্যে ৮১ প্রজাতির উদ্ভিদ বিলুপ্তির হুমকির মুখে। দূষণ ঠেকাতে কার্যকর উদ্যোগ না নিলে আরো ৬১ প্রজাতি উদ্ভিদ বিপন্ন হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন গবেষণায় দুষণের জন্য ৩০টি কারণ শনাক্ত করা হয়েছে। যা বাস্তবায়ন এখন খুবই জরুরি।
বর্তমান সরকারের মাননীয় পরিবেশ মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে বিষয়গুলো শনাক্ত করে পরিবেশ রক্ষার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন। যাকে সাধুবাদ জাানাই।
উচ্চ আদালতের আদেশ থাকা সত্ত্বেও দেশের আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যের হৃদপিণ্ড কর্ণফুলী নদীকে দখল মুক্ত করতে ব্যর্থতা সকলেরই। কার্যকর উচ্ছেদ শুরু না হওয়ার কারণে দখলদার ও ভূমিদস্যুরা কর্ণফুলীর উভয় তীরে ছোটখাটো আরও অবৈধ স্থাপনা গড়ে তুলছে নিয়মিত। ফলে কর্ণফুলী যেমন হচ্ছে সঙ্কুচিত তেমনিভাবে নাব্যতাও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। নদীর নিকটবর্তী বিভিন্ন এলাকায় ইতিমধ্যে চর পড়েছে। কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী চিহ্নিত ২ হাজার ১৮১টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে গতি না আসার পেছনে রহস্যজনক কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা।
চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গিবাজারের মোড় থেকে মেরিনার্স পার্ক, নতুন মাছ বাজার এবং ভেড়া মার্কেট থেকে বাকলিয়া চরের মোড় পর্যন্ত দোকানপাট, ঘড়বাড়ি এবং বড় বড় বস্তি গড়ে তুলেছে দখলকারীরা। আইনত নদী তীর কোনওভাবেই ইজারা দেয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ বার বার বিভিন্ন সংস্থাকে ইজারা দিয়েই যাচ্ছে। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনকারী সংগঠনগুলো ইজারা চুক্তি বাতিলের এবং উচ্ছেদের জন্য আবেদন জানিয়েছে।
২০১৪ সালের গবেষকদের গবেষণা অনুযায়ী শাহ আমানত সেতু এলাকায় নদীর প্রবাহমান ধারার পরিমাণ ছিল ৯৩৮ মিটার। বর্তমানে যা নেমে এসেছে ৪৬১ মিটারে। নদীর পাড়ের শতাধিক শিল্প–কারখানার বর্জ্য পরিশোধন ছাড়া সরাসরি নদীতে পড়ে নদী দূষণ হচ্ছে। উজানের চেয়ে ভাটির মোহনা উঁচু হওয়ার কারণে নগরীতে ও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বর্তমানে এটি যেন চট্টগ্রামবাসীর জন্য অভিশাপ হিসেবে দেখা দেয়। ‘কর্ণফুলী বাঁচলে দেশ বাঁচবে।’ এভাবে কর্ণফুলীকে মেরে ফেললে সভ্যতা ধ্বংস হবে। দখলদারিদের উচ্ছেদের জন্য রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ জরুরি।
সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামবাসীর জন্য এবং কর্ণফুলী নদী রক্ষার প্রয়োজনে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন একগুচ্ছ উদ্যোগ নিয়েছে, যা নগরবাসির জন্য আশারবাণী। দখল–দূষণে বিপর্যস্ত কর্ণফুলী নদী রক্ষায় এবং নদীর তীরে দখল হয়ে যাওয়া সরকারি জায়গা পুনরুদ্ধার করে সেখানে পার্ক, ওয়াকওয়ে, ফুটবল ও ভলিবল খেলার মাঠ নির্মাণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। থাকছে স্বতন্ত্র টেনিস ও বাস্কেট বল কোর্ট। শিশুদের জন্য হবে আলাদা জোন; যেখানে শিশু–কিশোররা তাদের মতো করে খেলাধুলার সুযোগ পাবে। নদী পারে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য তৈরি হবে মুক্ত মঞ্চ। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এ প্রকল্পে জেলা প্রসাশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার আশ্বাস প্রদান করেছে। জেগে উঠা কর্ণফুলীর নতুন ভূমিতে পার্ক ও খেলার মাঠ হলে সচেতনতা আরো বাড়বে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ মহল। পার্ক ও খেলার মাঠ তৈরির উদ্যোগ এমন জনমত তৈরিতে ভূমিকা রাখবে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন বিভিন্ন পেশার বিশেষজ্ঞ এবং শিশুদের মনোরঞ্জনের বিষয়ে শিশুতোষ লেখক বুদ্ধিজীবী সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশবাদী গবেষক ও পেশাজীবীদের সবন্বয়ে পরিকল্পনা করে প্রকল্প নেয়া যায় তবে এটি যেভাবে দৃষ্টি নন্দন হবে সেভাবে এ পরিকল্পনা চট্টগ্রামের ইতিহাস, ঐতিহ্য, জাদুঘর, সংস্কৃতি ও সামাজিক পরিবেশ উপস্থাপনা সহজ হবে এবং পর্যটনের সাথে সাথে দেশী ও বিদেশী সকলের নিকট চট্টগ্রামকে তুলে ধরা সম্ভব হবে। প্রজন্ম তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ও স্বাধীনতার মূল্যবোধ জানতে ও বুঝতে শিখবে এবং পরিকল্পনাগুলো সর্বজন গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
সময়োপযোগী আমি মনে করি জেলা প্রশাসন এ বিষয়ে বাস্তবভিত্তিক সকল মহলের সমন্বয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। জেলা প্রসাশনের এ উদ্যোগের জন্য ধন্যবাদ জানাতেই হয় জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানকে। তিনি চট্টগ্রামে দায়িত্ব নেওয়ার পর একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা এবং সরকারি জায়গা পুনরুদ্ধারে তাঁর ভূমিকা সকল মহলে প্রশংসিত হয়েছে। এলাকার বস্তির মধ্যে হতে কিশোর অপরাধী ও মাদকসেবী কর্তৃক দূষিত সমাজব্যবস্থা হতে সমাজ মুক্ত হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে যে স্মার্ট সরকারব্যবস্থা ঘোষণা করেছেন তাতে জেলা প্রসাশনের কর্ণফুলী নদীর পারের এ পরিকল্পনা স্মার্ট চট্টগ্রাম গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে শহরে নদীর পার দখল করে এবং সরকারি খালি জায়গা দখল করে যেসব বস্তি এলাকা গড়ে উঠে এতে একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাত থাকে। কর্মের সন্ধানে গ্রাম হতে শহরে আসা মানুষগুলো এসব অবৈধ বস্তিতে কম পয়সায় বসতি গড়ে তোলে। অনেকে অবস্থার শিকারে এসব বস্তিতে বসবাসের সুযোগে জড়িয়ে পড়ে অসামাজিক কর্মকাণ্ডে এবং মাদক সেবনে ও ব্যবসায়। গ্রাম হতে শহরমুখী জনস্রোত বন্ধ করতে হলে এবং শহরের অবৈধ বস্তি তৈরি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হবে।
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষি প্রধান দেশের গ্রামীণ অর্থনৈতিক বিকাশে বিভিন্ন জেলায় মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র, কৃষিজ প্রকল্প, সেচ প্রকল্প, দুগ্ধ খামার প্রকল্প, বনজ প্রকল্পের উদ্যোগ নিতে হবে। জীবিকার তাগিদে মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হয়। গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হওয়ার এধারা এখনই বন্ধ করতে হবে। গ্রামের তরুণদের গ্রামেই সরকারি–বেসরকারি উদ্যোগে দুগ্ধজাত খামার স্থাপন, গবাদি পশু লালন, বিক্রয়/আধুনিক পদ্ধতিতে মৎস্য চাষ প্রকল্প, পোলট্রি উৎপাদন শিল্পে অংশীদার করতে হবে। গ্রামের মানুষের খাদ্যশস্যের জোগান ও প্রাণিজ আমিষের শতভাগ জোগান নিশ্চিত করে চাহিদা মোতাবেক উদ্বৃত্ত শহরে, শহরের মানুষের কাছে সরবরাহ করার ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। এই ব্যবস্থা এখন চলমান রয়েছে কিন্তু রয়েছে তদারকির অভাব। সঠিক তদারকির অভাবে একশ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগী উৎপাদিত পণ্যের প্রয়োজনীয় মজুত থাকা সত্বেও বেশি দামে ভোক্তাকে কিনতে বাধ্য করছে। সরকারকে তা বন্ধ করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
এভাবে যদি গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হয়, কৃষি শিল্প যদি বিকাশিত হয় এবং গ্রামের শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত ও বেকার যুবকরা যদি গ্রামীণ অর্থনীতিতে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারে তবে গ্রামীণ মানুষের শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা বন্ধ হবে। বন্ধ হবে শহরের নতুন নতুন বস্তি তৈরি এবং বন্ধ হবে কিশোর অপরাধ।
সুতরাং স্মার্ট নাাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার ও স্মার্ট সমাজব্যবস্থা বাস্তবায়ন করার জন্য স্মার্ট গ্রাম গড়ে তুলতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে এনডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে স্মার্ট গ্রামীণ অর্থনীতি গড়ে তোলা এবং তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার বিকল্প নেই। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে একটি স্মার্ট অর্থনীতি ও স্মার্ট বিজনেসে রূপান্তরের সহায়ক হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক–শিল্পশৈলী।