তখন আমরা তরুণ। আমাদের দেশের শিশুসাহিত্যের মূল আশ্রয় তখন দৈনিক পত্রিকার শিশুপাতা। সে এক তুমুল প্রতিযোগিতার সময়। একদিকে সংবাদের খেলাঘর, অন্যদিকে ইত্তেফাকের কচিকাঁচার আসর। মাঝখানে পূর্বদেশ পত্রিকার চাঁদের হাট। কচিকাঁচার আসরের দায়িত্বে ছিলেন প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক ও সংগঠক রোকনুজ্জামান খান। যাঁর পোশাকী নাম কেউ জানতো না। তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল দাদাভাই। আসরের পরিচালক দাদাভাই ছাপিয়ে গেছিলেন ব্যক্তিসত্তাকে। দাদাভাইয়ের চিঠি নামে তিনি প্রতি হপ্তায় কচিকাঁচার আসরে যে চিঠিটি লিখতেন তার অবদান অসমান্য। গৎবাঁধা কোন চিঠির পরিবর্তে সে চিঠি ছিল তথ্য আর নতুন ধারণায় ঠাসা। তেমনি এক চিঠিতে প্রথম জেনেছিলাম সুবীর নন্দীর কথা। গায়ক সুবীর নন্দীও তখন তরুণ। সিলেট ভ্রমণকালে দাদাভাইয়ের সফরসঙ্গী তরুণ সুবীর নন্দী তাঁকে সারা রাস্ত গান শোনানোর সুযোগ পেয়েছিল। তাঁর গানে মুগ্ধ দাদাভাই সেদিন লিখেছিলেন এই তরুণের মধ্যে তিনি দেখতে পাচ্ছেন অপার সম্ভাবনা। এই ছেলে যে একদিন গান গেয়ে দেশ মজাবে সে বিষয়ে তাঁর মতামত ছিল কুন্ঠাহীন। বলাবাহুল্য সে আগামবাণী সত্য হয়েছিল। সুবীর নন্দী বাংলাদেশে শুধু বিখ্যাত গায়ক হন নি বাংলা গানেও তাঁর গায়কি আর সুরের খেলার জন্য বিশেষ জায়গা দখল করে আছেন। আজ দাদাভাই ও সুবীর নন্দী কেউ বেঁচে নাই। কিন্তু ইতিহাস রয়ে গেছে। রয়ে গেছে গান ও সাহিত্যের সেই শিল্পবন্ধন।
এরপরের ইতিহাস বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর আগমনের ইতিহাস। গান বাংলা বাঙালির প্রাণ। আমরা এমন এক জাতি যারা জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সববিষয়ে গান চর্চা করি। বিয়ের আসরে যেমন গান অপরিহার্য তেমনি সামান্য ছাদ ঢালাইয়ের কাজেও আমাদের দেশের মানুষ গানের এস্তেমাল করে। গানের এমন বহুগামিতার কথা বাণিজ্যকর্তাদের অজানা কিছু না। তারা যখন থেকে বাংলাদেশে বাণিজ্য করতে মন দিলো তখন কোন বিষয় ই আর বাণিজ্যের বাইরে থাকলো না। সাহিত্য সংস্কৃতি গান বাজনা সব চলে গেলো তাদের দখলে। কী দেখলাম আমরা? আগে গানের চর্চা হতো বাড়িতে। ঘরে ঘরে হারমোনিয়াম আর গানের গলায় মূর্ত হয়ে উঠতো বাঙালির সন্ধ্যা। সে গান একলাফে ঘর বারান্দা পাড়া মহল্লার স্টেজ ছাড়িয়ে চলে গেলো বোকা বাক্সে। শুরু হয়ে গেলো প্রতিযোগিতার নামে শিল্পী ধরে এনে তাদের ভেতর প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরী করা। প্রতিযোগিতা খারাপ কিছু না। বরং সুস্থ স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করে। সামনে এগিয়ে যেতে সাহস যোগায়। আমরা বোকা সোকা আম জনতা। আমরা ধরে নিয়েছিলাম তেমন কিছুই হতে চলেছে। কিন্তু ভুল ভাঙতে সময় লাগলো না। চ্যানেলে চ্যানেলে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা গানের প্রতিযোগিতা পরিণত হলো যুদ্ধে। সবকিছুর মতো হুজুগে বাঙালি গানের বেলায় পিছিয়ে থাকবে কোন দুঃখে? প্রায় প্রতিটি চ্যানেল যখন এমন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ তখন সত্যিকারের বিচারক ও প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাব তো থাকবেই। সে অভাব পূরণের জন্য, বলা ভালো শূন্যস্থান পূরণের জন্য অশিল্পী অগায়ক, অবিবেচক বিচারক গান বিষয়ে ধারণাহীন মানুষদের ধরে এনে শুরু হলো নয়া কান্ড। সবাই জানেন টিভি‘র ব্যবসা নির্ভর করে বিজ্ঞাপন আর টি আর পি‘র ওপর। বিজ্ঞাপনদাতাদের মনোরঞ্জনের পাশাপাশি টিআরপি বাড়াতে শুরু হয়ে গেছিল অপকৌশল ।
শুধু বাংলাদেশ না এই ধারা এই প্রবাহ চললো ওপার বাংলায়। এখন আমাদের বাংলাদেশে গানের প্রতিযোগিতা মূলক অনুষ্ঠানগুলোর হিড়িক কমেছে। কারণ সর্বনাশ যা করার তা করে দিয়ে গেছে অপপ্রক্রিয়া। সাধনা ও মনযোগের জায়গা থেকে গান এসে দাঁড়িয়েছে ভিন্ন এক জায়গায়। যেখানে সনজীদা খাতুন বা অদিতি মহসীনের দরকার পড়ে না। যন্ত্র আর যন্ত্রী থাকলেই হয়। সাথে জুটেছে ডিজিটাল ভূতের আশীর্বাদ। সে ভূত না কি এখন কন্ঠও ঠিক করে দেয়। কিছুদিন আগে প্রিয় গায়িকা কবিতা কৃষ্ণমূর্তির একটা আলোচনা দেখছিলাম। উপমহাদেশের বিখ্যাত এই গায়িকা হিন্দী বাংলা সহ রবীন্দ্রনাথের গানে সমান জনপ্রিয়। তিনি দুঃখ করে বলছিলেন তাঁরা কত কষ্ট করে কতটা মেহনত করে গান শিখতেন। ভুলচুক হলে গুরু বা ওস্তাদেরা কতটা কঠিন হতেন। কারণ তখন সাবর মনে একটাই উদ্দেশ্য কাজ করতো গান মানে একটি সাধনার জন্ম দেয়া। কবিতা কৃষ্ণমূর্তি বলছিলেন এই যে গানের কন্ঠ থেকে বিকৃতি বা উচ্চারণ সবকিছু যন্ত্র নির্ভর এই নির্ভরতাই একদিন গানের বারোটা বাজাবে।
তাঁর কথা যে কতটা সত্যি সেটা আমরা আমাদের দেশের চ্যানেলে বিজয়ী হওয়া এক তরুণ এবং ওপার বাংলার সারেগামাপা শোয়ে বিখ্যাত হয়ে আসা দেশের আরেক তরুণের পরিণতি দেখলেই বুঝতে পারবো। প্রথমজন নোলক বাবু। টিভি চ্যানেলের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠা নোলক বাবু সেলিব্রেটি হয়ে বেরুলো বটে কিন্তু গানের ভাঁড়ার বা শেখার জগৎ তো শূন্য । সেট ভুলে গেলে তো চলবে না। তারপর যা হয়, ড্রাগস মাদক নারী সবমিলিয়ে অন্ধকার এক জগৎ। অতঃপর হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া। সম্ভাবনা নিশ্চয় ই ছিল। তা না হলে কি এতগুলো প্রতিযোগী ডিঙ্গিয়ে প্রথম হতে পারে কেউ? কিন্তু পরিচর্যা আর শেখার গাফিলতিতে সকল ই গরল ভেল। আজ নোলক বাবু‘র নাম জানে না কেউ। পরেরজন সমপ্রতি সংবাদ শিরোনাম ।
নোবেল নামের যুবকটি খারাপ কিছু গাইতো না। আমি বহুবার তার গান শুনেছি। জী বাংলার অন্যতম সেরা আকর্ষণ গানের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান সারেগামাপা। সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র । উভয় বাংলার নামে হলে ও মূলত: ওপার বাংলার দর্শক শ্রোতা আর প্রতিযোগীদের জন্য এই অনুষ্ঠান। কিন্তু বানিজ্য ঠিক বোঝে কোনটা করতে হবে আর কোনটা না। ওরা জানে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে তাদের বস্তাবন্দী সিরিয়াল আর এই অনুষ্ঠানটি বিপুল জনপ্রিয়। অত:এব তাদের এই বাংলা মানে বাংলাদেশ থেকেও প্রতিযোগী রাখা দরকার। তাতে বাংলাদেশের দর্শকদের পাওয়া সহজ হবে। গড়ে উঠবে সস্তা জনমত। ভোট বা সমর্থনের নামে মোবাইল কোম্পানীগুলোর টু পাইস কামানোর পাশাপাশি টিআরপি ও চড়বে শীর্ষে। নোবেল গেলো বাংলাদেশ থেকে। গোড়াতে বিনয়ী ভদ্র ছেলেটি অনেকসময় যখন অকারণ অনুকূল্য পাচ্ছিল তখনই আমার মনে হয়েছিল এই রাজনীতি ছেলেটির বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে। যারা বাণিজ্যের নামে তারুণ্যের প্রতিভাকে হয় অতিমূল্যায়ন বা অবমূল্যায়ন করে তাদের এসবে কিছু যায় আসে নাল মাশুল দেয় তরুণ তরুণীরা। এর বেলায় ও তাই হয়েছে । লাই পেয়ে মাথায় ওঠা নোবেল প্রথমেই কলকাতার ওপর একহাত নিয়েছে। তারপর এমন অবসহা আমাদের প্রাণপ্রিয় জাতীয় সঙ্গীত বদলানোর ব্যাপােেরা বালখিল্য মত দিয়ে কোটি মানুষকে আহত করেছে। সবশেষে মদ খেয়ে গানের আসরে দর্শকশ্রোতাদের হাতে অপমান। ছেলেটি এখন আছে ঘোর বিপদে। খবরে দেখলাম তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।
বিষয়টা নোবেল বা যুব সমাজ না ভেবে আপনি যদি সত্যিকারের পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করেন দেখবেন এরা উচ্চাভিলাষী এবং শিকার। শিকার বাণিজ্যের। শিকার সমাজের অশুভ শক্তির। যারা আমাদের দেশের গান বাজনা সংস্কৃতির বারোটা বাজায় তারাই বছর বছর এমন নোলক নোবেল পয়দা করে। যারা গান গাইবার আগেই প্রচারের জোরে গায়ক। শিল্পী হয়ে ওঠার আগেই কারাগারে কিংবা সমাজচ্যুত। এই ভয়াবহ বাস্তবতা অন্যান্য অভিভাবকদের শংকিত করে। তারা তাদের সন্তানদের গানের জগতে পাঠাতে ভাববেন বা চিন্তা করবেন এটাই স্বাভাবিক ।
দেশের গান বাঙালির গান সংস্কৃতি বাঁচাতে এসব অপপ্রতিযোগিতা ও ফাস্ট সেকেন্ড বাণিজ্য বন্ধ করা জরুরি। সংস্কৃতি জীবনভর বয়ে চলা এক বিষয়। এটা একশ মিটার দৌড় না যে দড়ি ছুঁলেই কেল্লা ফতে। সাধনা সময় ও ধৈর্যের ভেতর দিয়ে আবার কি গড়ে উঠবে সুস্থ ভুবন? আমরা সে প্রত্যাশায় থা।
লেখক : সিডনি প্রবাসী কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট