দূরের দুরবিনে

আধুনিক দেশ ও স্মার্ট অভিযাত্রা

অজয় দাশগুপ্ত | রবিবার , ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৮:৩৮ পূর্বাহ্ণ

উপমহাদেশের রাজনীতি এখন অশান্ত। ভারতবর্ষে গণতন্ত্র আছে এটা যেমন সত্য তেমনি ধর্মানুভূতি নিয়েও আছে নানা বাদানুবাদ। পাকিস্তান সারাজীবন যে সংগ্রাম করেছে এখনো তার জের টানছে সাধারণ মানুষ। গত কয়েকদিনের পাকিস্তান তার সরকার গঠন নিয়ে দেখছে নানা নাটক। পাকিস্তানে এবারের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সাধারণ নির্বাচনের পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলেও কোন দল সরকার গঠন করবে এবং দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হবেন তা পরিষ্কার হয়নি। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং তেহরিকইনসাফের প্রধান ইমরান খান একাধিক মামলায় গ্রেফতার এবং তার দল নির্বাচন থেকে ছিটকে পড়লেও দলটির সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পার্লামেন্টের বেশিরভাগ আসন জিতেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মোট ১০১টি আসনে জয়ী হয়েছে। এর মধ্যে ৯৩টি আসনেই জয় পেয়েছেন পিটিআই সমর্থিত প্রার্থিরাযা এবারের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় চমক। তবে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৩৪ আসনের সহজ সংখ্যাগরিষ্ঠতা তারা অর্জন করতে পারেনি। নির্বাচনী ফলাফল অনুযায়ী, বর্তমানে কোনো দলেরই এককভাবে সরকার গঠনের জন্য পর্যাপ্ত আসন নেই।

পাশের দেশ মিয়ানমারের অবস্থা সংকটজনক। সে দেশের সামরিক জান্তা দীর্ঘকাল দেশ শাসন করার পর এখন তোপের মুখে। বিরোধী জোটগুলোর ভয়াবহ আক্রমণ আর সহিংস যুদ্ধে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে সরকারি বাহিনী। তাদের অনেকেই ঢুকে গেছে বাংলাদেশে। জান বাঁচানোর জন্য আশ্রয় নিচ্ছে আমাদের অভ্যন্তরে। মানবিক কারণে তার গুরুত্ব মানলেও আমাদের বর্তমান অবস্থা কিন্তু মনে রাখতে হবে। এমনিতেই উটকো রোহিঙ্গা সমস্যা ঘাড়ের ওপর ভর করে আছে। নেতৃত্বের কারণে হোক আর যে কারণেই হোক লাখ লাখ রোহিঙ্গার চাপ আছে আমাদের ওপর। সে বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো নতুন আগমন কোনওভাবেই সুখকর হতে পারে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অবশ্য বলছেন, কথা হয়েছে। মিয়ানমার তাদের ফেরত নেবে। কথা হয়েছে এটা ঠিক। কিন্তু মিয়ানমার যে কথা রাখে না বা কথা মানে না সেটাও ঠিক। তাই সাবধানতার বিকল্প দেখি না।

উপমহাদেশের এমন পরিবেশের ভেতর কেমন চলছে স্মার্ট বংলাদেশের অভিযাত্রা? এর উত্তর চাইলে আমাদের যেটা জানতে হবে তা হলো কারা আমাদের নেতা আর কে বা কারা আমাদের সে দিকে ধাবিত করবেন। বলাবাহুল্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অপ্রতিরোধ্য এক নেতা। যিনি সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে আমাদেরকে অনেক সমস্যা থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তাঁর কারণেই বহু সমস্যা মাথা তুলতে পারে নি। তাঁর নেতৃত্বে আমরা পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছি। এ সবই সত্য।

কিন্তু তারপর কী? দ্বিতীয় বা পরের লাইনে যে নেতারা তাদের ওপর মানুষের আস্থা কতটা? একটা দেশ বা সমাজ যখন স্মার্ট হবে বলে প্রতিজ্ঞা করে তখন তার জন্য জরুরি হয়ে দাঁড়ায় আধুনিকতা। সমাজ কি সে জায়গায় আছে? বাংলাদেশ তো কেবল গুলশান বনানী বারিধারা বা চট্টগ্রামের কিছু এলাকা নয়। বিস্তৃত গ্রাম মফস্বল আর শহরগুলোও বাংলাদেশ। সে সব জায়গায় আমরা কি আধুনিকতার ছোঁয়া দেখতে পাই? আধুনিকতা আসলে কী ? নতুন কাপড় নতুন জুতা নতুন বাড়ি? না বিলাসবহুল রেস্তোরাঁয় খাওয়া দাওয়া? আমি দেশে গিয়ে যেটা অনুভব করেছি অঢেল টাকার কারণে এক শ্রেণির মানুষ মনে করে টাকা খরচ করে দামী হোটেলে খাওয়া বিলাসবহুল রিসোর্টে থাকা আর দামী ব্র্যান্ডের পোশাক পরিধান করা আধুনিকতা। এটা যে ভুল এবং মারাত্মক ভুল তার প্রমাণ সমাজের দিকে তাকালেই চোখে পড়বে।

বিজ্ঞান চিত্রকলা এসব বিষয় বিপাকে আছে। তাদের ভয় পায় অন্ধ মানুষজন। কারণ সবার জানা। বিজ্ঞান চোখ খুলে দেয়। চিত্রকলা খুলে দেয় মনের দুয়ার। কবিতা শিল্প জানালার মতো কপাট খুলে ডাকে। অন্ধেরা এসবে ভীত। তাদের জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেলে ব্যবসা লাটে উঠবে। সাম্রাজ্য ধসে পড়বে। কী এই সাম্রাজ্য? খুব সহজ। দীর্ঘদিনের অবাস্তব পাঠক্রম আর লোভের কারণে আমাদের চারপাশে গড়ে উঠেছে প্রলোভনের বলয়। আমি দেশে গিয়ে দেখেছি টাকা মাদক আর নারী লোভে মত্ত মানুষের আর কোনওদিকে তাকানোর ফুরসত নেই। সেফাঁকে সমাজে কিশোর গ্যাঙ নারী গ্যাঙ পুরুষ গ্যাঙ আরো কত কী গড়ে উঠেছে। এদের নির্মূল না করা পর্যন্ত আপনি ভালো দেশ ভালো সমাজ পাবেন না। স্মাটর্ তো আরো দূরের কথা। স্মার্ট বাংলাদেশ মানে কোন পরিসংখ্যান বা হিসাব নিকেশ নয়। এর একটা বাস্তব ভিত্তি হচ্ছে আমাদের শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থা। সে জায়গাটি এখনো স্মার্ট হয় নি। যে কারণে আমরা প্রায়ই পাঠ্য বইয়ে ভুল ভ্রান্তি আর মারাত্মক সব অনিয়মের খবর পাই। যে সব অনিয়ম দূর করা যায় তার জন্য ভাবি না। ভাবি কবিতা বাতিল শব্দের কারণে লেখা বাতিল আর অন্ধদের খুশি করার জন্য অনেককিছু বাতিল করার কারণে। স্মার্ট শব্দটাই এসব পছন্দ করে না। সে নিয়মের ভেতর দিয়েই উদ্দাম আর খোলামেলা। এর নির্যাস নিতে না জানলে সমাজ কীভাবে আধুনিক হবে ?

সবার আগে আমাদের শিশু কিশোর ও তারুণ্য। এদের জন্য খেলার মাঠ পর্যাপ্ত বিনোদন আর ভালোবাসাও কিন্তু স্মার্ট দেশের উপকরণ। তা না হলে সুষম বিকাশ হয় না। যে সব দেশ বা সমাজ আধুনিক যারা স্মার্ট তাদের শ্রেণিগত বৈষম্য কম। থাকলেও তা চোখে পড়ে না। তাদের চিকিৎসা গৃহ আর আহার নিশ্চিত। দামের আগুনে পুড়ে কোনও সমাজ খাঁটি হতে পারে না। দামের চাপ কমাতে সরকার চেষ্টা করছে এটা সত্য। কিন্তু সহনীয় থাকতে হবে পুরা সময় জুড়ে। নয়তো মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে হবে। এটা স্মার্ট দেশের প্রথম শর্ত। যে ভাবেই হোক বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। আর্থিক খাতের অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতির পরও দেশ থেমে থাকে নি। যদি আমরা সত্যিকার অর্থে স্মার্ট হতে চাই নেতাদের এ দিকে মনযোগ দিতে হবে। বন্ধ করতে হবে অর্থ পাচার। বন্ধ করতে হবে টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। এগুলো সবাই জানে। সবাই বলে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা নেতারা তা বন্ধ করতে পারেন না।

আমরা শেখ হাসিনাকে বিশ্বাস করি। আস্থা রাখি তাঁর কাজে। তাই একটাই চাওয়া কথায় নয় কাজে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিযাত্রা শুরু হোক। সে যাত্রায় অসামপ্রদায়িকতা গণতন্ত্র শক্তিশালী বিরোধী দল আর আর্থিক খাতে শৃঙ্খলার বিকল্প কোথায়? সে সব হলেই পথ খুলে যাবে। মেধা আর শ্রমের বাংলাদেশ তার গন্তব্য খুঁজে পাবে আধুনিক ও স্মার্ট বাংলাদেশের ভেতর। সে স্বপ্ন এখন হাতের মুঠোয়। শুধু আমাদের পথ তৈরী করে দেয়ার দেরি। দেশ তৈরী করে নেতা তাকে এগিয়ে দেয় মানুষ। এটাই আমাদের ইতিহাস। আমাদের ভবিষ্যৎ ও সে পথেই মুক্তি খুঁজে পাবে।

লেখক : সিডনি প্রবাসী কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ
পরবর্তী নিবন্ধঅংকুর সংগীত বিদ্যালয়ের সনদপত্র প্রদান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান