দূরের দুরবিনে

চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট, বিস্তৃত হোক উড়াল পথ

অজয় দাশগুপ্ত | রবিবার , ২৩ জুন, ২০২৪ at ১০:৩৬ পূর্বাহ্ণ

দুনিয়ার বহু দেশের বড় বড় এয়ারপোর্ট থেকে উড্ডয়ন ও সেখানে অবতরণের অভিজ্ঞতা আছে আমার। আজকাল আমরা সবাই এদেশ ওদেশ ঘুরে বেড়াই। ভ্রমণ পিপাসু মানুষের জন্য দুনিয়া এখন অবারিত। ছোট বড় যে কোন বিমান বন্দরের চাইতে আমার প্রিয় এয়ারপোর্ট চট্টগ্রামের শাহ আমানত(🙂 বিমান বন্দর। ছোট হলেও এর বুকে আমার অনেক স্মৃতি জমা আছে।

জীবনের প্রথম বিমান ভ্রমণ স্বাধীনতার পরপর কলকাতা থেকে আগরতলায় যাওয়া। স্বাধীন দেশে ফেরত আসার সূচনা লগ্নে এটাই ছিল প্রথম আকাশ ভ্রমণ। এরপর কলকাতা যশোর ঢাকা সব ভ্রমনের উৎস ছিল চট্টগ্রাম বিমানবন্দর। এক সময় পতেঙ্গার ছোট এয়ারপোর্টটি স্থানান্তরিত হয়ে আকারে বড় হয়েছে। বিমান চলাচল ও বেড়েছে। এখন এর কার্যক্রমে গতি এসেছে। আমাদের সময় বড় জোর দুটি বিমান সকাল সন্ধ্যা ঢাকা দৌড়াতো। সপ্তাহে একবার যেতো কলকাতা। সে সব সংখ্যা এখন অনেক বেশী। নান্দনিক গাছপালা শোভিত ঢোকার রাস্তাটিও ভালো লাগে। ঢুকে পড়লে হয়রানি নাই। আগের মতো দাঁড়িয়ে থাকা বিলম্বিত যাত্রাও নাই। মাঝে মধ্যে সেসব হলেও সাধারণত যাত্রা সহজ ও নির্বিঘ্ন।

আমার স্বপ্ন ও স্মৃতিতে মিশে থাকা এই বিমানবন্দরের জায়গা হৃদয়ে। কিন্তু আজ আমি একটি সমস্যার কথা বলতে চাই। খুব বেশীদিন আগের কথা না আমরা ব্যাংকক থেকে চেংমাই হয়ে চট্টগ্রাম এসে নামতে পারতাম। মাঝে এমন ও হলো থাই এয়ারের পাশাপাশি সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের সিস্টার্স কনসারণ সিল্ক এয়ারের চমৎকার ফ্লাইটগুলো চলতো চট্টগ্রাম থেকে। আমেরিকা ইউরোপ অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড সহ নানা দেশের প্রবাসীরা অনায়াসে চট্টগপাম পৌঁছে যেতেন। হঠাৎ করেই এগুলো বন্ধ হয়ে গেলো। কিছু বছর আগে রিজেন্ট এয়ার নামে একটি বেসরকারী বিমান পরিবহন সংস্থার বিমান চলতো থাইল্যান্ড থেকে। তারা এখন ব্যবসায় নাই। সব মিলিয়ে আমরা যারা দূরদেশ থেকে চট্টগ্রাম যাই আমাদের কপালে জোটে দুর্ভোগ আর সময়ের অপচয়।

প্রবাসীরা দেশে যান একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। এবং ছুটিও সে ভাবেই নেয়া থাকে। কষ্টার্জিত দু তিন সপ্তাহর ছুটির দু তিনদিন যদি অকারণে যাত্রা পথে চলে যায় এর চাইতে দুঃখের আর কিছু হতেই পারে না। আমাদের এবারের যাত্রায় ও তেমন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। দীপার বাবার শরীর খারাপ হবার কারণে তড়িঘড়ি ছুটি ম্যানেজ করে আমরা দেশে গিয়েছিলাম। ঢাকা পৌঁছানোর পর তিনদিন আটকে থাকতে হয়েছিল। রাস্তায় পানিবদ্ধতা আর ঝড়ের কারণে। জানি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ওপর কারো হাত নাই। কিন্তু যাত্রা যদি চট্টগ্রাম পর্যন্ত হতে পারতো আমরা অনায়াসে বাড়ি পৌঁছে যেতে পারতাম। শুধু তাই নয় প্রবাসীরা কষ্ট করে তাদের মালপত্র প্রিয়জনদের জন্য তারা আনেন না বা বয়ে নিয়ে যান না এমন বস্তু বিরল। বড় বড় সব স্যুটকেস আর ব্যাগ দেখলেই আপনি হাঁপিয়ে মরবেন। এইসব বড় সড় ব্যাগ আর ট্রলি ব্যাগ নিয়ে ঢাকায় কারো বাড়িতে অতিথি হওয়াটা লজ্জার মনে হতেই পারে। সবার তো ঢাকায় নিকটাত্মীয় থাকে না। বলবেন, হোটেলে নয় কেন? দেশে গিয়ে বাড়ি পৌঁছানোর আগে হোটেলে অতিথি হতে চাইবে কোন বেকুব ? আর একটা বিষয় হচ্ছে সময়। এখন দেখছি মালয়েশিয়ান সিঙ্গাপুর হংকং থেকে আসা সব উড়োজাহাজগুলো মধ্য রাতে ঢাকায় অবতরণ করে । আপনি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন মাঝ রাতের ঢাকা প্রবাসীর জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ ? এবার আমাদের বেলায় আরো জটিল ছিল পরিস্থিতি । আমাদের এক সপ্তাহ পর আমার ছেলে এসেছিল হংকং হয়ে। তার বিমান ঢাকা শাহজালাল (🙂 বিমান বন্দরের রানওয়ে স্পর্শ করেছিল রাত একটায়। সবকিছু শেষ করে বের হতে হতে রাত দুটোর বেশী। এই শেষ হয়ে আসা রাতে সে কোথায় যাবে? বিশেষ করে দীর্ঘ সময় পর দেশে যাওয়া ইয়াং ম্যানদের কথা ভাবুন। তাদের বাংলা বলা ও বোঝার ঝামেলা আছে। তারা আমাদের দেশের বিলম্ব বা দেরী করানোর কানুনগুলো বোঝে না। বাধ্য হয়ে আমাকে আরো একবার ঢাকা দৌড়াতে হয়েছিল তাকে রিসিভ করার জন্য।

আমার মতো এমন অনেক মানুষ আছেন যারা চট্টগ্রাম পৌঁছাতে পারলে এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। একটা সময় তো সে ব্যবস্থা ছিল। আমি নিজে একাধিক বার থাই এয়ার ও সিঙ্গাপুর এয়ার লাইনসে চেপে চট্টগ্রাম যাতায়াত করেছি। যতটুকু জানি সার্ভিস বা সেবা বন্ধ করার কারণ নাকি রাজনীতি। কোন রাজনীতি বা রাজনৈতিক টানাপোড়নে এসব চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে ঠিক জানি না। আচ্ছা এই সমস্যাগুলোর কথা কি চট্টগ্রামের মেয়র বা সিভিল এভিয়েশনের কর্তারা জানেন না? চট্টগ্রাম একটি প্রাচীন নগরী। এই সেদিন মাছরাঙ্গা টিভির সকালের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানেও আমি চট্টগ্রামের কথা বলতে গিয়ে এর বহুজাতিকতা আর বন্দর নগরীর কারণে বহুমাত্রিকতার কথা বলেছি। পর্তুগিজ শিখ ইউরোপিয়ান আর্মেনিয়ান কে আসে নি? দুনিয়ার কত দেশের মানুষ এসেছিল চট্টগ্রামে। আমাদের শৈশবে আফগানিস্তানের মানুষজন যাদের নাম ছিল কাবুলিওয়ালা তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে হিং বাদাম পেশতা ফেরী করতেন। ইরানী মানুষজন খুলতেন হোটেল। চৈনিক দাঁতের ডাক্তার আর চীনাদের জুতা ছিল চট্টগ্রাম বিখ্যাত। আরব ভারত এশিয়ার নানা দেশের মানুষের তীর্থ ছিল চট্টগ্রাম।

এই শহরে বিত্তবান মানুষের অভাব নাই। চিরকালই চট্টগ্রাম আর সিলেট হচ্ছে দেশের বিত্তশালীদের এলাকা। বিশেষত: চট্টগ্রাম বিত্ত বৈভবে এক নাম্বারে দাঁড়িয়ে। খালি মধ্যপ্রাচ্য বা ইন্ডিয়া গামী মানুষের ভরা চট্টগ্রাম এই ধারণা ভুল। বরং দেশের মানুষের আয় উন্নতি আর সামগ্রিক উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে চট্টগ্রামের মানুষ এখন দুনিয়ার সব দেশে ডানা মেলেছে। আমাদের সিডনি শহরে বা অন্যান্য শহরে ও চট্টগ্রামের মানুষ প্রচুর। যারা বছরে একবার এবং প্রয়োজনে একাধিক বার চট্টগ্রামে উড়াল দেয়। তাদের প্রত্যেকের কপালে থাকে একই ধরনের দুর্ভোগ।

কে এর জন্য দায়ী বা কার কারণে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ হলো সে প্রশ্ন তুলে লাভ নাই। আমাদের প্রশ্ন, কবে এবং কিভাবে এই চলাচল আবার শুরু করা সম্ভব? আমি এ কথা হলফ করে বলতে পারি শুরু হলে বিশ্বের বহু দেশের বিশেষত: এশিয়ান দেশের বিমান সংস্থাগুলো এগিয়ে আসবে। সিভিল এভিয়েশন এখন ভালো ব্যবসা। কোভিডের ধকল কাটিয়ে আবার জেগে উঠেছে আকাশ পথ। আমি গত দু তিনবারের ভ্রমণে দেখেছি মানুষে মানুষে সয়লাব। এমন সুবর্ণ সময়ে চট্টগ্রামের বিমান বন্দর কেন আয় উপার্জন ও ব্যবসা থেকে বঞ্চিত হবে?

জানি না মাননীয় মেয়র না সিভিল এভিয়েশনকর্তাদের দায়িত্ব শুধু এটুকু জানি আমরা যারা প্রাণের টানে মনের টানে রক্তের টানে চট্টগ্রাম যাই জন্মভূমির টানে ছুটিআমাদের কষ্ট লাঘব হবে । আপনারা নজর দিলে সমস্যার সমাধান কল্পে এগিয়ে এলে চট্টগ্রাম বিমান বন্দর যেমন ফুলে ফেঁপে বড় হয়ে উঠবে তেমনি আমরা প্রবাসীরা সহজে ফিরতে পারবো চট্টগ্রামে। কেউ কি আমাদের কথা শুনবেন আদৌ?

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ
পরবর্তী নিবন্ধপেকুয়ায় ফুটবল খেলতে গিয়ে সাপের দংশনে কিশোর আহত