বাংলাদেশ বাংলা ভাষা আর তার সংস্কৃতি জীবন নিয়ে বাঁচা যে কোন প্রবাসীই দেশের সম্পদ। আমাদের অর্জিত সম্পদ বা টাকা পয়সার পাশাপাশি মেধা বিনিময় গুরুত্ব পাওয়া উচিৎ ছিল। সেটা হয় না। কারণ মেধা ভিত্তিক সমাজ গড়ে ওঠে নি। সে সমাজ এখন দূরাশা মাত্র। যদি সেটা সম্ভব না হয় তো সুরাহা মিলবে কীভাবে?
অথচ আমরা জানি‘ বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স। অধিক বেতন, উন্নত কর্মপরিবেশ ও উন্নত জীবনযাপনের আশায় মানুষ নিজ দেশ ছেড়ে অন্যান্য দেশে পাড়ি জমায়। এসব প্রবাসীর পাঠানো রেমিট্যান্স একটা দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে। রেমিট্যান্স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের মাথাপিছু আয় এবং মোট জিডিপিও বৃদ্ধি পায়। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রবাসী আয়ের অর্থ দেশের দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা, শিশুর পুষ্টি ও শিক্ষার ক্ষেত্রেও অবদান রাখছে।
একটি বিস্মৃত কাঠামোতে বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমশক্তির অভিবাসনের বিভিন্ন দিককে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। তবে সময়ের পালাবদলের হাত ধরে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসনের একটি গঠনমূলক পরিবর্তন ঘটছে বলে মনে হয়। বর্তমানে আমাদের মোট অভিবাসনের একটি বড় অংশজুড়ে আছে শ্রমিকদের অস্থায়ী দেশান্তর। অর্থনৈতিক উন্নয়নে রেমিট্যান্সের অবদান মোট জিডিপির ১২ শতাংশের মতো। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। প্রবাসী এসব শ্রমিক যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছেন, তা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের অর্ধেক। বিগত চল্লিশ বছরে প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ প্রবাসী বিদেশে গমন করেছে এবং তা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিজেদের কষ্টার্জিত উপার্জনের অর্থ নিয়মিত পাঠিয়ে তারা এ দেশকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে গড়ে তোলেন। এর সত্যতা স্বীকারে অকুন্ঠ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।
দেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসীদের বিরাট অবদান স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। মঙ্গলবার (১৬ জানুয়ারি) দুপুরে গণভবনে প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে মত বিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।শেখ হাসিনা বলেন, ‘স্বাধীনতা, সংগ্রামে বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে প্রবাসীরা বিরাট অবদান রাখেন। প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসীদের বিরাট অবদান রয়েছে। সেটা ছাড়াও আবার স্বাধীন বাংলাদেশে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি।’ ‘প্রবাসীরা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে, যেকোনো আন্দোলনে অবদান রেখেছেন। যখন বাংলাদেশে মার্শাল ল জারি হয় আমরা যখন কাজ করতে পারি না, তখন প্রবাসীরা প্রতিবাদ জানান। আপনারা আন্দোলন সংগ্রাম করেন। জনমত সৃষ্টি করেন। এটা আমাদের জন্য বিরাট শক্তি।’
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চার বার টানা সরকার প্রধান হবার পর এই কথাগুলো বলেছেন। এর গুরুত্ব বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না। তিনি যা বোঝেন বা অনুধাবন করেন তা খুলে বলেন। এটাই তাঁর কৃতিত্ব। অন্যদিকে আমরা যারা বাংলাদেশের বাইরে বসবাসরত বাংলাদেশি কেউ কেউ দ্বৈত নাগরিকত্বে অন্য দেশেরও নাগরিক তাদের কষ্ট বোঝেন না মাননীয়রা। দুঃখ বা বেদনাগুলো দেশ ভেদে ভিন্ন ভিন্ন। আমেরিকা ইউরোপ বা অষ্ট্রেলিয়া কানাডার বাঙালিদের কষ্ট ও মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমজীবী বাঙালির কষ্ট এক নয়। এখানে একটা বড় তফাৎ হলো পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি বা নাগরিকত্ব। যারা বিদেশে থাকতে পারবেন না বা সব সময়ের জন্য বিদেশে বসবাস করতে পারবেন না তাদের সমস্যা মৌলিক। তারা দেশে টাকা পাঠায় নিজেদের পরিবার পরিজন নিয়ে ভালো ভাবে বাঁচার জন্য। এখানে সব চাইতে বড় বাধা মধ্যসত্ত্ব ভোগী ও দালালেরা। রেমিটেন্স পাঠানোর কাজটিতে কি কি বাধা বা কোথায় এর অন্তরায় লুকিয়ে সবাই জানেন । প্রশ্ন হচ্ছে এর দায় কা‘দের বা সমাধান করবে কে?
সবচাইতে বড় সমস্যা আমাদেরকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করা। আমার বলতে আমি আমার কথা বলছি না। সাধারণ প্রবাসীদের বেলায় পদ পদবী পুরস্কার কিংবা অর্জনের স্বীকৃতি দিতে কুন্ঠিত আমাদের দেশের বড় মানুষেরা । এই কুন্ঠার কারণ আমরা জানি। কারণ তাদের বেশীর ভাগ ই দেখতে বড় হলেও মূলত এরা বড় কেউ না। নানা গোঁজামিলে তাদের বড় করে তোলা এবং তাদের হাতে পাওয়ার থাকায় দেশের আজ এই অবস্থা। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি পরে ফেরা পর্যন্ত সব জায়গায় যে ভোগান্তি তার হিসাব রাখে না কেউ। রাখলে সমস্যার গভীরে যাবার ইচ্ছে থাকতো। যা আওয়ামী লীগের টানা আমলে একবারের জন্য ও দেখি নি। তাদের আমলে প্রবাসে দল করা দলের শাখা খোলা মানুষ জন প্লট ইত্যাদি পেলেও সাধারণ প্রবাসীদের মেধা ও মননের কোন স্বীকৃতি নাই । হ্যাঁ ঢালাও ভাবে বলছি না। বলছি এই কারণে যাদের অর্জন সবকিছু ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে কিছুতেই ঠেকানো যায় না কেবল তখনই তাদের স্বীকৃতি মেলে ।
বাংলাদেশ বাংলা ভাষা আর তার সংস্কৃতি জীবন নিয়ে বাঁচা যে কোন প্রবাসীই দেশের সম্পদ। আমাদের অর্জিত সম্পদ বা টাকা পয়সার পাশাপাশি মেধা বিনিময় গুরুত্ব পাওয়া উচিৎ ছিল। সেটা হয় না। কারণ মেধা ভিত্তিক সমাজ গড়ে ওঠে নি। সে সমাজ এখন দূরাশা মাত্র। যদি সেটা সম্ভব না হয় তো সুরাহা মিলবে কীভাবে?
মোদ্দা কথা হলো আমাদের দেশের অন্য যে কোন খাতের মতো প্রবাসী কল্যাণ খাত ও প্রশ্নমুক্ত নয়। তাদের সদিচ্ছা থাকলেও উদ্যেগ দেখা যায় না। কিছু গৎবাঁধা পরিসংখ্যান বা তালিকা দিয়ে আসলে কিছুই প্রমাণ হয় না। আমরা এয়ারপোর্টে গিয়ে যে সব অনভিপ্রেত প্রশ্নের সম্মুখীন হই বা যে কোন কাজে যে সব বিপত্তির মুখোমুখি হই তার উত্তর বা সমাধান জানা দরকার। যেমন ধরুন আপনি কেন দেশে এসেছেন? এই প্রশ্ন দিয়ে শুরুটা যে কোন নাগরিক বা বাংলাদেশির জন্য অমর্যাদাকর। এর সাথে আছে সন্দেহ আর সংশয়। একবার ভাবুন যে মানুষটি দেয় এবং দিতে এসেছেন তাকেই নাজেহাল করছে গ্রহীতা ।
আমি ভাবি নতুন প্রজন্মকে নিয়ে। তারা জ্ঞান বিজ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় আমাদের চাইতে এগিয়ে। তারা যখন দেখে বা দেখবে একজন ভারতীয় শ্রীলঙ্কান বা নেপালী প্রবাসী ভি আই পি মর্যাদা পান তাদের দেশে তারা গর্ব নিয়ে অবাধে চলেফেরা করতে পারেন তখন কি তাদের মনে প্রশ্ন জাগবে না? সাধারণ মানুষেরা প্রবাসীদের বরণ করতে এবং তাদের ভালোবাসা দিতে কার্পণ্য করেন না। যত দোষ ঐ নন্দঘোষ সিস্টেমে। এই ব্যাপারে আমাদের দূতাবাসগুলোর ভূমিকা থাকার কথা হলেও তার কোন নজীর দেখা যায় না। যদি তা থাকেও তা ছিটেফোঁটা ।
সব মিলিয়ে শেখ হাসিনার যে বক্তব্য তাঁর যে সদিচ্ছা বা মূল্যায়ন তার বাস্তবায়ন এখন সময়ের চাহিদা। মনে রাখতে হবে দেশের বাইরে প্রায় দু কোটি বাংলাদেশীর বসবাস। এরা স্বচ্ছল ও আন্তরিক। তাদের কর্ম তাদের মেধা তাদের অথের্র সঠিক মূল্যায়ন না হলে সমস্যার সমাধান হবে না। যে কোন একাডেমি থেকে যে কোন দপ্তরের কর্তা কর্ত্রীদের কাছে এই বার্তা পৌঁছাতে হবে যে প্রবাসী বাংলাদেশীরা শক্তি। সে শক্তির সঠিক ব্যবহারেই ভবিষ্যৎ আরো নিরাপদ আর সুন্দর হয়ে উঠতে পারে।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট