দূরের দুরবিনে

শীর্ষদেশে পরিবর্তন: আশা ফলবতী হোক

অজয় দাশগুপ্ত | বৃহস্পতিবার , ২৭ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ

রাষ্ট্রপতি মূলত একটি আলংকরিক পদ। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদের এই মানুষটি সম্পর্কে আবদুল হামিদ ও ভারতের একমাত্র বাঙালি রাষ্ট্রপতির কথা এক। দুজনই বলেছেন এ যেন পাঁচ তারকা কারাগারে বন্দী আয়েশী জীবন। এর ভেতরেই থাকতে হয় তাঁদের। এ কথা যে কোনও সরকার প্রধানের বেলায়ও সত্য। উপমহাদেশে বা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এটাই নিয়ম। অথচ উন্নত দেশ নামে পরিচিত দেশ ও সমাজে এসবের বালাই দেখি না। ব্যক্তিগতভাবে আমি দেখেছি অষ্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী রাস্তা পার হচ্ছেন পায়ে হেঁটে। সিডনির ব্যস্ততম রাস্তায় ট্রাফিক লাইটের লাল আলোয় অসহায় উদ্বিগ্ন অপেক্ষারত প্রিমিয়ারের সাথে কথাও বলেছি আমি। সহজ জীবনের কারণে একটা দুটো সিকিউরিটি গার্ড ব্যতীত আশেপাশে কোনও নেতা বা উপনেতার ভীড় থাকে না। কেউ কাউকে তোয়াজ না করা সমাজে এটাই রীতি।

আমাদের দেশের চিত্রটি তার উল্টো। নেতা মানেই সাথে লোকজন। চ্যালাদের ভীড়। বলছিলাম রাষ্ট্রপতির কথা। এই পদটি দেশের সর্বোচ্চ পদ। তাঁর বিরুদ্ধে কোনও কথা বলা না জায়েজ। কারণ তিনি রাষ্ট্রের প্রতীক। এটি মূলত সম্মান আর মর্যাদার কারণেই করা হয়। তারপরও গণতান্ত্রিক দেশে কিছু না কিছু বলার লোকজন বা মিডিয়া থাকে। গোড়াতেই বলি গণতন্ত্র যে সব দেশে প্রতিষ্ঠিত শাসন ব্যবস্থা সেখানে কথা বলা অবারিত। তাই আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে নিয়ে ব্যঙ্গ করা যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পাগল বলা যায়। বাইডেন কে অথর্ব বললেও জান নিয়ে টানাটানি পড়ে না। অথচ কোনও কোনও দেশে এসব করা তো দূরের কথা ভাবাও অপরাধ। প্রশ্ন হচ্ছে আপনি কী চান বা কাদের আদর্শ মনে করছেন। ধরেন যদি আমরা উত্তর কোরিয়ার সাথে তুলনা করি তাহলে নিশ্চিত ভাবে বেহেশতে আছে মানুষ। কারণ সে দেশে মানুষের কথা বল তো বটেই ভাবারও কোনও অধিকার নেই। সে দেশের এক নাগরিকের বাড়িতে ভয়াবহ আগুন লেগেছিল। ভদ্রমহিলা আগুন থেকে বাঁচতে তার ছেলে মেয়েকে নিয়ে কোনওভাবে পালিয়ে বাঁচলেও শেষ রক্ষা হয় নি। কেন তিনি পালানোর সময় বাড়িতে অবশ্য রাখা কিম ও তার পিতার ছবি বাঁচায় নি সে কারণে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। সে দেশে সব মানুষের বাড়িতে একটা করে রেডিও দেয়া আছে। সে রেডিও সবসময় চলবে। অর্থাৎ সরকারের সময় মতো চলে। এটি বন্ধ করার কোনও নিয়ম নেই। আর যে সময় পর্যন্ত এটা চালু থাকে পুরোটাই সরকারের প্রচার আর নিয়ম বলা হয়। বুঝুন এবার। সে তুলনায় আমাদের দেশ বা সমাজ কতটা ঝুঁকিহীন।

আমাদের সমাজের সমস্যা কথা বলায় নয়। কথা বেশি অথবা না বলায়। বেশি বলতে যার যে বিষয়ে জ্ঞান নেই অভিজ্ঞতা নেই সে তা নিয়ে মতামত দেয়। যে যা জানে না তাই বলে। আর এমন একটা ভাব যেন সর্বজান্তা। এর ফলে সামাজিক মিডিয়ায় এদের দৌরাত্ন্য বেড়েছে। আকছার বিপদে ফেলছে মানুষকে। নিজেরাও এড়াতে পারছে না নিজেদের বিপদ। অন্যদিকে যাদের বলার কথা বা যারা বললে সমাজ ও দেশ উপকৃত হয় তারা থ মেরে গেছেন। এমন একটা পরিবেশ বিশিষ্টজনদের অনেকে আছেন কি নেই তাও জানা যায় না। এহেন পরিবেশ দেশের তরুণ তরুণীদের জন্য প্রতিকুল হতে বাধ্য। সরকারের সমালোচনা বৈধ। কিন্তু নিন্দা? তাও কী না যার যার মন মতো? অন্যদিকে তোয়াজকারীদের পোয়াবারো। তারা তেল বাদ দিয়ে এখন ঘি মাখন ঢালতে ব্যস্ত। এমন সমাজে আপনি সুষম আলোচনা করার লোককে কোথায় পাবেন? কীভাবে পাবেন?

আমাদের নতুন রাষ্ট্রপতিকে দেখে মনে হলো পরিমিত কথার মানুষ। যদিও এখন কিছু বলার সময় হয় নি। অন্যদিকে বিদায়ি রাষ্ট্রপতি ছিলেন প্রগলভ। মাঝে মাঝে তাঁর রসিকতা মাত্রা ছাড়িয়ে যেতো বলেও মনে করেন অনেকে। অথচ আমাদের প্রত্যাশা বাংলাদেশে কথা বলার অধিকার থাকবে। থাকবে এমন মানুষজন যারা কিছু বলা মানেই জাতি শিখবে। খুব দূরের কথা বা দূরের ব্যাপার নয় ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বাঙালি প্রণব মুখোপাধ্যায়। ভদ্রলোককে রাজনীতিতে চাণক্য বলা হতো। যার অর্থ বুদ্ধিমান ও চতুর। যিনি মারপ্যাঁচে সিদ্ধহস্ত। সে মানুষটি রাষ্ট্রপতি হবার পর বদলে গেলেন। কংগ্রেসের হয়েও হলেন সবার। পালন করলেন রাজধর্ম। যে ধর্মে দেশের সব দল ও মতের মানুষের সমান অধিকার। এটাই তো দেশের শীর্ষ নেতার দায়িত্ব। মানুষ তো সাধারণ। তারা ভুল করবে শুদ্ধ করবে তাদের পথ দেখাবে এঁরা। যে কোনও দু:সময়ে বা বিপদে এঁরা হবেন আগুনের মতো। আর সুখের সময় গাছের ছায়া। সে জায়গা পূরণ হয় নি। বরং কী দুভার্গ্য! দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন মোহাম্মদউল্লাহ। যিনি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ভোল পাল্টাতে দেরী করেন নি। শুধু কি তাই? তিনি একশ আশি ডিগ্রি উল্টে বিএনপির এম পি হয়ে গেলেন। এই চরিত্র থেকে কী শিখবে জাতি?

আজ দেশ এগিয়েছে। মানুষ নিজেদের মতো করে বড় হতে চাইছে। দেশের পাশাপাশি বিদেশে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশীর বসবাস। যিনি আমাদের রাষ্ট্রের প্রতীক তিনি তো এমন একজন হবেন যিনি কথা বললে তা হবে আদর্শ। তিনি অন্ধকারে পথ দেখাবেন। এমন একজন মানুষের বড় দরকার। আমরা আশাবাদী। আমাদের এই দেশ বহু রক্ত শ্রম আর ত্যাগের দেশ। বাঙালির রক্তরেখায় স্বাধীন এই ভূখণ্ডে আজ অনেক জঞ্জাল। উগ্রতা সংকীর্ণতা এমন কি হানাহানি শেষ হয় নি। বাড়ছে অসন্তোষ আর বিভেদ। মূল্যবোধ উধাও। লুটপাট আর চুরি রাহাজানিতে ভরা সমাজ। লেখাপড়ার মান নিম্নগামী। বাজার দরে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ জনগণ। এসব বিষয়কে প্রাধান্য দিলে আড়ম্বর কমতো। সময় এখনো বয়ে যায় নি। তাই আশা করি রাষ্ট্রপতির অভিভাবকত্বে গণতন্ত্র নির্বাচন আর দেশ মাথা তুলে থাকবে। দূর হবে অকারণ যতো ঝামেলা। অভিনন্দন আর শুভেচ্ছার ফলবতী সময় কি আসবে?

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকৃত্রিম মেধা, আধুনিক বিজ্ঞান ও তোতা পাখি
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম