আগস্ট মাসকে আমরা বলি শোকের মাস। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার এই মাস সত্যি আমাদের শোকের মাস। জাতির পিতাকে হত্যার পর যে অমানিশা আর অন্ধকার আজ তা দূরীভূত। তবু আমাদের সমাজে শান্তি আর সহমর্মিতা আসে নি। কেন আসে নি? এ সব নিয়ে অজস্র লেখালেখি আর কথা হয়েছে। সবচাইতে বড় বিষয় যেটি বাংলাদেশের মানুষের এবং দেশের বাইরের বাঙালির মনোজগতে যে ব্যাপক পরিবর্তন আমরা কি আসলেই তার খবর রাখি ? রাখলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকতো না। এখন যা দেখা যাচ্ছে না বা অদৃশ্য সে ভয় কিন্তু আছে। আর এই ভীতি প্রবল বলেই সরকারী দল এক নাগাড়ে প্রচার করতে ব্যস্ত। প্রচারে প্রসার এই কথাটা অন্য সবকিছুর বেলায় সত্য হলেও বঙ্গবন্ধুর বেলায় নয়। কারণ তাঁর বিরুদ্ধে যত অপপ্রচার হয়েছে ততো তাঁর আসন শক্ত হয়েছে। পোক্ত হয়েছে তাঁর অবস্থান।
এই যে মনোজাগতিক পরিবর্তন সেটা বরং আলাপ করি। শ্রাবণের বাইশে আমাদের কবিগুরুরও প্রয়াণ দিবস। যা আগস্টে পড়েছে। সে দিক থেকে আমাদের জাতীয় জীবনের দুই বিশাল মহীরুহের প্রয়াণ ও বিষাদের আবহে ঢাকা এই মাস। রবীন্দ্রনাথ এখন আমাদের জীবনে কতটা আছেন বা নাই সে তর্কে না গিয়েও বলি তিনি কিন্তু থাকবেন। যত ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাঁর অনীহার মিথ্যা অজুহাত তুলে তাঁকে একপেশে করা হোক না কেন রবীন্দ্রনাথ সদা জ্যোর্তিময়। মুশকিলটা এই আমাদের দেশে রবীন্দ্র বিরোধিতা হচ্ছে সামপ্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে। সেই পাকিস্তানী আমলের মতো। অযথা কবি নজরুলকে টেনে এনে অহেতুক তুলনা করে যে বিরোধিতা তার ধারাবাহিকতা কমে নি। যদিও তাতে লাভ নাই তবু একদল মানুষ তা করেই আনন্দ লাভ করে। এদের আমরা চিনি। অন্যদিকে ওপার বাংলা যেখানে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানেও রবীন্দ্রনাথ শান্তিতে নাই। তাঁকে কৌতুক ও মজার পাত্র করে তোলার পাশাপাশি তাঁর গান নিয়ে চলছে যাবতীয় অপকর্ম। এমন ই অবস্থা তাঁর গান প্যারোডি করার নামে অশ্লীলতা ছড়াতেও দেখেছি। অর্থাৎ বাঙালির মনোজগত পাল্টে গেছে। সেটা এপার ওপার বা দেশের বাইরে সব জায়গায়।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রাণ পুরুষ। জরীপ বিষয়টি খারাপ কিছু না। বরং তাতে জনমত বের হয়ে আসে। কিন্তু জরীপ ই সবকিছু নয়। সে কারণে রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর মতো মানুষদের বিবেচনা করতে হয় অন্য মানদণ্ডে। সোজা কথায় বাঙালি যদি রবীন্দ্রনাথ কে না জানে বা না পড়ে বা তাঁর প্রতি মনযোগী না হয় তাহলে কবি‘র কোন লাভ লোকসান নাই। আমাদের ভবিষ্যৎ ই হবে ভয়াবহ। পরিশ্রম বিমুখ আমাদের আজকের প্রজন্ম বা আমাদের বয়সীদের জানা উচিৎ আধুনিক যুগে মানুষ অনেক বেশি যান্ত্রিক হলেও, আবেগ অনুভূতি প্রকাশে এখনও ফিরে আসতে হয় রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিসম্ভারে। ৫২টি কবিতার বই, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ বই এবং অন্যান্য গদ্য সংকলন লিখে গেছেন তিনি। তাঁর লেখা ছোট গল্পের মোট সংখ্যা ৯৫টি এবং তিনি প্রায় ২০০০ গান লিখেছেন, যা যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতানে সংকলিত করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত বই এবং অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে।
এতো বড় সৃষ্টিসম্ভার থাকার পর ও আমরা তাঁকে নিয়ে বিতর্ক করি। রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে যাদের জ্ঞান অস্পষ্ট তাদের জন্য বলি: রবীন্দ্রনাথের ঘুম ছিল খুব কম। গভীর রাতে ঘুমাতেন, উঠতেন শেষ রাতে। সাধারণত তার দিন শুরু হতো স্নানান্তে উপাসনায়–ঠিক ভোর ৪টায়। ভোর থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত কবি একটানা লিখতেন। সকাল ৭টায় প্রাতরাশ সেরে আবার লেখা। ফাঁকে ফাঁকে হতো চা বা কফি পান। বেলা ১১টা পর্যন্ত লিখতেন। এরপর পুনরায় স্নান করে দুপুরের খাবার খেতেন। দুপুরে খাওয়ার পর ঘুমাতেন না। এমনকি এ সময় তিনি বিশ্রামও নিতেন না। পত্রিকা বা বইয়ের পাতা উল্টিয়ে সময় কাটিয়ে দিতেন। বিকেল ৪টায় চা, সঙ্গে নোনতা কিছু। রাতের খাবার খেতেন সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে। এ সময় তিনি ইংরেজি খাবার পছন্দ করতেন। অথচ দুপুরে খেতেন বাঙালি খাবার। রাতে খাবার পর একটানা রাত ১২টা পর্যন্ত লেখা বা পড়া ছিল নিয়মিত বিষয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাড়িতে পরতেন গেরুয়া বা সাদা রঙের জোব্বা আর পায়জামা। উপাসনা বা সভা সমিতিতে যাওয়ার সময় জোব্বা ছাড়াও সাদা ধুতি, জামা ও চাদর ব্যবহার করতেন। ঋতু উৎসবে ঋতু অনুযায়ী নানা রঙের রেশমী উত্তরীয় ব্যবহার করতেন। যেমন বর্ষায় কালো বা লাল, শরতে সোনালি, বসন্তে বাসন্তী।
কখনো কখনো জোব্বার রঙের সঙ্গে মিলিয়ে উত্তরীয় পরতেন। বৃক্ষপ্রেমী রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায় ছড়িয়ে আছে অসংখ্য উদ্ভিদ আর ফুলের নাম। শুধু কাব্যেই উল্লেখ রয়েছে ১০৮টি গাছ ও ফুলের নাম। এর মধ্যে বেশ কিছু বিদেশি ফুলের বাংলা নাম তিনি দিয়েছিলেন। অগ্নিশিখা, তারাঝরা, নীলমণিলতা, বনপুলক, বাসন্তী এগুলো তারই দেয়া নাম।
প্রজাদের তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। তিনি নিজেও হোমিওপ্যাথি পদ্ধতিতে চিকিৎসা নিতে পছন্দ করতেন। ‘হেলথ কো–অপারেটিভ’ তৈরি করে চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থা ভারতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম চালু করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও বন্ধুপুত্র সন্তোষ মজুমদারকে আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন কৃষি ও পশুপালন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য। তারা ফিরে এসে শিলাইদহ ও পতিসরে ৮০ বিঘা জমি নিয়ে আদর্শ কৃষিক্ষেত্র তৈরি করেন। পাশাপাশি তৈরি করা হয় ল্যাবরেটরি।
১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পতিসর কৃষি ব্যাংক’ চালু করেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, নোবেল প্রাইজের টাকা দিয়ে তিনি কৃষকদের সুবিধার কথা ভেবে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। এখান থেকে কৃষকদের স্বল্প সুদে ঋণ দেয়া হতো। ব্যাংক চলেছিল কুড়ি বছর। এই যে একজন মানুষ শুধু লেখালেখি নয় যাবতীয় কাজকর্ম করে প্রজাদের ভালো মন্দ ঠিক রেখে আমাদের অজস্র গান উপহার দিয়েছেন তাঁকে কেন আমরা প্রশ্নবানে বিদ্ধ করছি? যে মানুষটি বাংলাদেশ ভারত দুটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা এ ছাড়া শ্রীলংকার জাতীয় সঙ্গীতটিও প্রকারন্তরে তাঁর সেখানে কেন এই উদাসীনতা বা ক্রোধ ?
কথাগুলো আপনাদের জানা। তবু বলছি এই কারণে সেই পাকিস্তানি আমলে নিষিদ্ধ রবীন্দ্রনাথের আবার ফিরে আসার পর ও আমাদের রাগ বা মন্দভাব গেলো না। অন্যদিকে যিনি আমাদের একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পতাকা এবং রবীন্দ্রনাথকে ফিরিয়ে দিলেন তাঁর প্রতিও আমাদের সর্বজনীন ভালোবাসা জন্মালো না। অনেকে বলেন এর জন্য দায়ী সরকারী দলের অতি আবেগ বা অতিপ্রচার। কথাটা উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। কিন্তু সেটাই যদি সত্য মানি তো বঙ্গবন্ধুর বেলায় মানলাম রবীন্দ্রনাথের বেলায় কি তা সত্য? আসলে আমাদের চিন্তা চেতনা আর পড়াশোনার জগতে যে অন্ধকার তার কারণেই আজ এই দুর্দশা। বাঙালির দুই মহান কবি,সংস্কৃতির কবি রবীন্দ্রনাথ রাজনীতির কবি শেখ মুজিবুর রহমান। একজন লিখেছিলেন আরেকজন স্পষ্ট উচ্চারণে শুনিয়েছিলেন, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করো নি….
এতো উন্নয়ন এতো অগ্রগতি এতো গাড়ি এতো বাড়ি এত বিলাস রমরমা জীবন কিন্তু কোথাও যেন হারিয়ে গেছে স্বপ্নালোকের চাবি। সেই চাবিটি কি আমরা কুড়িয়ে নিতে পারবো না? মুক্তিযুদ্ধের যে আবেগ স্বাধীন জাতির যে পরিচয় তা যতটা ফিকে হয়ে আসুক না কেন এ দুই বাঙালির নাম বললেই আবার তা জ্বলে ওঠে । সে আলোর নাম বজ্র বিদ্যুৎ। যা ঘোর অন্ধকারেও পথ দেখায়। বাইশে শ্রাবণ এলেই মনে পড়ে : এই শ্রাবণের বুকের ভেতর আগুন আছে । সে আগুনের দুই মহাপুরুষের নাম রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধু।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট