কেমন পুরুষ কেমন মানুষ ছিলেন প্রয়াত জাকির হোসেন? তিনি কী নিছক ই এক তবলা বাদক? ১৯৯৪ সালে এক সাময়িকী জরিপ করেছিল। নারী পাঠকদের বিচারে সেই জরিপে অমিতাভ বচ্চনের মতো তারকাকে পেছনে ফেলে ভারতের সেরা আবেদনময় পুরুষ হয়েছিলেন জাকির হোসেন! বিশ্বসেরা এক তবলাবদক কিনা সেরা আবেদনময় পুরুষ! এটাও জাকির হোসেনের বহুমাত্রিক জীবনের একটা উদাহরণ।
পৃথিবীব্যাপী নন্দিত সিডনি অপেরা হাউজের মূল মঞ্চে অনেকবার তবলা বাজিয়ে গেছেন জাকির হোসেন। বেশ কয়েকবার তাঁকে দেখার সুযোগ মিস হলেও গত জুলাই মাসে আমার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছিল। ভাগ্যক্রমে টিকেট জুটে গেছিল এবার। জাকির হোসেন কী শুধুই তবলা বাজান? দু ঘন্টা ধরে সবাইকে বুঁদ রেখে মঞ্চে উপবিষ্ট বেহালা ও বীণা বাজিয়ে কালা রামনাথ ও জয়ন্তী কুমারেশ দুই ঝানু সাউথ ইন্ডিয়ান রমণীর বাদ্যযন্ত্রকে শাসন করে গেল তাঁর তবলা। তবলায় এতো কিছু হয়, হতে পারে তাঁকে না দেখলে বোঝা অসম্ভব। তিনি তবলা বাজান বলে মনে হলো না, মনে হলো তবলা তাঁর শিশু। তাঁর চাটিতে তাঁর যত্নে তাঁর শাসনে সে কথা বলে।এলেন মঞ্চ সালাম করে, অতঃপর দু হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে শুরু। জাকির হোসেন কোন সাধারণ তবলা বাজিয়ে ছিলেন না ।
১৯৫১ সালে মুম্বাইয়ে তার জন্ম; তবলায় হাতেখড়ি মাত্র তিন বছর বয়সে। ১২ বছর বয়সেই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে পেশাদার বাদক হিসেবে পরিচিত পেতে শুরু করেন তিনি। তখন মঞ্চে তিনি বাজাতেন বাবার সঙ্গে। জাকির হোসেন ভারতের পাশাপাশি বিশ্ব সংগীতেও ছিলেন সুপরিচিত তার আসল পদবি ছিল কুরেশি। ‘হোসেন’ তাকে উপাধি দেওয়া হয়েছিল।
তার কাজের বেশিরভাগজুড়ে ছিল ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীত; পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সংগীতেও দখল ছিল তার। ভারতসহ অন্যান্য দেশের বহু চলচ্চিত্রেও কাজ করেছেন।জাকির হোসেন এক সময়ে তবলায় যাদের সংগত করেছেন তারাও একেকজন কিংবদন্তি শিল্পী। পণ্ডিত রবিশঙ্করকে, যাকে জীবদ্দশায় দীর্ঘকাল সংগত করেছেন তার বাবা আল্লা রাখা। এছাড়া ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, ওস্তাদ আলী আকবর খান, পণ্ডিত শাস্ত প্রসাদ, বিসমিল্লাহ খান, পণ্ডিত কিষাণ মহারাজ, শিব কুমার শর্মা বা কত্থক নৃত্যশিল্পী বিরজু মহারাজকেও মঞ্চে সংগত করেছেন জাকির হোসেন।
আমরা অপেরা হাউজে গিয়ে দেখি কানায় কানায় পূর্ণ মিলনায়তন। ভেতরে বাইরে মানুষের ঢল। আমি খেয়াল করে দেখেছি সিংহভাগ মানুষ ই ছিলেন শ্বেতাঙ্গ । জাকির হোসেন যতবার সিডনি এসেছেন ততবার ই টিকেট পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার । এমন গুণী বাজিয়ে দুনিয়া বিরল। তবলা সাধারণত: এখতি কমন বা জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র। বাংলা বাঙালির ঘরে গরে বহূল প্রচলিত এই তবলা সাধারণ এক বিষয় । একটা সময় বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ছেলেদের তবলা শেখানোর হিড়িক ছিল। কেন জানি মেয়েদের বেলায় এটি অপ্রচলিত হলেও ছেলে শিশু কিশোরের বাদ্যযন্ত্র চর্চার শুরু হতো তবলা দিয়ে। যে কালে গান বাজনা ধ্রুপদী ছিল মানুষ হারমোনিয়াম আর সাধা শুদ্ধ গলায় গান গাইতো তখন তবলা ছিল অপরিহার্য । মূলত তবলা ছাড়া বাংলা গান অচল।
কিন্তু তবলা যে আলাদা করে তার মহিমায় উজ্জ্বল হতে পারে সেটা এমন ভাবে কেউ ভাবে নি। শুধু ভাবা নয় করে দেখিয়েছিলেন জাকির হোসেন। জাকির হোসেনের স্ত্রী আনতোনিয়া মিনেকোলা একজন কত্থক নাচিয়ে।
খুব ছোটবেলায় তিনি যে তবলাবাদক হতে চাননি এটা যেমন সত্যি, তেমনই এটা হওয়া ছাড়া অন্য বিকল্পও যে ছিল না, সেটাও কি অস্বীকার করা যাবে? তাঁর বাবা প্রখ্যাত তবলাবাদক ওস্তাদ আল্লারাখা খাঁ, যিনি জন্মের পরই সন্তানের কানে দিয়েছিলেন সংগীতের মন্ত্র, যিনি বড়ই হয়েছেন তবলার সুর শুনতে শুনতে; তিনি তবলাবাদক ছাড়া আর কীই–বা হতে পারতেন!
বড় তবলা বাজিয়ে হলেও তাঁর জনপ্রিয়তার কারণ অনেক। তাঁর মতো শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পীর জন্য যা খুবই বিরল। এর বড় কারণ বিজ্ঞাপনচিত্রের জিঙ্গেল। ১৯৮৮ সালে একটি চা–কোম্পানির বিজ্ঞাপনচিত্রের জিঙ্গেল করেন জাকির হোসেন, যা সে সময় মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে।
আমি যে জাকির হোসেন কে মৃত্যুর কয়েক মাস আগে দেখলাম তিনি তখনো সতেজ। টানা দু ঘন্টার বেশী সময় তবলা বাজানো কি মুখের কথা? এই যে দেঢ় থেকে দু ঘন্টা সময় এর ভেতর এক মিনিটের জন্য ও তবলা থামে নি। তাঁর সাথে সুর ভাঁজতে থাকা দুই সাউথ ইন্ডিয়ান রমনী থেমে গেলো জাকির হোসেন থামেন নি। হাতের তালুতে দুনিয়ার ছন্দ আর মাত্রা ছিল তাঁর। সে গুলো এমন ভাবে পরিবেশন করছিলেন শুনে মনে হয় তবলা কথা বলছে। সত্যি কথা বলেছিল তাঁর তবলা। সাধারণ কথোপকথনকে তিনি তবলার বোলে ফেলে যে ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন তা আমার মতো বহু মানুষের সাধারণ জীবনে এক অসাধারণ ঘটনা। যা চিরকাল মনে থাকবে।
এতো বিনয়ী এতো ভদ্র মানুষ বিরল। যখন ই সুযোগ মিলেছে মাথা নত করে হাত জোড় করে প্রণাম জানিয়েছেন। অপেরা হাউজের এই হলটির চারদিকে দর্শক শ্রোতারা বসেন। ফলে কিছু দর্শক শ্রোতা তাঁর বাজনা শুনলেও তাঁকে দেখেছিল পেছন থেকে। তাঁর মুখ বা হাতের ছন্দ তালের কাজ তাঁরা দেখতে পায় নি। কিন্তু বুঝতে পেরেছিল শুনতে পেরেছিল । তারপর ও সেসব আসনের একটিও খালি ছিল না সেদিন। মজার ব্যাপার হচ্ছে যখন ই দাঁড়িয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করছিলেন তখন ই জাকির সাহেব একবার পেছন ফিরে তাঁদের ও জানিয়েছিলেন সাদর সম্ভাষণ ।
মার্জিত পরিমিত জীবন ছিল তাঁর। বড় বড় সংগীত তারকারা পানাসক্তি কাটাতে দীর্ঘ সংগ্রাম করেছেন, তবে জাকির হোসেনকে নেশা কখনো ছুঁতে রেনি। এ প্রসঙ্গে ২০১১ সালে প্রথম আলোকে তিনি বলেছিলেন, ‘যে সংগীত আমি পরিবেশন করি, এগুলো তো তার চেয়ে বেশি উত্তেজক নয়। এগুলো তো আমাকে সংগীতের চেয়ে বেশি গভীর মাত্রার উপলব্ধি, উত্তেজনা বা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারেনি। তাই অন্যদিকে তাকানোর কোনো তাগিদই আমার ছিল না।’
তাঁর জীবনে তিনি অর্থের জন্য ক্লাব পার্টি বা ঘরোয়া কোন অনুষ্ঠানে কোনদিন তবলা বাজান নি। তাঁর মতে এসব জায়গায় মানুষ কিছু শুনতে যায় না। এটা মানুষের সামাজিক পারিবারিক আনন্দের জায়গা। এখানে শিল্প হয় না। এমন নীতিপ্রবণ সৎ মানুষ না হলে কি আর এতো বড় হওয়া যায়?
তিনি আজ নাই। কিন্তু রেখেগেছেন দুটি যোগ্য সন্তান। এই দম্পতির সংসারে দুই মেয়ে রয়েছে। দুজনেরই জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোতে। বড় মেয়ে আনিসা কুরেশির বয়স ৩৯ বছর। ইউনিভার্সিটি অব কালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে স্নাতকোত্তর আনিসা পেশায় একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজক।জাকির হোসেন ও আনতোনিয়া মিনেকোলার ছোট মেয়ে ইসাবেলা কুরেশির বয়স ৩৭ বছর। ইসাবেলা নৃত্যশিল্পী হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। নাচ নিয়ে ডিগ্রিও রয়েছে তাঁর।
জাকির হোসেন সব সময় চেয়েছেন, তাঁর সন্তানেরা গৎবাঁধা অফিসের কাজের বাইরে সৃজনশীল কিছু করুক। বাবার চাওয়াতেই সৃজনশীল কাজে যুক্ত রয়েছেন আনিসা ও ইসাবেলা। আমার এই সাধারণ জীবনের এক বিরল অভিজ্ঞতা সামনা সামনি বসে জাকির হোসেনের তবলা বাদন শোনা ও দেখা। পরপারে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি। মহাকালের খাতায় এক অনিবার্য নাম জাকির হোসেন।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।