দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | রবিবার , ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৭:৩৯ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের আন্দোলন এবং ছাত্র সমাজের ভূমিকা ওপার বাংলায় যে প্রভাব ফেলবে এটা অনুমান করা কঠিন কিছু নয়। একভাষা এক চেহারার মানুষ আমরা। তবে তাদের শক্তির কথা জানি না কিন্তু সাহস আমাদের চাইতে কম। এর কারণ এমন ও হতে পারে গণতান্ত্রিক দেশে সমাজে বসবাসের কারণে তাদের আচার আচরণ গণতান্ত্রিক হয়ে গেছে। এটা মানতে হবে কলকাতা বা পশ্চিম বাংলায় ঘুষ দুর্নীতি অপশাসন কম কিছু না হলেও আমাদের মতো হাজার হাজার কোটির গল্প নাই: যা আছে তা হাতে গোণা।

বলছিলাম এবার গত কিছুদিন থেকে মহাবিপাকে আছেন মমতা ও তৃণমূল। তৃণমূল যে এতো তাড়াতাড়ি এমন একটা বিপদে পড়তে পারে এটা কল্পনা করা যায় নি। মমতা ব্যানার্জীর মূল শত্রু তার মুখ। উভয় বাংলায় শীর্ষ নেতার মুখ বিষধর সাপের ফণার মতো। আমাদের জন ধরাকে সরা জ্ঞান করতেন। তাঁকে মাননীয় থেকে মাতা মাতা থেকে দেবীতে পরিণত করা হয়েছিল। শেষটায় এমন মনে হতো কোনকালেও তাঁর বিরুদ্ধে ন্যায্য কথা বলা যাবে না । সবচেয়ে মজার ছিল স্তাবকদের তোষামোদী আর তৈলাক্ত সব প্রশ্নের নামে পায়ে পড়া। মমতার বেলায় এমন কিছু দেখি নি। কারণ তিনি নিজেই এক মহা চরিত্র। গান গাইছেন ভুল সুরে ভুল কথায় , ইচ্ছেমতো রবীন্দ্রনাথের গানের কথা বদলে দিচ্ছেন । কবিতার নামে কৌতুক করছেন ভরা মজলিশে। এপাং ওপাং ঝপাং নামের কবিতা তাকে ঘিরে সেখানকার বুদ্ধিজীবীদের উল্লাস দেখে মনে হয় বাংলার সর্বনাশের আর কিছু বাকী নাই।

তবে মমতার বড় সাহস জনগণের ভোট। মমতার দল বিনা ভোটে রাতের ভোটে ব্যালেট হীন বাক্সে জিতে আসে নি। ছোটখাটো ঘটনা বাদে তার দল জিতেছে জনগণের ভোটে। যখন সেটা হয় তখন শাসকের পা থাকে মাটিতে। মমতা বিদ্রোহ দমনে পুলিশকে ব্যবহার করেছে এটা যেমন ঠিক তেমনি পুলিশ ও তার ভাষায় লাশ তুলে দেয় নি। লাশ ফেলেনি বলেই আন্দোলন আরো ব্যাপক রূপ নিতে পারে নি এখনো। এই আন্দোলন কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা এখন ই বলা মুশকিল ।

তবে কলকাতার মানুষজন ও পথ চিনে গেছে। তাদের এমন সহিংস ভয়াবহ রূপ আমি আগে দেখেনি। বাম সরকারের সময় অল্প ঘটনাতেই সরকারের গদী টলে গিয়েছিল। দীর্ঘকালের বাম শাসন ঝরে গিয়েছিল চোখের পলকে। সেখানে পট পরিবর্তন ঘটে ভোটে। এবার কি হবে না হবে তার উত্তর দেবে সময়। আপাতত আমরা দেখছি অস্থির এক পশ্চিম বাংলা। এই অস্থিরতা যে প্রভাব ফেলছে তার দায় মেটাতে হবে। কারণ গণরোষ কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। মমতাকেও ছেড়ে কথা বলবে বলে মনে হয় না। কিন্তু সমাজে যে কুপ্রভাব তার সাথে অনেক কিছু মিলে যাচ্ছে। আমরা বড় দুর্ভাগা জাতি। আমাদের কপালে গণতন্ত্র জোটে নি। পাকিস্তান আমলে সেনা শাসকদের ডান্ডা এরপর স্বাধীনতা। আমরা ভেবেছিলাম স্বাধীন দেশে আমরা সবাই মিলেমিশে থাকব। এক জাতি এক ভাষা এক ধরনের মানুষ। এমন সমাজে কে কাকে মারবে? কিন্তু তা সত্য হলো না। স্বাধীনতার পরপর ই হত্যা করা হয়েছিল পরাগ মতিউর কে। ছাত্র ইউনিয়নের এই দু জন কর্মী স্বাধীন বাংলার প্রথম শহিদ। আমেরিকান দূতাবাসে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে মৃত্যুবরণকারী এ দুই ছাত্র স্বাধীন দেশের প্রথম সরকারের কলংক। এরপর আমরা পঁচাত্তরের হত্যাকান্ড দেখেছি। একের পর এক মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার মাধ্যমে দেশকে মুক্তিযোদ্ধা বিহীন করার চক্রান্ত দেখেছি।

এতো রক্ত ত্যাগের পর ও দেশে গণতন্ত্র জায়গা করতে পারেনি। মাঝে মধ্যে একটু আশার ঝলক দেখা গেলেও মূলত সবসময় ই কোন না কোনভাবে একনায়কী মনোভাব এসে ভর করতে। যার চূড়ান্ত রূপ জাতি দেখেছিল গত এক দশকে। কথা বলা ভাবনা এমনকি মনে মনে ভাবাটাও যেন বন্ধ হবার পথে ছিল।

আমরা সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্পে পড়েছিলাম, একটি তোতা পাখিকে ভারত থেকে ধরে নিয়ে গেছিলেন এক আরব সওদাগর। তোতাটিকে খুব ভালোবাসতেন মনিব। সোনার খাঁচায় রেখে তাকে দামী দামী খাবার খাওয়াতেন। কিন্তু তোতার মন ভরতো না। সে চাইতো নীল আকাশে ঘুরে বেড়াতে। তার সতীর্থ তোতাদের সাথে উড়তে। এমন ই এক সময় সওদাগর ঠিক করলেন তিনি বানিজ্যে যাবেন। আবার ও ভারতে যাবেন তিনি। যাবার আগে সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন কার জন্য কি আনবেন? একদিন তোতা পাখিটিকেও জিজ্ঞেস করলেন তার কি চাই? তোতাটি মনিবকে অবাক করে দিয়ে বলেছিল: হুজুর সে দেশে যদি আমার কোন বন্ধু বা যে কোন তোতার সাথে দেখা হয় দয়া করে জানবেন আমার মুক্তির পথ কি? সওদাগর মনে মনে রাগ করলেও মুখে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে।

বেশ কিছু মাস পর বাণিজ্য শেষে বাড়ি ফিরলেন সওদাগর। দাস দাসী আত্মীয় স্বজনদের যার যার জিনিস বুঝিয়ে দিলেও তোতার ঘরে ঢোকেন না। একদিন কি কারণে যেন ভুল করে ঢুকে পড়তেই তোতাটি সালাম দিয়ে বলে উঠল, হুজুর সবার মুখে কত গল্প শুনি। আমি ভারতের এক জঙ্গলে তোমার সতীর্থ পাখিদের দেখা পেয়েছিলাম। তাদের কাছে তোমার মুক্তির কথ জানতে চাওয়ায় সেখান থেকে একটি তোতা মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে মরে যায়। তাই আমি তোমাকে কিছু বলি নি। এ কথা শেষ হবার পরপর ই ঝুপ করে একটা শব্দ হলো। হতচকিত সওদাগর প্যেন ফিরে দেখে খাঁচার তোতাটিও মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। মরেই গেছে হয়তো। দুঃখ পেলেও তিনি খাঁচাটির দুয়ার খুলে ফেলে তোতাকে বাইরে ফেলে দেয়ার আগেই সে ডানাঐ যে তোতাটি আপ মেলে উড়াল দিল। নাগালের বাইরে গিয়ে বলল: হুজুর ঐ যে তোতাটি আপনার কথা শুনে পড়ে গিয়েছিল সে মরে নি। সে আমাকে মুক্তির পথ বাতলে গিয়েছে । তার কারণেই আজ আমি মুক্ত বলেই আকাশে উড়াল দিল তোতা।

এটাই স্বাধীনতা। যুগে যুগে কালে কালে বিদ্রোহ বা আন্দোলনে যারা প্রাণ দেন তারা মরেন না তারা বাকীদের মুক্তির পথ দেখিয়ে যান। সেটা আমাদের দেশে হোক আর পশ্চিম বঙ্গেই হোক মুক্তি গণতন্ত্র আর স্বাধীনতার তোতা পাখি কখনো চিরকাল শেকল বন্দি খাঁচায় থাকে না। এটাই সত্য।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ
পরবর্তী নিবন্ধরাঙামাটিতে ৫২ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত