দূরের দুরবিনে

উজ্জয়নী, বিজয়িনীদের গল্প

অজয় দাশগুপ্ত | রবিবার , ৯ জুন, ২০২৪ at ৮:৪৬ পূর্বাহ্ণ

আমাদের দেশে আমাদের সমাজে মাঝে মাঝে এমন সব নারী জন্ম নেন যাঁরা দেশ সমাজ কালের গন্ডি পেরিয়ে বড় হয়ে ওঠেন। সেই কবে এদেশে বেগম রোকেয়ার জন্ম হয়েছিল। ভাবা যায় সে সময় অবরোধবাসিনীতে মনের সব কথা লিখেছেন যা এখনো পুরুষেরা নিতে পারবে না। ১৮৮০ সালে জন্মেছিলেন।পিতার ভয়ে চৌহদ্দি পার হতেন না, ষোল বছরে উর্দুভাষী সাখওয়াৎ হোসেনের সাথে নিকাহ, অথচ মাথায় ঢুকে ছিলো স্বামী বিবেকানন্দের বাণী। কি সেই বাণী? “পাখি কখনো এক ডানায় উড়িতে পারে না

একটি ডানার নাম পুরুষ তো আরেকটি নারী। কী দুঃসাহস বললেন কি না, জাগো মা তুমি দাসী নও, জাগো বোন তুমি কোন জড়োয়া গহনার বাক্স নও। নও সাজানো অলংকার। সে যুগের মুসলিম নারীদের স্যালুট জানাই। রংপুরের পায়রাবন্দের মেয়ের Sultana’s dream হয়ে গেলো ইউরোপ স্বীকৃত ক্লাসিক। এখন হলে এই স্বপ্নের নাম কেন খোয়াব রাখা হয় নাই এ কারণে মারা পড়তেন আপনি।

অবরোধ বাসিনীতে অবরোধের বিরুদ্ধে প্রথা ঘেরাটোপের বিরুদ্ধে যা লিখেছেন জানলেও খবর আছে আপনার। তবে একটা কথা, আপনি নাই তো কি হয়েছে? আপনার মূর্তি ভাস্কর্য ছায়া থাকলেও উপড়ে নর্দমায় ফেলে দেবে কিন্তু।

ছিলেন বটে কালজয়ী বাঙালি নারী এবং অলৌকিক এক শক্তির আধার। না হলে কি ৯ ডিসেম্বর জন্মে ৯ ডিসেম্বরেই বিদায় নিতেন আপনি? রবীন্দ্রনাথ কেন জানি সব জানতেন। এই লোকটা বুঝলেন মনো বিজ্ঞানী, ঈশ্বরের দূতও। কতো আগে লিখে রেখে গেছেন, আজি দুর্দিনে ফিরানু তাদের ব্যর্থ নমস্কারে/ যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু / নিভাইছে তব আলো/ তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ / তুমি কি বেসেছো ভালো?

যখন আপনি আত্মাহুতি দিয়েছিলেন তখন আমরা ছিলাম পরাধীন। বৃটিশ শাসনের অধীনে পরাধীন কিন্তু অন্তর্জগতে স্বাধীন একটি অসামপ্রদায়িক জাতি। আপনাদের ধারণা ছিলো বৃটিশ গেলেই বাংলা মুক্ত হবে। বাঙালি আবার তার পাল সেন বা আকবর আমলের সৌন্দর্যে এক হয়ে বসবাস করবে। কিংবা ভেবেছিলেন স্বাধীন দেশে বাঙালি হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টান থাকবে আত্মীয়ের মতো।

সে আত্মত্যাগ যে কারনেই হোক আপনি চাইলেই একটা স্বাভাবিক সুন্দর জীবন যাপন করতে পারতেন। পিতা জগদ্বন্ধু বাবু হেড কেরানী। কিন্তু মেয়ে তার প্রতিভাময়ী। মেয়ের মায়ের নামও যে প্রতিভা দেবী। মেয়েটি ঢাকা ইডেন কলেজে আই এ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম সম্মিলিত মেধা তালিকায় হল পঞ্চম। জলপানির বিশ টাকায় তার পড়ার খরচ চলবে বলে চলে গেলেন বেথুন কলেজে। সে কলেজে তার অধীত প্রিয় বিষয় ছিলো দর্শন। এ নিয়ে অনার্স করার ইচ্ছে থাকলেও দেশপ্রেমের বিপ্লবী চেতনা তখন তার মগজকে প্রভাবিত করে ফেলায়, পারেন নি। কিন্তু বিএ পাস করেন ডিস্টিংশন নিয়ে।

এগুলো বলার উদ্দেশ্য একটাই। এতো মেধাবী একটি মেয়ে যে কিনা নব্বই বছর আগে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করলেন চাইলে কতো কিছু হতে পারতেন। নাটক লিখেছেন সে বয়সে। বেথুন কলেজের ছাদে বসে বাঁশী বাজিয়ে মন জয় করেছিলেন সবার। কিন্তু তাঁর মনজুড়ে তখন স্বদেশ আর বিপ্লবী সূর্য সেনের চেতনা।

সে বয়সে বেপরোয়া এই তরুণী কেন এমন একটি অপারেশনে যোগ দিয়েছিলেন যা তাঁকে বাঁচতে দেয় নি? এর কারণ জাতির জন্য বাঙালির আত্মমর্যাদার জন্য তাঁর ভালোবাসাবোধ। পাহাড়তলীর চূড়ায় বৃটিশদের ক্লাবঘরে কি সাইনবোর্ড ঝুলতো জানেন?

কুকুর ও দেশীয়দের প্রবেশ নিষেধ। এই কালো দেশীয় মানে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা। তরুণী এই অপমান মেনে নিতে পারেন নি। দু বারের ব্যর্থতার পর তাঁর নেতৃত্বে শুরু হয় মরণ অভিযান। এক পর্যায়ে যখন ধরা পড়ার সময় এলো তিনি বেছে নিলেন স্বেচ্ছামরণ। পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহুতি দিলেন বটে হয়ে রইলেন প্রথম নারী শহীদের উজ্জ্বলতম তারকা।

কিন্তু আপনি কী জানেন আজকের স্বাধীন সমাজে রাষ্ট্রে প্রীতিলতা সৌজন্যের ফুলমালা আর পুষ্পস্তবকের আড়ালে মুছে যাওয়া এক নাম। যে নামের সাথে ধর্ম পরিচয় জড়িয়ে তাঁকে নিরন্তর অপমান আর এড়িয়ে চলাই নিয়ম? আপনার কথা কবিতা গদ্যে নাটক গানে মিটিমিটি তারা মতো জ্বললেও তার খবর পায় না মানুষ।

জানি না চলে যাবার পর মানুষের আত্মা বলে আসলেই কিছু আছে কি নাই। থাকলে আপনি আজ শোকার্ত হতেন। এই বাংলায় নারীশক্তির মতো আতংক আর বিপদে কে আছে এখন? তার ঘরে বাইরে সমাজে শুধু হায়েনা আর লোভীদের বিচরণ। আপনার বিদায়ের পর এই ভূখন্ড দু দু বার স্বাধীন হবার পর ও নুসরাত মিতু কিংবা এমন অনেকে নিরাপদে জীবনযাপন করতে পারে না। জেনে অবাক হবেন না ঝুমন দাসের মতো নিরীহ মানুষও পচে মরে অন্ধকারে।

মুক্তির মন্দির সোপান তলে কতো প্রাণ হলো বলীদান বলে যতোই গর্ব করি না কেন আপনার আত্মদান আজ সত্যি বিবর্ণ, শুধু ইতিহাসে আর কিছু মানুষের মনে সে এক শক্তির আধার।

প্রণাম আপনাকে বীরকন্যা।

রাজনৈতিক চেতনার দিক থেকে মধ্যপন্থী ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু তাঁর বিশ্বাস ও ভাবনা কী সেটা তাঁর বাড়ীতে আসা একটি টেলিফোন কলেই বোঝা গিয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদ লিখছেন, কন্যার ব্যগ্রতা ও ছুটোছুটি দেখে তিনি বুঝতে পারছিলেন বিশেষ কেউ ফোন করেছেন। এবং ফোন তুলে তিনি যখন শুনলেন এই মহীয়সী রমণীর কন্ঠ নিজেও আপ্লুত হয়েছিলেন। তিনি ফোন করেছিলেন এই আনন্দ একজন বিখ্যাত জনপ্রিয় লেখকও তাঁর পরিবারকে এতোটা আপ্লুত করার কারণ অনেক।এমনই ক্যারিশমা ছিলো এই নারীর। দেশের জনপ্রিয়তম লেখক থেকে কথা শুনতে ও কথা রাখতে অবাধ্য নেতাদেরও তিনি এক কাতারে এনেছিলেন।

সাধারণ মানুষ যারা ধরে নিয়েছিলেন বাংলাদেশ চলবে ককটেলে। যে ককটেলের কিছু পাকিস্তান কিছু ভারত বাকীটা ধর্ম। এদেশে রাজাকার দালালদের সে নামে ডাকা যাবে না। পাকিস্তানি বাহিনীকে বলতে হবে হানাদার বাহিনী। মুজাহিদ ও নিজামীর গাড়ীতে উড়বে পতাকা ও সা কা চৌধুরীর মুখ থেকে শুনতে হবে অশ্রাব্য সব মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কথা।

এমন কঠিন সময়ে জাতিকে উজ্জীবিত করা নারীটি এলেন কোথা থেকে? পিতার আনুকূল্যে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে উচ্চ শিক্ষা শেষ করে ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী গার্লস স্কুলের টিচার। টানা চোখ উন্নত ললাট বাঁশীর মতো নাক। সুচিত্রা সেনের আদলে সুখী নারী। স্বামী সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। নিজে তখন ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী গার্লসের প্রধান। দুই পুত্র নিয়ে এলিফেন্ট রোডে সোনার সংসার। কিন্তু ইতিহাস যে বসে ছিল কণিকা নামের ঐ বাড়িতে ঢোকার অপেক্ষায়।পুত্র রুমী এসে দাঁড়িয়ে ছিলো মায়ের কাছে। অনুমতি চায়, কিসের অনুমতি? রুমীর কথা একটাই। বিদেশ গিয়ে পড়াশোনা করে বিত্ত সুখ সব হবে কিন্তু বিবেক তো শান্তি পাবে না। তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সে যদি তার যৌবন দেশমুক্তির জন্য উৎসর্গ না করে এই পাপ বহন করতে হবে আজীবন। ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়ানো মা এক মুহূর্তে হয়ে উঠেছিলেন জননী। পুত্র কে কোরবানি দিলেন দেশমাতৃকার জন্য। রুমী হয়ে গেলো ইতিহাস। পুত্র শোকে পিতাও হলেন লোকান্তরিত। পড়ে রইলো কুরুক্ষেত্র বাংলাদেশ পড়ে রইলেন মা।

এই মা ই আমাদের ভগ্নি প্রীতিলতা। বীরকন্যা বেগম রোকেয়া। তিনিই আমাদের জননী জাহানারা। জাহানারা নামের মতোই ইতিহাসের শোভিত বাগান। যিনি না হলে পুরুষ নেতৃত্ব মুখে যাই বলুক ইতিহাস শুদ্ধ করতে পারতো না। যুদ্ধাপরাধীর বিচার বা শাস্তি ও হতো না এ দেশে। রাজনীতি কি বলে কেন বলে কখন বলে তার ধার ধারি না।

শুধু জানি শহীদ জননী আপনি আমাদের মা।

আমাদের ইতিহাসে জননীরা এভাবেই বারবার জেগে ওঠেন। এখনো দেখুন, চারদিকে পুরুষতন্ত্রের বাড়াবাড়ি। অথচ এই দেশ চালিয়েছে চালাচ্ছে নারী শক্তি। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আপনি যা বলেন বা ভাবেন তাতে কিছু আসে যায় না। তিনি নারী শক্তির এক উজ্জ্বল প্রতীক। ভালোভাবে বিবেচনা করলে ইন্দিরা গান্ধী ও বেনজির ভুট্টোর পর এমন সাহসী স্বাধীনচেতা নারী নেতা আর পায় নি এই উপমহাদেশ। তিনি আছেন বলেই তরতর করে এগিয়ে চলেছে দেশ। আজ বিশ্বের সব মোড়লদের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারা এই নেতা একজন নারী।

শেষ করব ক্রীড়া ও বিজ্ঞানে নারী অগ্রগতির কথা বলে। কল সুন্দরের সেই মেয়েগুলো ক্রিকেটের অর্জনপ্রিয় অচেনা মেয়েরা আমাদের বারবার বড় করে তোলে। আমরা যখন পুরুষদের খেলাধুলায় মুখ লুকিয়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে আসি তখন এরা একেকবার জ্বলে ওঠে । তারার মতো ফুটে থাকে বাংলার আকাশে । বিজ্ঞান থাকবে কি থাকবে না এমন একটা বাস্তবতার মুখে দাড়িয়ে সেঁজুতি সাহা যখন বিশ্বালোকের আলোয় উদ্ভাসিত হয় তখন আমরা জেনে যাই বাংলাদেশের দুর্ভাবনার কারণ নাই। তার মেয়েরা সে জয়িতা যে যে কোন অন্ধকারে আলোর সন্ধান দিতে পারে। আমি কন্যা জায়া জননীর এই শক্তিকে শ্রদ্ধা জানাই। তাদের কাছেই শক্তি ও সাহসের ভরসা রাখি।

লেখক : সিডনি প্রবাসী কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ
পরবর্তী নিবন্ধলোহিত সাগরে দুটি জাহাজকে লক্ষ্যবস্তু করার দাবি হুথিদের