দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | রবিবার , ১২ মে, ২০২৪ at ১১:৩৮ পূর্বাহ্ণ

মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে/ মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে/ তুমি যাচ্ছো পালকিতে মা চড়ে আমার কাছে অজানা মায়ের এমন সুন্দর ছবি দ্বিতীয় কিছু নাই। অজানা বললাম কারণ রবীন্দ্রনাথ মূলত তাঁর মাকে জানার আগেই তিনি পরলোকে পাড়ি জমিয়েছিলেন। এই যে মা হারানো বেদনা নীলকন্ঠ রবীন্দ্রনাথ সে বিষ হজম করে আমাদের অমৃত দান করে গেছেন আজীবন।

মা আমাদের কাছে ভীষণ স্পর্শকাতর একটি নাম। মাকে নিয়ে যত গল্প কবিতা এমনকি উপন্যাস বা নাটক তার ছিটেফোঁটা ও বাবাদের ভাগ্যে জোটে না। একসময় এ নিয়ে ঈর্ষা হলেও এখন আর হয় না। ম্যাক্সিম গোর্কির দুনিয়া কাঁপানো মা আমাদের জানিয়ে গেছে মায়ের প্রকৃতি কি হতে পারে ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় নির্মিত একটি চলচ্চিত্রের নাম ছিল টু উইম্যান। বিশ্বখ্যাত অভিনেত্রী সোফিয়া লরেনের অসাধারণ অভিনয় সমৃদ্ধ ছবি। ছবিতে তিনি ছিলেন এক নির্যাতিতা মা। যিনি নাৎসীদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিলেন। মুক্ত হবার পর তাঁর সাথে কন্যার দেখা হয়েছিল। খুঁড়িয়ে হাঁটতে থাকা মা মেয়ে একে অপরকে দেখার পর বুঝতে পারে কি হয়েছিল তাদের ওপর। সে অবিস্মরণীয় মায়ের মুখ আমি এখনো চোখে দেখতে পাই। যিনি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন তুমি এখন একজন নারী বা উইম্যান। ছবিটির নামই তাই টু উইম্যান।

মা যে কি তার অনেক ধরনের উদাহরণ দেয়ার কোন দরকার পড়ে না। দুনিয়া কাঁপানো একটা ছবি আছে। যেটিতে মা সন্তানকে বাঁচানোর জন্য মিলিটারির কাছে খুলে ধরেছেন নিজেকে। ঠিক যেমন আর একটি ছবিতে হিংস্র নেকড়ের মুখে সমর্পিত হরিণ আগলে রেখেছে তার শাবককে। আপনারা জানেন অস্ট্রেলিয়ার দাবানল খুব সাংঘাতিক। গ্রীস্মকালে দাবানল থেকে দূরে সিডনি শহরে ও আমরা স্বস্তি পাই না। পোড়া গন্ধ আর ভারী বাতাসে নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। পালিয়ে ঘরে ঢুকতে পারলেই জীবন বাঁচে। এমন এক দাবানলে যখন দাউ দাউ করে সবকিছু জ্বলে ছাই হয়ে যাচ্ছিল বাচ্চাটিকে পরম মমতায় আগলে রাখা ক্যাঙারু মা জীবনের পরোয়া করে নি। এই এক প্রাণি যার কাছে আপনি অনায়াসে জানতে পারেন মা কাকে বলে। ক্যাঙ্গারু তার সন্তানকে বুকে করে কোলে করে ঘুরে বেড়ায় । এতে তার কোন ক্লান্তি নাই।

নিজের মায়ের কথা একটু বলি। মধ্যবিত্তের পরিবারে মা হচ্ছে এক আশ্চর্য প্রদীপের নাম। ঘষা দিলেই হাজির হয়ে যেতো সব।

বাবা ব্যাংক চাকুরে। পরিশ্রম শেষে বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে বানানো জলরুটি, চা, মুড়িমাখা খেয়ে ঘরে ঢুকে যেতেন। তাঁর আর কিছু না জানলেও হতো। পাঁচ সন্তানের সংসার। বড় দি কখন ফিরবে,পড়ুয়া মেঝ দির টিচারের বেতন কোথা থেকে আসবে, বাকী দু দিদির স্কুলের ফি, নতুন ফ্রক একমাত্র ছেলের বায়না সব তাঁর নখদর্পনে। মাঝে মাঝে ভাবতাম, কি করে পারে? কোথায় পায় এতো শক্তি?

বড় হতে হতে চোখে দেখলাম, সবার অজান্তে বেরিয়ে গিয়ে মুদি দোকানের ছেলেটিকে বলে এসেছে ডিম কলা চাল দিয়ে যেতে। হাতের বালা খুলে গোপনে দিয়ে এসেছে দিদির পরীক্ষার ফি দিতে হবে বলে। কেউ জানেই না শেষে মার পাতে ভাত ডাল ডালের বড়া আর মাছের ঝোলের আলু ছাড়া কিছুই ছিল না। অথচ অসময়ে এসে পড়া অতিথি ও জানতেন সবাই ভরপেট খেয়ে তৃপ্ত।

মা ছিল স্কুল মাস্টারের মেয়ে। বুকে তার আদর্শ, মনে লেখাপড়ার সংকল্প। সুন্দরী ছিল বলে দিদিদের কারো কারো বাল্য বিবাহের সুপ্রস্তাব এসেছিল। অবলীলায় ফিরিয়ে দিয়ে বলতো, আগে নিজের পায়ে খাড়াক। পড়ালেখা করুক। তারপর বিয়া। সবাইকে কমপক্ষে কলেজ পাশ করিয়ে দিয়েছে মা।

বিয়ের পর মাঝে মাঝে ঝগড়া লেগে গেলে মাকে বিচার দিতাম। বলতাম তুমি সবসময় ওর পক্ষ নাও কেন? শোন কি বলছে?

মৃদু একটা হাসি ঝুলিয়ে বলতো, তুই একটু বাইরে গিয়ে ঘুরে আয়। শেষে একদিন বলেছিল, মেয়েটি আমার সবচেয়ে ছোট মেয়েরও বয়সে ছোট। ওকে বকা দিতে পারবো না গৌতম।

একটা দৃশ্য আজীবনের মতো মনে গেঁথে আছে আমার। প্রাইমারি স্কুল পাশ মার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে ব্যাংকার পিতা। মা রামায়ণ, মহাভারত পড়ে শোনাচ্ছে। কোন কোন সময় তাদের দু জনের মুখে হাসি। আবার রাবণ ও ইন্দ্রজিৎ এর মৃত্যুতে মন খারাপ করা চোখের জল পড়তেও দেখেছি আমি। রাম তথা ভগবান বিরোধী হলেও এদের জন্য এমন ভালোবাসা অবাক করতো।

দুর্গাপূজার বিসর্জনের দিন মা নিজে যেমন আমাদের ও শিখিয়েছিলেন সবার সাথে অসুরের পায়েও যেন প্রণাম করতে না ভুলি। ন্যূনতম মানবিক বোধ ও যদি পেয়ে থাকি তো মার কাছ থেকেই তা পাওয়া। মা কোথায় কেমন আছেন জানি না। চিঠি লেখার বা ফোন করারও সুযোগ নাই। শুধু বিশ্বাস করি দেখা হবে ফের কোনদিন।

মহাভারতের একটি গল্প আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছ মা আসলে কেমন হয়। রাজা ভগস্মান দেবতাকে তুষ্ট করে শত পুত্রের বর চেয়েছিলেন। শত পুত্রের জনক হতে চাওয়া রাজার সে মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছিল। কিন্তু রাজা সেখানে থামার মতো কেউ না। পুত্ররা বড় হতে হতে তিনি আবার কঠিন তপস্যা শুরু করে দিলেন। তার তপস্যায় সন্তুষ্ট দেবরাজ আবার এসে হাজির। খানিকটা কৌতুহল নিয়েই জানতে চাইলেন: আবার কি চাও বৎস? রাজা হাতজোড় করে মিনতি জানালেন, আমাকে নারী করে দিন।

নারী?

হ্যাঁ। নারী হবে আবারো শতপুত্রের জননী হতে চাই আমি। একটু বিরক্তই হলেন দেবতা। তবু বললেন তথাস্তু। কিন্তু আমাকে একটা কথা দিতে হবে?

খুশি মনে রাজা বললেন, বলুন কি কথা? আমি অবশ্য ই তা পালন করবো।

আমি সময় হলে এসে চাইবো।

আকাশে বিলীন হবে যাওয়া দেবতার ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকলেন রাজা। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। হঠাৎ একদিন দেবরাজ এসে হাজির। দু হাত জোড় করে রাজা বললেন: আজ্ঞা করুন। আদেশ করুন।

দেবারজ বললেন: তোমার যে কোন শতপুত্র আমায় দাও। আমি নিয়ে যাবো। কিং কর্তব্য বিমূঢ় রাজার চোখ ভেসে যাচ্ছিল। কিন্তু কথা তো রাখতেই হবে । তিনি চোখ মুদে বললেন, পিতা হয়ে যামি যে শতপুত্রের জন্ম দিয়েছি তাদের আপনি নিয়ে যান প্রভু।

দেবরাজ বললেন: তাই হবে। কিন্তু আমাকে বলোতো কেন তুমি তাদের দিতে চাইছো?

কান্নায় বিগলিত রাজা বলেছিলেন, প্রভু নারী না হ ওয়া পর্যন্ত আমি আসলে বুঝতেই পারি নি সন্তান স্নেহ কী! মায়া কাকে বলে। মা হবার পর আমি যে ভালোবাসা আর স্নেহ দিতে পেরেছি পিতা হয়ে তার সিকিভাগ ও দিতে পারি নি।

এই হচ্ছে মা। পিতা তার সন্তানকে দিতে পারলেও মা পারে না। পারে না বলেই রুমীর মা আমাদের জননী হয়ে উঠেছিলেন। সন্তান গেছে বটে জাহানারা ইমাম জাতির জননী হয়ে আমাদের পথ দেখিয়ে গেছেন। জানিয়ে গেছেন মাতৃশক্তির কাছে কিছু ই কিছু না।

আমার কাছে সবচাইতে সুন্দর দৃশ্য একহাতে সন্তান আরেক হাতে নিজের ব্যাগ নিয়ে ছুটতে থাকা মা। বাচ্চাকে জুতার ফিতা লাগিয়ে দেয়া মা। অসুস্থ সন্তানের মাথার কাছে জাগতে থাকা ঘুম ঢুলুঢুলু জননী। বাকীরা সবাই যখন ঘুমে মায়ের চোখ তখন অতন্দ্র প্রহরী।

আমার পিতা যখন মারা যান মনে হয়েছিল মাথার ওপর থেকে ছাদ সরে গেছে। মা চলে যাবার মনে হলো আকাশটাই চুরি হয়ে গেছে আমার ।

কন্যা জায়া জননীদের আমি বলি দশভূজা। তাদের জন্য আলাদা কোন দিন বা দিবসের দরকার পড়ে না। মাতো মাই। খুব সাধারণ গান কিন্তু কী শক্তিশালী কথা। মায়ের নাম মুখে নিলে শান্তি পাওয়া যায়আমার আরো এক মা আমাদের দেশ। যিনি আগলে রাখেন। কোন দেশ কোন মাটি আশ্রয় না দিলেও যিনি কাছে টানেন। অদৃশ্যের এক মা যে আমাকে পরিচালিত করেন সেটাও স্বীকার করি অকপটে।

জয়তু মা।

লেখক : সিডনি প্রবাসী কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ
পরবর্তী নিবন্ধহিন্দু ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তা প্রদান কর্মসূচি