মিডিয়া মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে। আপনি বিশ্বাস করেন আর না করেন–এটাই সত্য।এই মিডিয়া এক সময় ভালো মানুষদের পেছনে ঘুরতো। এখনো যে ভালো কিছু প্রমোট করে না এটা বলা যাবে না। চট্টগ্রামের আজাদী বা ঢাকার সংবাদ তেমন জাতীয় সংবাদপত্র যারা নেগেটিভ বিষয় পপুলার করে না। করে না বলেই যুগের পর যুগ টিকে আছে। এমন না যে অন্যান্য মিডিয়া এ বিষয়ে পিছিয়ে। তবে এটা সত্য যে বেশীর ভাগ সময়ই আমাদের দেশে নেগেটিভ বিষয় প্রাধান্য লাভ করে।
খেলাধুলার প্রতি মানুষের মনযোগ চিরকালীন। আমাদের যৌবনেও ক্রিকেট ছিল আকর্ষণ।সে সময়কালের বাংলাদেশে এমন কোন সঙ্গতি ছিল না যে আমরা ভালো বল ব্যাট বা উইকেট যোগাড় করে অনায়াসে তা খেলতে পারবো। তারপর ও মানুষের আগ্রহ আর ভালোবাসায় গড়ে উঠেছে ক্রিকেট জগৎ। আজকে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে ক্রিকেটে উল্লেখযোগ্য একটি নাম। সারা বিশ্বের ক্রিকেট জগৎ একনামে সাকিব আল হাসান কে চেনে। আমাদের দেশের সাফল্যও কম কিছু নয়। কিন্তু আপনি খেয়াল করবেন ধারাবাহিক ব্যর্থতার পাল্লাটাও বেশ ভারী। এ লেখা যখন লিখছি এশিয়া কাপের খেলায় শ্রীলংকার দ্বিতীয় মানের বোলিং এর কাছে ধরাশায়ী হয়েছে বাংলাদেশ। যা ছিল অপ্রত্যাশিত। ফলাফলে জয় পরাজয় থাকবেই। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে খেলা পরবর্তী বা খেলার আগে যে জোয়ার যে উন্মাদনা তার সিকি ভাগ ও নাই আর কোন বড় বিষয়ে। কী সেই বড় বিষয়?
বহু কাল আগে চট্টগ্রামের ফুলকিতে এসেছিলেন সাহিত্যিক গৌর কিশোর ঘোষ। এক সন্ধ্যার আড্ডা ও কথোপকথনে তাকে জানার সুযোগ ঘটেছিল। বলাবাহুল্য তখন বয়স কম যৌবনের বেয়াড়া সময়। তর্ক করতে পছন্দ করতাম। তাঁর মতো মানুষের সাথেও তর্ক লেগে গিয়েছিল আমার। বাম আদর্শ ও বাম ধারার বিরুদ্ধে তাঁর মতামত সহ্য করতে পারি নি বলে অসম তর্কে পরাজিত হবো জেনেও হাল ছাড়ি নি। কোন কোন সময় তর্ক আসে উপকারে। পরদিন তিনি যে সব ছড়া শুনিয়েছিলেন তা আমার স্মৃতিতে জাগরুক। তাঁর কথা বললাম এই কারণে সেদিন জেনেছিলাম এশিয়ার নোবেল নামে পরিচিত রেমন ম্যাগসেসে পুরস্কারের আদ্যপান্ত। কারণ তিনি ছিলেন এর একজন নির্বাচক।
র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারটি তৃতীয় ফিলিপাইনের রাষ্ট্রপতির স্মৃতি এবং নেতৃত্বের উদাহরণ দিতে উদযাপন করা হয় যার নামানুসারে এই পুরস্কারের নামকরণ করা হয়েছে এবং প্রতি বছর এটি এশিয়ার এমন একজন ব্যক্তি বা একটি সংস্থাকে দেওয়া হয় যারা একই নিঃস্বার্থ সেবা প্রকাশ করে যা প্রয়াত এবং প্রিয় ফিলিপিনো নেতার জীবনকে শাসন করেছিল।.
এবার আমাদের দেশের এক তরুণ এই পুরস্কার পেয়েছেন। নিঃসন্দেহে আমরা তাঁর নাম জানি না। জানলেও চিনি না। আর চিনলেও খবর রাখি নি। চলতি বছর এই পুরস্কার প্রবর্তনের ৬৫তম বার্ষিকীতে করভিকে ‘উদীয়মান নেতা‘ হিসেবে এই স্বীকৃতি দিয়েছে র্যামন ম্যাগসাইসাই কর্তৃপক্ষ।
এবারের র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পেয়েছেন আরও ৩ জন, ভারতের রবি কান্নান আর পূর্ব তিমুরের ইগুয়েনিও লেমোস ও ফিলিপাইনের মিরিয়াম করোনেল–ফেরের।
করভি রাসখন্দ। কে এই যুবক? করভি রাখসান্দ হলেন একজন বাংলাদেশী, জাগো ফাউন্ডেশন–এর প্রতিষ্ঠাতা। শিক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য উদীয়মান নেতা হিসাবে ২০২৩ সালে তিনি রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার লাভ করেছেন। করভি স্কলাস্টিকা স্কুল এ পড়াশুনা করেন। তিনি আইন বিষয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় এ স্নাতক ডিগ্রি নেন। ২০০৭ সালের নভেম্বরে তিনি জাগো ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। করভিকে নিয়ে আলাপ করার আগে বলি বাংলাদেশের আরো ১২ জন বিখ্যাত মানুষ এই পুরস্কার জিতেছিলেন। তাঁদের কথা কি মনে আছে আমাদের? এর আগে বাংলাদেশ থেকে মোট ১২ জন এই পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁরা হলেন, সমাজসেবী তহরুন্নেসা আবদুল্লাহ (১৯৭৮), ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ (১৯৮০), গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস (১৯৮৪), গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী (১৯৮৫), ক্যাথলিক ধর্মযাজক রিচার্ড উইলিয়াম টিম (১৯৮৭), দিদার কমপ্রিহেন্সিভ ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট কো–অপারেটিভ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ইয়াসিন (১৯৮৮), বেসরকারি সংগঠন বাঁচতে শেখার প্রতিষ্ঠাতা অ্যাঞ্জেলা গোমেজ (১৯৯৯), বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ (২০০৪), প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান (২০০৫), বেসরকারি সংগঠন সিডিডির নির্বাহী পরিচালক এ এইচ এম নোমান (২০১০), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান (২০১২) ও বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরী (২০২১)।
তালিকাটা দেখলে বা নামগুলো পড়লেই বুঝবেন তাঁদের কাজ ও কাজের পরিধি আমাদের সমাজকে কি দিয়েছে। কেন তাঁরা এমন একটা পুরস্কার জিতে আমাদের জাতির সুনাম বয়ে এনেছিলেন। কিন্তু আমাদের দেশ ও সমাজ তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আমাদের হাতের কাছে সহজলভ্য এমন কিছু মানুষ মিডিয়া যাদের ছাড়া এক মিনিট ও থাকতে চায় না। থাকতে পারে না। তাদের অবদান বা ত্যাগ যাই হোক তারাই আমাদের আইডল। আমি বলছি না যে তারা খারাপ। হয়তো তাদের অবদান ও আমাদের সমৃদ্ধ করে কিন্তু যাদের কথা জানলে বা শুনলে তারুণ্য ভালো পথে যাবে উদ্ধুদ্ধ হবে তাদের কথা প্রচার করা হয় না । রাজনীতি আর তর্কের ভেতর ডুবে থাকা সমাজ একারণেই খোলস ভাঙতে পারে না।
করভি রাসখন্দ কে আমি কোথাও দেখি না। তার প্রচার নাই। তার জাগো ফাউন্দেশনের নাম জানি। জানি তারা সুবিধা হীন নিম্ন বর্গের নামে পরিচিত শিশুদের পড়াশোনার জন্য কাজ করে। লেখাপড়া শেখায় । জাগো ফাউন্ডেশনের বর্তমানে সারা বাংলাদেশে বিস্তৃত স্কুল রয়েছে যা ৪৫০০ সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিনামূল্যে পাঠদান সেবা দিয়ে যাচ্ছে। জাগোর প্রধান বার্ষিক ইভেন্টগুলোর মধ্যে একটি হল ‘সর্বজনীন শিশু দিবস‘।ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবক প্ল্যাটফর্ম ‘ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশ‘-এর মাধ্যমে ৫০,০০০ এরও বেশি সংখ্যক মানুষ যারা শিশুদের অধিকারের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই দিবসটি উদযাপন করে।
এটাই জানি তাদের কার্যক্রম আর ব্যক্তিজীবন নিয়ে কিছু কথা চালু আছে। আছে অভিযোগও। সে সবের সত্য মিথ্যা নির্ণয় করা আমাদের কাজ নয়। আমরা তা পারবো ও না। যে ভাবে বিষয়টাকে দেখি তা খুব সহজ সরল। এটা একজন বাংলাদেশির কৃতিত্ব। আমাদের দেশের একজন তরুণের সাফল্য। করভি রাসখন্দ সেই তরুণ যে সাকিব আল হাসান বা আর কারো চাইতে কম কিছু না। দেশ ও দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানো এই তরুণকে স্যালুট জানাই। যে আমাদের জাতির মুকুটে পরিয়ে দিয়েছে আরেক পালক। এটাই বাংলাদেশের জয়। মানুষের জয়। সে প্রমাণ করেছে কোন কাজই বৃথা যায় না। সব ভালো কাজের ফল যোগ হয় আমাদের জীবন ও ভবিষ্যতে। জয়তু করভি রাসখন্দ। জয় হোক বাংলাদেশ ও বাঙালির।
লেখক : সিডনি প্রবাসী কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট