অনেকদিন চট্টগ্রামে ছিলাম। গোড়ার দিকে সম্মাননা, সংবর্ধনা,অনুষ্ঠান, আলোচনা, টিভির আয়োজন ও আড্ডায় জমজমাট ছিল সময়। একটু থিতু হয়ে ঢাকায় যাবো, দু দুটো সাক্ষাৎকার ভিত্তিক অনুষ্ঠােেনর সবকিছু তৈরী। বিমানবন্দর থেকে নিয়ে যাওয়া ফিরিয়ে দেয়া সবকিছু ঠিক। পূজার শেষদিন প্রমাণিত হলো একটি ক্ষুদ্র মশা মানুষের চেয়ে শক্তিশালী। এমনই যে সবকিছু তছনছ করে দিতে যথেষ্ট, গৃহবন্দী করে রাখতে পারে দীর্ঘ সময়। তখন কী করে ফিরবো সেটাই হয়ে উঠলো মূখ্য বিষয়। সে শক্তি সঞ্চয় করতে গিয়ে অজস্র প্রিয়জনের সাথে দেখা করা হয় নি। তাদের মনস্তাপ ও কষ্টের জন্য দুঃখিত। এটাও তো সত্য তাদের সাথে দেখা হলে আমিও ঋদ্ধ হতাম। মন পুলকিত হতো। হয় নি।
এবারের চট্টগ্রাম আমায় এতো ভরিয়ে দিয়েছে যে কারো ঈর্ষাই তা স্পর্শ করতে পারে নি। যে ব্যর্থ হাহাকার ও হিংসার গল্প শুনেছি তার সাথে মানুষের বাহ্যিক চেহারা বা আচরণ মেলে না। তাতে কী আসে যায়? রাশেদ রউফের মতো অনুজ থাকলে, ওমর কায়সার, ইউসুফ মুহম্মদের মতো বন্ধু থাকলে, জিন্নাহ চৌধুরীর মতো সুহৃদ থাকলে, রাশেদ হাসানের মতো সঙ্গী থাকলে, বোধনের মতো ছায়াবৃক্ষ থাকলে, শুভানুধ্যায়ীরা থাকলে সবকিছু অবলীলায় হয়ে যায়। কবি আসাদ মান্নান নিজের অনুষ্ঠান স্থগিত রেখে গোলাপ নিয়ে এসেছিল। এর চেয়ে বড় পাওয়া নাই। এর নাম বন্ধুত্ব। এর নাম সাহচর্য।
চট্টগ্রামের অভিভাবক দৈনিক আজাদী‘র সম্পাদক শ্রদ্ধাভাজন আবদুল মালেকের সান্নিধ্য পাওয়া তাঁর মূল্যবান সময় থেকে কিছুটা সময় পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার ।
ঢাকা যাবার আগে দুই শত্রু আক্রমণ করে বসে। প্রথমত অবরোধ বা হরতাল নামের দুশমন, অতঃপর মশার কামড়। প্রথমটি মানুষের চাপিয়ে দেয়া পরেরটি আংশিক মানুষের অবদান বাকীটা হয়তো নিয়তি। ডেঙ্গুর মতো ভয়াবহ একটি রোগ বা আক্রমণ সামলানোর মতো ইমিউন এখন আর আমাদের নাই। ভুগেছি বটে কিন্তু অবাক হয়েছি বিরোধী দলের উগ্র আচরণে। আসলে দল বলতে কিছু আছে কি না জানি না কোথাও কোন নজীর ও মেলে নি। তাহলে কিভাবে অবরোধ চলছে? চলছে এইভাবে, একদল লোক হঠাৎ বেরিয়ে আসে। কোথা থেকে আসে কেউ বোঝে না। হুটহাট গাড়িতে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায় । সে আগুনে পোড়া মানুষগুলো কি আওয়ামী লীগের না বিএনপি জামাতের তাও জানে না কেউ। কিন্তু মরলেই ভালো। আন্দোলন জমে ওঠে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে কোন আন্দোলন দেখি নি। বরং প্রথম যেদিন হরতাল দিলো মানুষকে বিরক্ত হতে দেখেছি। বাড়িতে বেড়াতে আসা ছোট্ট মেয়েটি তার মা কে প্রশ্ন করছিল, হরতাল কি? আমার নিকটাত্মীয় এক শিশু অথবা বালক সে খুব বিস্ময়ের সাথে সবুর করছিল হরতাল দেখবে বলে। এই প্রজন্মের কাছে রাজনীতিবিদদের কি জবাব? আমি সিডনি ফিরে আসার গল্পটাই বা কম কী? গাড়ি নেয়া বা তেমন কিছুতে এয়ারপোর্ট যাওয়াটাই রীতি। কিন্তু অবরোধের সমাজে কি সে জো থাকে? বাধ্য হয়ে সিনজি ভাড়া করে একটাতে মালামাল তুলে দিয়ে আরেকটাতে নিজেরা চেপে সামনে পেছনে দু জন পাহারাদার নিয়ে এয়ারপোর্ট যাত্রা সে কি বিড়ম্বনা!
কথা হচ্ছে কেন আন্দোলন কেন এই অবরোধ কেউ ঠিক জানে না। বিএনপি‘র ব্যর্থতা প্রকট। সরকার বিরোধী মনোভাব আর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষের মনে যে রাগ বা বিতৃষ্ণার জন্ম দিয়েছে তাকে পুঁজি করেছে এই দল। আমার মনে হয়েছে সে আশি বা নব্ব ই দশকের মতো বিএনপি এখনো হাঁটু ভাঙ্গা। তাদের আসল জোর জামাত শিবির। এরা অদৃশ্যে থেকে শক্তি না যোগালে এ্যকশানে না গেলে অবরোধের অ টাও হতো না। বিএনপি যে অসংবেদনশীল বিচ্ছিন্ন একটি দল তার প্রমাণ তাদের নেতৃত্ব। যারা খালেদা জিয়ার মতো জনপ্রিয় নেতার মুক্তির জন্য ভালো করে আন্দোলন করতে পারে নি তারা দেশের শাসনভার নিয়ে কি করবে?
যাই হোক আমি বিদেশে থাকি। আমার কাছে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো সার্বিক পরিস্থিতি এবং মানুষের মঙ্গল। সে দিক থেকে এই রাজনীতি অচিরেই বন্ধ করা দরকার। কোন দেশ এমনি এমনি এগোয় না। তার বলিষ্ঠ নেতা কর্মী আর জনগণ মিলে তাকে সামনে এগিয়ে দেয়। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা আছেন এই বড় পাওয়া। কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ব্যর্থ। তারা যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বাদ দিয়ে মাঠে নামে দুই মিনিট ও টিকতে পারবে না। কারণ নেতাদের ওপর মানুষের বিশ্বাস শেষ ।
বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা আসলে কেমন? কলকাতা উড়িষ্যা ও বেনারস ভ্রমণের পর দেশে গিয়ে আমার মনে হয়েছে মানুষ খারাপ নাই। খারাপ করে রেখেছে রাজনীতি ও সিন্ডিকেট। মুখে মুখে যে যাই বলুক খাবার টেবিল কিন্তু খালি কিছু না। এটা ঠিক নিম্মবিত্ত ও মধ্যবিত্ত কষ্টে আছে। এই কষ্ট নিবারণের প্রক্রিয়া নাই। মন্ত্রীরা লাগামহীন কথা বলেন । আর দেশের ভালোমন্দ চলে গিয়েছে টক শো ওয়ালাদের কাছে। পৃথিবীর আর কোন দেশে কোন মিডিয়ায় দিনরাত এমন টক শো‘র নজীর দেখি না। সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত দেশপ্রেম। সেটা নাই বললেই চলে। যার শেষ উদাহরণ সাকিব আল হাসান। নিয়মানুযায়ী আউটের আবেদন জানিয়ে শ্রীলংকার ম্যাথুসকে আউট করায় বাংলাদেশীদের যে মনোভাব আর উদারতার বালখিল্যতা দেখলাম তা রীতিমতো হাস্যকর। সবাই বিশেষজ্ঞ। সব জান্তা। সাকিবকে ছোট করার নামে যে হীন মানসিকতা তার পেছনেও না কি রাজনীতি। সাকিব নৌকায় ভোট চেয়েছিল এটা তার প্রচ্ছন্ন অপরাধ। সে কারণে দেশের সম্মান নষ্ট হলেও শ্রীলংকাকে মাথায় রাখতে হবে। যে জাতির জীবনে পরিবারে সংসারে কোথাও উদারতা নাই সব জায়গায় ঘুষ দুর্নীতি অনিরাপত্তা তাদের এমন উদার মনোভাব সন্দেহজনক নয়? আসলে দেশ ও দেশপ্রেম এখন আর কাজ করে বলে মনে হয় নি।
এই প্রজন্ম হরতাল অবরোধ জানতো না। চিনতো না। মহান রাজনীতি এবার তা চিনিয়ে ছাড়ছে। দেশে যাবার আগে প্রবাসী সুশীল রোগে আমি সরকারের তীব্র সমালোচনা করতে ছাড়ি নি। এখনো করি তবে দেশে গিয়ে মনে হয়েছে কা‘রা চাইছে গণতন্ত্র? কা‘রা এরা? দেশও দশের সাথে সম্পর্কহীন এরা গদী ছাড়া কিছুই বোঝে না। সরকারের ব্যর্থতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে না পারা, লুটপাট ও ক্ষমতার গর্বে দিশাহারা দলের ফাঁক বুঝতে পেরে এরা ঢুকতে পেরেছে। এরা কোন ভাবেই জনপ্রিয় কেউ নয়। বরং জনবিচ্ছিন্ন। কিন্তু এরা পুঁজি করেছে জনমনের ক্ষোভ। বলাবাহুল্য এসব সবাই জানেন। সরকারের এতো উন্নয়ন কেন কাজে আসছে না সেটাও সবাই বোঝেন।
গণতন্ত্র যে কী সেটা বাড়ি ঘরেই প্রকাশ্য। বাড়ির কর্তা যা বলে তা সবাই এক বাক্যে মেনে নেয়। বাড়ির বড় ভাই ছোটদের পেটালেও কিছু যায় আসে না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার যাকেই প্রশ্ন করেছি ভোট হলে কা‘কে দেবেন? সবাই বলেছে গণতন্ত্র চাই। তা তো বুঝলাম কিন্তু কে আনবে গণতন্ত্র? দু একজন বললো, শেখের বেটি। তাহলে এই আন্দোলন কেন? উত্তর এলো, গণতন্ত্রের জন্য। বূজলাম িট্িযর বাকসো ছাড়া আর কোথাও এগুলোর কোন অস্তিত্ব নাই।
কোথাও মানুষের জন্য কেউ আছে এমনটি মনে হয় নি। ঘাপটি মেরে থাকা, আত্মগোপনে থাকা লোকজন হঠাৎ বাইরে এসে বোমা ফাটিয়ে আগুন লাগিয়ে দেশ অচল করে দিচ্ছে, এটাও অবাক হবার মতো বৈ কি।রাজনীতি বিমুখ মানুষ কোন ভাবেই ভালো থাকতে পারছেন না। এই দেশে হঠাৎ এতো গণতন্ত্রপ্রেম আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে। ঘরে বাইরে সমাজে একনায়কতন্ত্রের জয় জয়াকার। “আমি আমি ” করা সমাজে গণতন্ত্র বলে মাতম ও জীবন অচল করে দেয়া বড়ই তাজ্জবের। মানতে হবে, মানুষকে কথা বলতে না দেয়া, ভোট দিতে না দেয়া, চাপিয়ে দেয়া দলতন্ত্রের কারণেই উন্নয়ন মার খেয়ে গেছে। উত্তরণের উপায় যে আমেরিকা ইন্ডিয়া না সেটাও সবাই বোঝে। নেত্রীকে সাধারণ মানুষের ভাষা বুঝতে দিলে উত্তরণ সহজ হবে। তাঁকে কাচের ঘরে নয় মানুষের মনে রাখতে হবে। এখনো ভরসা তিনি। সবাই বোঝেন শেখ হাসিনা না থাকলে এই দেশ অচল। এবং তিনি দেশকে যে অবস্থায় নিয়ে গেছেন তার হাল ধরা মূর্খ ও অতিশিক্ষিত চতুরদের দ্বারা অসম্ভব। দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ মানুষ। সে মানুষেরা বঙ্গবন্ধু কন্যার ওপর আস্থাশীল। এই ভরসাই হয়তো নৈরাজ্যকে ঠেকিয়ে দেবে। জয়তু বাংলাদেশ।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট