রাত পোহালো শারদপ্রাতে
শারদ উৎসব সমাগত প্রায়। এদিকে নির্বানের বাতাস ও বইতে শুরু করেছে। উঠে আসছে নানা কথা। নানা বিষয়। প্রতিবারের মতো এবার ও সংখ্যালঘু সমস্যার কথা উঠতে শুরু করে দিয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার এই এখনো আমাদের দেশ ও সমাজ থেকে সংখ্যালঘু বিষয়টি বাদ যায় নি। মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত দেশে সবাই বাঙালি হবে এমন একটা শপথ নিয়েই দেশ স্বাধীন হয়েছিল। আমরা ধারণা করেছিলাম আর কখনো সামপ্রদায়িকতা মাথা তুলতে পারবে না। আর কোনদিন আমাদের মতো হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান বা অন্য কোন মত ও পথের বাঙালিকে কটু কথা শুনতে হবে না । মাশুল গুণতে হবে না সংখ্যালঘু বলে। কিন্তু সে আশা পূরণ হয় নি। আমি আশাবাদী মানুষ। কাজেই কেবল হতাশার কথা আমি বলবো না। মনে রাখব আওয়ামী লীগ আমলেই এদেশে সংখ্যালঘু নামে পরিচিত মানুষজন ভালো ভালো পদে উচ্চস্তরে যেতে পেরেছে। তাদের গুণ কর্ম বা দেশপ্রেম স্বীকৃত হয়েছে। সব কথা বাদ দিলে কেবল লিটন দাশের কথা বললেই মনে হয় বোঝানো সহজ হবে। বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমে প্রতিভা বা মেধার ঘাটতি নাইল বরং বেশী প্রতিভা আর বহুল মেধার চাপে মাঝে মাঝে দিশা হারাই আমরা। সে ক্রিকেট দলের বাকী দশজন মেধাবী খেলোয়াড়ের অধিনায়ক লিটন। কই তাকে মানতে তো কারো সমস্যা হয় না।
ব্যক্তিগতভাবে আমার একটা অবর্জাভেশন বা পর্যালোচনা আছে। আমি বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে কখনো নিজেকে সামপ্রদায়িক ভাবতে পারি নি। মাঝে মাঝে বঞ্ছনা বা সমাজ বাস্তবতায় হিন্দু হবার কারণে যে সব দুর্ভোগ তা পীড়িত করে বৈকি। তখন রাগ হয় । প্রতিক্রিয়া ও বেরিয়ে পড়ে। পরমুহূর্তে আমি হিসেব কষি। আমার যা কিছু অর্জন বা প্রাপ্তি তাতো আমার দেশ আমার স্বদেশের মানুষের কাছ থেকেই পাওয়া। যদি বলি অষ্ট্রেলিয়ায় প্রাপ্ত পুরস্কার বা পদকের কথা? না সেখানেও কিন্তু স্বদেশ। আমি দেশের মানুষের ভালোবাসা বা সমর্থন না পেলে সেখানে আমার লেখা ছাপা না হলে কথা বলতে না পারলে এরা আমায় চিনতো না। যার মানে একটাই. আমাদের শেকড় আমাদের নাড়ির টান বাংলাদেশ। এতকিছুর পর ও আমাদের সমস্যা দূরীভূত হয় নি। শিশুকাল থেকে দেশান্তরী হবার একটা প্রবণতা দেখেছি। সেটি যে থেমে গেছে তা নয়। বরং চলছে। এর যৌক্তিক ও ইমোশনাল কারণগুলো সবার জানা। কিন্তু সেতো সমাধান নয়। সমাধান যে নয় আমাদের চাইতে ঢের খারাপ থাকা পাকিস্তানের হিন্দু বা খৃষ্টানদের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। তারা পালালেও সবাই যেতে পারে নি। অসহ্য কষ্ট আর অবণর্নীয় দুঃখ ভোগ করেও তারা পাকিস্তানি। উপমহাদেশের দেশভাগ এক অজানা বেদনার কাহিনি। যা চিরকাল কাঁটার মতো বেঁধে আছে। সে ধারাবাহিকতার অবসান ঘটানোর জন্য বঙ্গবন্ধু‘র নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু সামপ্রদায়িকতা যায় নি।
বলছিলাম এখনকার কথা। এখন সমাজে পোশাক থেকে আচরণে প্রায়ই বিদ্বেষ আর হিংসার হাতছানি দেখা যায়। বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় সংখ্যালঘু নামে পরিচিতদের বড় ভরসা সরকার বা রাষ্ট্র। রাষ্ট্র তাদের কথা বললেও আগেকার সরকারগুলোর আমলে সে ভাবে তাদের কথা কেউ শোনে নি। বিএনপি জামাত আমলে একবার শারদীয় দুর্গাপূজা না হবার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছিল দেশে। তারপর ও বোধোদয় হয় নি। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় শারদীয় উৎসব আসার আগমনী বার্তা মূলত আর শরতকালের আবহ বা ঢাকের বাজনা নয়। তারচেয়ে যখন আমরা মূর্তি ভাঙ্গার ফুর্তি দেখি তখন ই বুঝি পূজা আগতপ্রায়।
এতোকিছুর পরও মানুষ আশা ছাড়ে নি। আশা ছাড়ে নি বলেই দিনে দিনে পূজার সংখ্যা বেড়েছে। এতটাই বেড়েছে যে সরকারকে অনুরোধ জানাতে হচ্ছে যাতে তারা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেন। তাঁদের এই সাবধানতাকে আমি স্বীকার করেই বলতে চাই যদি সমাজ আর দেশ চায়, যদি সমাজ থেকে সামপ্রদায়িকতা নির্মূল করা যায় তাহলে পুলিশ প্রহরার ই কোন দরকার পড়বে না। আমি পূর্ব পাকিস্তান আমল দেখা মানুষ। একটা দুটো আনসার সদস্য বা লাঠি হাতে সিকিউরিটি গার্ড ব্যতীত তখন কোন নিরাপত্তা ই ছিল না। কিন্তু সাড়ম্বরে পূজা উদযাপন চলতো। স্বাধীনতার পর পরিকল্পিতভাবে আওয়ামী লীগকে দুর্বল করার চক্রান্তে শুরু হয়েছিল প্রতিমা ভাঙচুর । সংখ্যালঘুদের বড় আশ্রয় তাদের ভোটাধিকার। যা দিয়ে তারা তাদের সুখ দুঃখ মত অভিমত প্রকাশ করতে পারে। আগামী নির্বাচনের আগে তাদের সে অধিকারবোধ নিয়ে কথা উঠছে। এটা সবাই জানেন সংখ্যালঘু নামে পরিচিতদের ভোট যাবে প্রগতিশীলদের বাঙে । যারা তাদের মান সম্মান ও অধিকার নিশ্চিত করবে তারা তাদের ই নির্বাচন করবে। এখন কথা হচ্ছে যারা চেতনার কথা বলেন বা ধারণ করেন তারা কি আসলেই আন্তরিক? শীর্ষ নেতা নেত্রীদের ইচ্ছে থাকলেও অনেক সময় মাঠ পর্যায়ের নেতা কর্মীরা সেসব ইচ্ছে পূরণে এগিয়ে আসে না। বাংলাদেশে এটাই সমস্যা। কারণ সে হিসেব আলাদা আর কঠিন। মূল কথা সমাজের বদলে যাওয়া বাস্তবতা আর প্রবণতা মাথায় রেখে যারা নেতা হয় তারা মনে করে আমি কেন তোমাদের জন্য ঝুঁকি নিতে যাবো ? যে কোন নাগরিকের যে সমান অধিকার বা তার অধিকার নিশ্চিত করা যে ঝুঁকি নেয়া নয় এটা এখন মানানো বা বোঝানো কঠিন।
সবচাইতে বড় বিষয় বোধকরি দেশ প্রেম নিয়ে সন্দেহ। সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে এই সন্দেহ একটা রোগের মতো। তারা দেশকে ভালোবাসলেও বাঁকা চাউনির শিকার হতে হয়। জানি এর পেছনেও ঘটনা আছে। দেশত্যাগ দেশ থেকে টাকা পাচার সম্পত্তি পাচার এমন সন্দেহকে ঘনীভূত করে। কিন্তু অর্থ পাচার বা সম্পত্তি পাচার সবার বেলায় সত্য। আজকাল অবশ্য সবাই জানেন কোন একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মানুষ এই অপারাধের সাথে জড়িত নয়। এটা এখন সর্বজনীন সমস্যা।
সংখ্যালঘুদের কথা উঠলো এই কারণে সামনে শারদীয় দুর্গা পূজা আর নির্বাচন। এই দু ই উৎসব এগিয়ে এলেই তাদের আতংক বাড়ে। অতীতের কথা মনে পড়ে যায়। বারবার আক্রান্ত হওয়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাবে এটাই স্বাভাবিক। আর এটাও সত্য একসময় যে তারুণ্য ছিল ভরসা তারাই এখন গলার কাঁটা। ভাবতে অবাক লাগে তলে তলে এমন এক তারুণ্য তৈরি হয়ে গেছে যারা জাতীয় সঙ্গীত গায় না। যারা পতাকা মানে না। যারা মাটি ভালোবাসে না। মাথা নত করে না। যারা মানুষকে বাঙালিকে বাঙালিত্ব দিয়ে বিচার ও করে না। এদের হাতে কী আসলেই নিরাপদ আমরা?
রাজনীতির কঠিন খেলা বোঝা দায়। এটুকু বুঝি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যতোদিন আছেন ততদিন অন্তত নিরাপত্তা আছে থাকবে। থাকবে আশাবাদ। সবার আগে যে বাঙালি আর তার দেশ এটা প্রতিষ্ঠিত হলেই কিন্তু সমস্যার ভার লাঘব হতে পারে। আজকের বাংলাদেশ বহু বিষয় উঁচুতে। বিশ্বে নানা কারণে তার পরিধি বেড়েছে। বেড়েছে পরিচয়। এমন স্বদেশের জন্য সবাই গর্বিত হবে এটাই স্বাভাবিক। যে সব অর্জন আমাদের বড় করছে তার পেছনে সবার ত্যাগ মেধা আর পরিশ্রম থাকে। সে বিবেচনায় দেশটির জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত সংখ্যালঘু নামে পরিচিতেরা ও কম কিছু করে নি। সময় দ্রুত বয়ে যায়। মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ স্মার্ট বাংলাদেশ এর মূল সুর হোক আমাদের সকলের ঐক্য। যে সমাজে কেউ কাউকে সংখ্যালঘু বিবেচনা করবে না সেটা ই তো আসল আধুনিক সমাজ। তেমন একটা রাষ্ট্রের জন্য আর কতকাল সবুর করতে হবে আমাদের?
লেখক :কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট