দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | রবিবার , ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৭:৩৬ পূর্বাহ্ণ

প্রায়ই একটা কথা শুনি। আমরা এমন দেশ চাই নি। যে যখন যেভাবে বিপদে পড়েন বা পরিবেশ তাদের অনুকূলে না মনে করেন তখন ই এ কথা আওড়ান। কিন্তু একটা কথা কেউ পরিস্কার করে বলেন না, কোন ধরনের দেশ চেয়েছিলাম আমরা। আমরা যারা পুরনো যুগের মানুষ, যারা বাংলাদেশের জন্ম দেখেছি আমাদের কথা যদি মনে ধরে তো বলি, আসলেই এমন দেশ চায় নি আমাদের অগ্রজেরা। তারা কি চেয়েছিল? তাদের স্বপ্ন ছিল অসামপ্রদায়িক, ধর্ম বর্ণ, জাত পাত ভেদে এক অন্যধরনের বাংলাদেশ। যার আইন শাসন ও নিরপেক্ষতা হবে প্রশ্নাতীত। যার রাজপথ থাকবে শান্ত। মানুষ হবে কর্মমুখর।

এবার আপনি মিলিয়ে দেখুন। আসলেই কি আমরা তা পেরেছি বা পেয়েছি? যদি না পেয়ে থাকি এর জন্য কি আসলেই শুধু আওয়ামী লীগ দায়ী? না শেখ হাসিনা দায়ী? আপনি এর উত্তর জানলেও মানেন না। কারণ আপনি এদেশের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়েই সন্দিহান। মৌলিক বিষয় কি কি? যে দেশটি লাখো শহিদের রক্ত আর ত্যাগে এ দেশের জন্ম তার আমূল পাল্টে যাওয়ার জন্য কি আপনি দায়ী নন? আজকে দেশের চেহারা পাল্টে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। এখনো এমন দেশ আছে যাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম নেট পায় না। পেলেও ব্যবহার করতে পারে না। সে জায়গায় এশিয়ার ছোট একটি দেশ বাংলাদেশ কি ভাবে তা পারলো? কী ভাবে আজ পাড়া গাঁয়ের মানুষটিও নেট ব্যবহার করে? পারে মোবাইল ব্যবহার করতে? এর কোন কৃতিত্ব কি আপনি সরকার কে দেন ? দিতে চান না। কারণ কিছু পাবার পর ই আপনার আমার মনে হয় আরে এটাতো আমার পাবার কথাই ছিল। বরং আরো বেশী পাবার কথা আমার।

চাওয়া পাওয়ার এই ব্যবধান এখন এতো বেশী যে নব্য রাজাকারদের দৌরাত্ম্য এখন আর আপনাদের চোখে পড়ে না। আমি নিজেও মাঝে মাঝে টক শোতে যেতাম। যেতাম বললাম এই কারণে আর যাবার রুচি হয় না। সবাই ঘুরে ঘুরে এক কথা বলেন। কয়েকটা জনপ্রিয় টক শোর কাজই হচ্ছে যেন তেন প্রকারে প্রমাণ করা দেশ ভালো নাই। মানুষ ভালো নাই। আমি বলছি না যে মানুষ সুখে মারা যাচ্ছে। বরং ডেঙ্গু সহ দ্রব্যমূল্যের চাপে মানুষের অবস্থা করুণ। ডেঙ্গু দমনে ব্যর্থতা আর জিনিষের দাম কমাতে না পারায় জনপ্রিয়তা কমলেও টনক নড়ছে না। এগুলো যে সবচেয়ে দরকারী বিষয় সেটাও মাথায় রাখছে না তারা ।

কিন্তু সব মিলিয়ে দেশের যে উন্নয়ন আর অগ্রগতি তার সুবিধাভোগীরাই চেঁচামেচি করছেন বেশি। এ জায়গাতেই আমার আপত্তি। যারা প্রতিবাদ করলে বা মাঠে নামলে খুশী হতাম তারা নামেন না। দরিদ্র বা প্রান্তিক শ্রেণি নামে পরিচিত এসব মানুষেরা নামেন না কারণ তারা জানেন এরপর হয়তো আরো খারাপ কিছু হবে। চেপে বসবে ডাকাতের দল। যে অভিজ্ঞতা তাদের আগেই হয়েছিল। কাজেই তারা মনে করেন তারা ভালো না থাকলেও ভালো আছেন। ।

অন্য দিকে বিএনপি আন্দোলন করবে এটা স্বাভাবিক। বিরোধী দলের কাজ আর কি হতে পারে? রাস্তায় আন্দোলন করা দল যদি দেশ শাসনে আসতে চায় তার কিছু গুণাবলী বা পরিকল্পনা থাকতে হয়। বিগত বছরগুলোতে আমরা কি তেমন কিছু পাচ্ছি? কিছুদিন পরপর পদযাত্রা আর সভা সমাবেশ করে দল টিকিয়ে রাখা যাবে কিন্তু দেশ পরিচালনার নির্দেশনা দেয়া যাবে না। সবাই মনে করেন বিএনপির জনপ্রিয়তা খুব বেশি। হয়তো তাই। নির্বাচন হলেই যে তারা জিতবেন এই গ্যারান্টি তারা পেলো কোথায়? এটা কেউ পরিস্কার করে বলে না। সবচেয়ে বড় কথা হলো এতবড় যে দল তার কাছে ইতিহাস অতীত বা ভবিষ্যৎ বিষয়ে কোন পরিস্কার দিক নির্দেশনা পাওয়া যায় না। তাহলে এই সংখ্যাধিক্যে লাভ কি? আফ্রিকার অনেক দেশের জনসংখ্যা এশিয়ার কোন কোন দেশের জনসংখ্যা ইউরোপের মোট জনসংখ্যার চাইতে বেশী হতে পারে । তাতে কি প্রমাণ হয় যে আফ্রিকা এশিয়া ইউরোপকে পেছনে ফেলে দিয়েছে? জনসমর্থনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই বলি অনেক সমাজ ও দেশে তা আসলেই কিছু সংখ্যার হিসাব মাত্র।

মোদ্দা কথায় বাংলাদেশ এখন যে জায়গায় সেখানে তার পেছনে যাবার কোন কারণ নাই। যাবে ও না। সে জন্য ই বলি কোন বাংলাদেশ চেয়েছি বলার আগে এই দেশের জন্য আমি আপনি কি করেছি তার একটা হিসাব করেন। এই দেশ আমাদের কম দেয় নি। এ দেশের জন্মলগ্নে আমি তারুণ্যে পা রেখেছিলাম। আমাদের কোন ভালো কাপড় ছিলো না। আমাদের জামা জুতো খাবার দাবার সব ছিল অতি সাধারণ। আমাদের বিলাসিতা ছিল না। কিন্তু শান্তি ছিল। উটকো সরকার মিলিটারী শাসন এসে শান্তি বিদায় না করলে আমরা হত্যাকাণ্ড কি বিষয় জানতাম? আমরা কি জানতাম যে এক রাতে জাতির শ্রেষ্ঠ নেতাকে পরিবারসহ হত্যা করে তার বিচার না করার আইন বা ইনডেমিনিটি পাশ করা যায়? আমরা কি জানতাম জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা যায়? আপনারা এখন বলেন এগুলো অতীত। এসব ঘটনাই আমাদের দেশের নাটকীয় মোড় ঘোরা আর পশ্চাৎপদতার ঘটনা। জিয়ার আমল ও অতীত আপনারা সে কাহিনি আনবেন অথচ এগুলো পুরনো বলে এড়িয়ে যাবেন এটা কেমন কথা?

আমরা যে দেশ চেয়েছিলাম তার বাধা যায় নি। তার আপদ এখনো সমাজে ওৎ পেতে আছে। অন্ধসামপ্রদায়িকতা আর ধর্মান্ধতা যে একটি জাতিকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তার মহড়া প্রায় ই দেখি আমরা। এই মহড়ায় এখন সরকারী দলের লোকজন ও সমান সক্রিয়। যুক্তি নাই তর্ক নাই বিজ্ঞান নাই এমন একটা সমাজ চেয়েছিল বাংলাদেশ? অথচ দেখুন মেধার কোন অভাব নাই। একটু সুযোগ পেলেই মেধা হাজির হয়ে যায়। কিন্তু পুরো দেশব্যাপী যে নেগেটিভ নেট ওয়ার্ক সেটার সামাল দেবে কে বা কারা?

এখনো সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায় নি। আন্তর্জাতিক চাপ থাক আর যে যত কথাই বলুক এখনো দেশের মানুষ জানে কোথায় আস্থা রাখতে হবে। সরকারী দলের যেসব লোকেরা লুটপাট করে বাজারে আগুন লাগিয়ে মুনাফা লুটছে তাদের শায়েস্তা করতে হবে। রাজনীতিতে ফেয়ার প্লের জন্য সব দলকেই একটা মিনিমাম সমঝোতা আর আলোচনায় আসতেই হবে। শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা ও মেধার ওপর ভর করে এগিয়ে চলা বাংলাদেশ তখন ই পথ খুঁজে পাবে।

আমাদের দেশটি তেমন কিছু ই চায় নি। মানুষের মায়া মমতা সবাই মিলেমিশে থাকা আর আর্ধিক ভাবে সচ্ছলতা এটুকুই তার চাওয়া। সে আমরিকার মতো ধনী হতে চায় না। চীনের মতো কঠোরও হতে চায় না। তার দরকার শ্যামল বাংলার মানুষের অগাধ ভালোবাসা আর সমপ্রীতিতে বেড়ে ওঠা। তাহলেই আমরা জানবো কেমন বাংলাদেশ চাই ও চেয়েছিলাম আমরা।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশের স্বাস্থ্য : সামপ্রতিক অর্জন এবং আস্থার সংকট প্রসঙ্গে
পরবর্তী নিবন্ধসৈয়দ শাহ আলম নানুপুরীর (র.) ওরশ সম্পন্ন