দূরের দুরবিনে

বাঙালির নববর্ষ : কলহ নয়, চির আনন্দের শাশ্বত উৎস

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ১৪ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:১০ পূর্বাহ্ণ

বাঙালির সর্বজনীন উৎসব আসলে কোনটা? খেয়াল করবেন একুশে স্বাধীনতা বিজয় কোনো অর্জনই আমরা অবিকৃত রাখি নি। এগুলো আমাদের শেকড়। অস্তিত্বের অহংকার। তারপর ও প্রত্যেকটি দিবস নিয়ে আছে মতভেদ। কথা ছিল একাত্তরে মীমাংসিত এই বিষয়গুলো নিয়ে আর কোনোদিন কোনো কথা উঠবে না। তা কী হয়েছে? বরং যত সময় গেছে ততো দিবসগুলো নিয়ে তর্ক আর ঝগড়া বেড়েছে। শুধুমাত্র বাংলা নববর্ষের দিনটিই ছিল অপরিবর্তিত। যার ওপর আঁচড় পড়ে নি। কিন্তু এবার যেন তার গায়েও আঁচড় পড়তে যাচ্ছে।

বলে রাখি বাংলা নববর্ষ কোনো সামপ্রদায়িক উৎসব নয়। বরং এর পরতে পরতে আছে বাঙালির প্রাণ স্পন্দন। ইতিহাস বলছে: সৌরপঞ্জি মতে বাংলায় ১২টি মাস অনেক আগে থেকেই পালন হয়ে আসছে। কিন্তু গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় দেখা যায়, এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় এ সৌর বছর গণনা শুরু হতো। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য শুরুর পর থেকে আরবি বছর হিজরি পঞ্জিকা অনুযায়ী তারা কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সাল চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি ফলনের সঙ্গে এর কোনো মিল পাওয়া যেত না। আর তখনই সম্রাট আকবর এর সুষ্ঠু সমাধানের জন্য বাংলায় বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সম্রাটের আদেশ অনুযায়ী সে সময়কার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ আমীর ফতেহউল্লাহ সিরাজী সৌরবছর ও আরবি হিজরি সালের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম তৈরির কাজ শুরু করেন। বাংলা বছর নির্ধারণ নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইয়ের প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে পরীক্ষামূলক এ গণনা পদ্ধতিকে কার্যকর ধরা হয় ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর তারিখ থেকে অর্থাৎ সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের তারিখ থেকে। প্রথমে ফসলি সন বলা হলেও পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি পেতে শুরু করে।

বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল নববর্ষ পালিত হয়। বাংলা একাডেমি কর্তৃক নির্ধারিত পঞ্জিকা অনুসারে এ দিনটিকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। বাংলা দিনপঞ্জির সঙ্গে হিজরি ও খ্রিষ্টীয় সনের মৌলিক কিছু পার্থক্য রয়েছে। তা হলো হিজরি সন চলে চাঁদের সঙ্গে আর খ্রিষ্টীয় সাল চলে ঘড়ির সঙ্গে। এ কারণে হিজরি সনের নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় নতুন চাঁদের আগমনের মধ্য দিয়ে, ইংরেজি দিন শুরু হয় মধ্যরাতে আর বাংলা সনের শুরু হয় ভোরের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে।

এই নববর্ষ নিয়ে কেন এই অপ প্রক্রিয়া? হঠাৎ কেন মনে হচ্ছে এর সাথে হিন্দুয়ানির যোগ আছে? কেন মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধ করার অপচক্রান্ত? রবিবার রেজিস্ট্রি ডাকযোগে পাঠানো এক নোটিশে বলা হয়েছে যে, পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হাজার বছর ধরে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর বাঙালি জনগণ পরস্পরের ধর্মকে সম্মান করে এই পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে আসছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, মঙ্গল শোভাযাত্রার নামে একটি কৃত্রিম কার্যকলাপ বাঙালি সংস্কৃতির পহেলা বৈশাখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। মূলত এই কৃত্রিম উদ্ভাবিত মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে পহেলা বৈশাখের কোনো সম্পর্ক নেই।

১৯৮৯ সালে পহেলা বৈশাখে ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামে এক ধরণের পদযাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে এই আনন্দ শোভাযাত্রাকে মঙ্গল শোভাযাত্রা হিসেবে নামকরণ করা হয়। নোটিশে আরো বলা হয়, ‘মঙ্গল’ শব্দটি একটি ধর্মীয় সংশ্লিষ্ট শব্দ। সব ধর্মের লোকজন তাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে ‘মঙ্গল’ প্রার্থনা করে থাকেন। এখন এই মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে বিভিন্ন ধরণের দৈত্য আকৃতির পাখি, মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর ভাষ্কর্য প্রদর্শনের মাধ্যমে মুসলিম জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হচ্ছে যা বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২ () এর সরাসরি লংঘন।

উকিল সাহেবের বয়সও তেমন বেশি বলে মনে হলো না। আজকাল আমাদের সমাজ রাষ্ট্র এমন কি বিদেশের বাংলাদেশীদের ভেতরও দেখি প্রবীণ মানুষদের চাইতে নবীনদের মনে শংকা ভয় আর উগ্রতার প্রকোপ। একসময় আমাদের দেশ ও সমাজকে যারা পথ দেখাতেন তারা সবাই ছিলেন নবীন। তারুণ্যের স্বভাবধর্মই হচ্ছে টগবগে রক্তে আধুনিক থাকা। কিন্তু এখন আর তা নেই। মগজ ধোলাই বলি আর সমাজের ধারা বলি তারুণ্যই এখন বেশি বদলে গেছে। তাদের আচার আচরণ বিশ্বাসে ঢুকে গেছে বহু জঞ্জাল। অনেকে বলেন এর কারণ ডিজিটাল দুনিয়া। তারা নিমিষে দেশ বিদেশের উগ্রতা বা বদলে যাওয়া দেখতে পায় বলেই না কি লুফে নেয়। আমি দ্বিমত পোষণ করি। একই ডিজিটাল দুনিয়ার একদিকে তো খোলা দুনিয়া আর সভ্যতাও আছে। কই সে দিকটা তো পপুলার হলো না? বলা ভালো সেটা গোপনে এনজয় করলেও বাহ্যিক ভাবে তারুণ্য এখন পাপ পুণ্য আর জায়েজ না জায়েজ বিচারে সময় ব্যয় করতে ব্যস্ত। এই উকিল নোটিশের মাহমুদুল হাসান ও সে প্রক্রিয়ার শিকার।

সামাজিক মিডিয়া সহ নানা মিডিয়ায় এর বিচার বিশ্লেষণ শুরু হয়ে গেছে। যে যাই বলুক বা লিখুক আমি মনে করি উকিলের এই নোটিশ মূলত আমাদের পচে যাওয়া সমাজের বহি:প্রকাশ। যার কারণ রাজনীতি আর কথিত ধর্মীয় উন্মাদনা। ধর্ম বিষয়ে কিছু বলতে যাওয়া মানে বিপদ টেনে আনা। তারচেয়ে বলবো এই অন্ধ প্রক্রিয়া মদদ দিতে গিয়ে রাজনীতি আজ নি:স্ব। একের পর এক ভুল দাবী, অযৌক্তিক চাওয়া পাওয়া মেনে নিতে নিতে সরকার প্রশাসন সবাই যখন ক্লান্ত এবং নিরুপায় তখন এমন চাওয়ার জন্ম হবেই। কদিন আগেই মামুনুর রশীদ বনাম হিরো আলম অসম বিতর্ক দেখেছি আমরা। কী শিখলাম? মামুনুর রশীদের জন্য এখন পৈতে দরকার। তাঁকে চেনাতে হচ্ছে। আর হিরো আলমের মতো একজন হয়ে উঠেছে সমাজের তথাকথিত নয়নমনি। এমন সমাজে মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে কথা উঠবে এটাই তো স্বাভাবিক।

অথচ উকিল হাসানের হয়তো অজানা নয় যে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন ইউনেসকো স্বীকৃত। তারা কী বলছেন? ইউনেসকো তার ওয়েবসাইটে মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে বলেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষকশিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এই শোভাযাত্রা বের হয়। ১৯৮৯ সালে সামরিক স্বৈরশাসনের হতাশার দিনগুলোতে তরুণেরা এটা শুরু করেছিল। শিক্ষার্থীরা অমঙ্গলকে দূর করার জন্য বাঙালির নানা ধরনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক, প্রাণির প্রতিকৃতি ও মুখোশ নিয়ে শোভাযাত্রা করে। মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার আরও যে কয়েকটি কারণ ইউনেসকো উল্লেখ করেছে তা হচ্ছে, এই শোভাযাত্রা অশুভকে দূর করা, সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতীক। এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাঙালির ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতিগত সব ধরনের বৈশিষ্ট্য এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হয়।

সত্য এই, যতদিন আমাদের দেশ আমাদের সংস্কৃতি আমাদের জীবন ততোদিন বাংলা বাঙালির নববর্ষ থাকবে। এর বিনাশ নেই। তবু মাঝে মাঝে আমাদের সমাজে নতুন যতো উপদ্রব হাজির হয়। দীর্ঘ সময় ধরে নববর্ষের ভাতা নেয়া মানুষজনের এক বিরাট অংশ মজে আছে অসামপ্রদায়িকতা আর উদারতা বিরোধিতায়। এরা কি চায় তা আমরা বুঝি। কিন্তু রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা নেই বলেই তাদের উগ্র চেহারা দেখি দেখতে বাধ্য হয় জাতি। একটি আনন্দমুখর সর্বজনীন দিনকে বিতর্কিত না করলেই নয়? এমনিতেই আমাদের আনন্দ সীমিত হয়ে আসছে। বাঙালির অপ রাজনীতি গ্রাস করে নিয়েছে অনেক কিছু। এই নববর্ষ আমাদের আনন্দ দেশ বিদেশের বাংলাদেশীদের উৎসব। আন্তর্জাতিক অঙ্গণে স্বীকৃত এই উৎসব কে তার পথে চলতে দিতে হবে। এতেই সকলের আনন্দ আর দেশের শান্তি।

লেখক: প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধজাতিসংঘ মহাসচিবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা নজর বলছে ফাঁস হওয়া তথ্য