দূরের দুরবিনে

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের একুশে পদক : কে কার অলংকার?

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ

খবরে দেখলাম কিশোর দাশ বলেছেন তিনি এবং তার স্ত্রী সন্তান না নেয়ার সিদ্বান্ত নিয়েছেন। এমন সিদ্ধান্ত তারা নিতেই পারেন। কিন্তু কিশোর দাশ সবসময় ব্যতিক্রম। তাদের এই সিদ্ধান্ত সমাজ ও আন্তরিক ভাবে দেশ সেবার জন্য । ব্যাপারটা পরিষ্কার হচ্ছে না তো? কিশোর দাশ স্বচ্ছ মানুষ। তাই বলতে দ্বিধা করেন নি যে এই সিদ্বান্তের কারণ কেউ যেন কোনদিন তাদের আয় রোজগার বা সম্পদের বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে। বলতে না পারে সম্পদের পাহাড় গড়েছে পরিবারের জন্য। সিদ্ধান্ত সঠিক না ভুল সে তর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু বিদ্যানন্দের কর্ণধার কিশোর দাশ ও তার প্রতিষ্ঠান এই কারণেই আজ দেশখ্যাত । আজ তার স্বীকৃতিও পেয়েছে তারা।

প্রতি বছর আমাদের দেশে একুশে পদক দেয়া হয়। এটি আমাদের দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা। এ যাবৎ কত মানুষ কত প্রত্‌ষ্িঠান এই পদক পুরস্কার পেয়েছেন তার হিসেব রাখা কঠিন। এবার অর্থাৎ ২০২৩ সালের একুশে পদক ঘোষিত হবার পর আমার মত অনেক মানুষ আবারো একটু স্বস্তি আর সম্ভাবনার রেশ খুঁজে পেয়েছে। যার কারণ? কারণ বলার আগে বলে রাখি আমাদের দেশের কোনো পদক পুরস্কারই আমরা অবিকৃত রাখতে পারি নি। সমাজের সর্বস্তরে যে অশান্তি আর লোভ তার ফলাফল পদকে থাকে। পুরস্কারে থাকে। সে কারণে কোনো কোনো সময় এগুলো বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এমন কি সবার সেরা যে স্বাধীনতা পুরস্কার তা নিয়েও ঝামেলা দেখেছি আমরা। দু দু বার সে পুরস্কার ঘোষণার পর দেয়া হয় নি প্রত্যাহার করা হয়েছে। এমন বাস্তবতায় যদি আমরা মনের মানুষ ও প্রতিষ্ঠানকে এমন কিছু পেতে দেখি আনন্দে মন ভরে যায়।

কোনো কোনো মানুষের স্বীকৃতি নিজেকেও গৌরবান্বিত করে। দেরীতে হলেও নওয়াজেশ আলী খান, শিমুল ইউসুফ, মনিরুজ্জামান স্যারের একুশে পদক প্রাপ্তি তেমন ঘটনা। নওয়াজেশ আলী খানের নাটকে প্রথমবার নিষিদ্ধ জয় বাংলা এসেছিল বিটিভি তে। তাঁর প্রযোজিত ধারাবাহিক বহুব্রীহিতে তুই রাজাকার বলার স্বাধীনতা পেয়েছিলেন হুমায়ূন আহমদ।

শিমুল ইউসুফ তো একটা জীবনই কাটিয়ে দিলেন মঞ্চ কুসুম হয়ে। টিভির মতো জনপ্রিয় মাধ্যম ছেড়ে মঞ্চে এসে দেশ জাগিয়ে তুলেছেন তিনি।

সবচেয়ে খুশী হয়েছি বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন, কিশোর দাশের স্বীকৃতিতে। এক টাকায় খাবার ঈদে পূজায় নামমাত্র দামে নতুন পোশাক আরো কত কাজ করে এরা। এদের কাজ দেখলে চোখ জুড়ায়। নিজেকে ভীষণ ছোট ও অপদার্থ মনে হয়।

বিদ্যানন্দ নিয়ে আমার আনন্দ ভালোবাসা আর মন জুড়ানোর কারণগুলো সবাই জানেন। নীচের একটি কথাও আমার না। আমি সংগ্রহ করেছি মাত্র।

দেশে করোনাআতঙ্ক ছড়াতে শুরু করার পর একদিন হঠাৎ ফেইসবুকের হোমে দেখা গেলো, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকরা নিজেদের উদ্যোগেই ঢাকা ও চট্টগ্রামের যেসব স্থানে জনসমাগম বেশি, সেসব স্থানে জীবাণুনাশক ছিটানো এবং মাস্কঅ্যাপ্রোন ইত্যাদি তৈরি ও বিতরণের কাজ শুরু করেছে। পুরো দেশে কোয়ারেন্টিন এবং লকডাউনের ঘোষণা দেওয়ার আগেই এই সংগঠনটি কাজ শুরু করে। তারা মাস্ক ও অ্যাপ্রোন বানিয়ে বিতরণ করেছেন সুবিধাবঞ্চিতদের মধ্যে।

শুধু যে সুবিধাবঞ্চিতদের সাহায্য করার জন্য বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন কাজ করছে তা নয়, করোনা মোকবিলায় চিকিৎসা সেবাদানকারীদের জন্যও তারা এগিয়ে এসেছেন মাস্ক এবং গাউন নিয়ে। এক মাধ্যম থেকে জানা যায়, চিকিৎসকদের জন্যে গাউন তৈরি করার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদনও পেয়েছেন। একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ফাউন্ডেশনটিকে প্রায় ২৫শ গাউন স্পন্সর করছে বলেও জানা যায়।

ফেসবুক পোস্টে তারা জানান, ‘‘বাড়িতে লকডাউন অবস্থায় যদি কেউ খাবার সংকটে ভুগেন তবে এক টাকায় আহার পেজে যোগাযোগ করলে বিদ্যানন্দ টিম খাবার পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করবো। সীমিত আমাদের অর্থ, তাই অপব্যবহার না করার অনুরোধ থাকবে। শুধুমাত্র খুব দরকার হলে এবং প্রশাসন দ্বারা বাড়ি ‘লকডাউন’ হলে এবং তাঁদের অনুমতি পেলে আমরা খাবার প্রদান করতে পারবো’’।

শুধু খাবার পৌঁছে দেওয়াই নয়, এই দুঃসময়ে যখন বাজারের প্রতিটি দোকানে হ্যান্ডস্যানিটাইজার হয়ে গেছে সোনার হরিণ তখন এই সমস্যা সমাধানে ফাউন্ডেশনটি কাজ শুরু করে। নিজেদের উদ্যোগেই অ্যালকোহল যুক্ত স্যান্টিাইজার তৈরি করেন বিনামূল্যে বিতরণের জন্য। একটি ফেইসবুক পোস্টে জানান, সাধারণ দামের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি দামে তাদের কিনতে হয়েছে কাঁচামাল।

ডাক্তার এবং নার্সদের জন্য পিপিই তৈরির কাজটিও করে গেছেন তারা সব কিছুর পাশাপাশি। কিন্তু এতো কিছুর পরও এক পোস্টে ফাউন্ডেশনটি জানায় তাদের ফেইসবুক পেইজ রিপোর্ট করা হচ্ছে, আর যাতে করে বন্ধ হয়ে যেতে পারে সমাজসেবা প্রচারের প্ল্যাটফর্মটি। কিন্তু বলা যায় এই ঘটনাটি উল্টো ক্ষতির থেকে সবার নজরে নিয়ে আসে ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমকে।

তারা একটি পোস্টে জানায়, ‘‘ফিরে পেলাম আমাদের আত্মার ‘এক টাকায় আহার’ পেজটি। আমাদের নয়, কৃতিত্বটা আপনাদেরই। আপনাদের মাঝেই লুকিয়ে আছে ফেরেশতারা, যারা এই ক্ষতিকে নিজের ক্ষতি ধরে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে যার যার মতো। স্যালুট আপনাদের’’!

এমন একটি প্রতিষ্ঠান আছে আমাদের দেশে। যে ভাবে এর শুরু। কিশোর কুমার দাশ। জন্ম ঢাকার নারায়ণগঞ্জে। বাবার সরকারি চাকরিসূত্রে বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রামের কালুরঘাটে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে কিশোর তৃতীয়। নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম বলে অবহেলা, বঞ্চনা আর দারিদ্র্যের সংগ্রামে নিজেদের টিকিয়ে রাখাটাই তাদের কাছে দুঃসাধ্য ছিল। পরিবারে এক বেলার খাবারের জোগান হলে মাথায় রাখতে হতো অন্য বেলার কথা। পাশে ছিল না কোনো প্রতিবেশী কিংবা কাছের কোনো আত্মীয়স্বজন। কখনো কখনো অনেকে থেকেও যেন নেই।

পরিবারের এমন আর্থিক অনটন যখন তাদের পিছু ছাড়ছে না তখন একবার আত্মহত্যার পথও মাড়াতে চেয়েছিলেন কিশোর। সৌভাগ্যবশত সে যাত্রায় তিনি বেঁচে যান। এমন অপচেষ্টা একবার প্রাপ্ত বয়সেও করে বসেন। সেবারও ভাগ্যের জোরে বেঁচে যান। এরপর অসংখ্য বাধাকে তুচ্ছ করে নিজের স্বপ্নের দুয়ারে পৌঁছেন তিনি। কিশোর দাশ পরে দৃঢ়চিত্তে ঠিক করে নেন জীবনপথ। বলেন, আমি যেভাবে এক দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছি। ঠিক এমনই আমাদের দেশের অসংখ্য পরিবার দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করছে প্রতি মুহূর্তে। তাই এবার আমার দেশের অসহায় দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য কিছু করা দরকার। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন গড়ার বিষয়টি চিন্তা করি পেরুতে থাকার সময়ই। দীর্ঘ কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই বিদ্যানন্দের সূচনা হয়েছিল’।

বছরের শুরুতে বিদ্যানন্দের এতিমখানা ও স্কুলগুলোতে বাচ্চাদের অনেক খাতা, ব্যাগের প্রয়োজন হয়। তাই এবার এক স্বেচ্ছাসেবকের আইডিয়াতে সিটি নির্বাচনের ২০ টন ব্যানার ও পোস্টার দিয়ে প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ করে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নিয়ে বলেন, ‘বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের সব সৃজনশীল কার্যক্রম পুরো বাংলাদেশকে একটি বিশাল উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তারা যেসব কাজ করে সমাজের মানুষদের দেখিয়ে দিচ্ছে, তা থেকে আমাদের সবার শেখা উচিত।’

এই কাজ এখন সর্বজন স্বীকৃত। আমাদের দেশে কত সমস্যা। হিন্দু মুসলমান সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু জাতপাত ধর্ম বর্ণ আওয়ামী বিএনপি সব সমস্যার পর ও কিশোর দাশের মত তরুণেরা পথ দেখায়। আমাদের সমানে এসে দাঁড়ায় এক দেবদূত। যার ভালো কাজে এক টাকায় তৃপ্ত হয় আমার গরীব জনগণ। বিদ্যানন্দের একুশে পদক আমাদের অহংকার। দেশ ও সমাজের গৌরব। এরচেয়ে বড় কিছুও তাদের জন্য অপেক্ষা করছে এটা সত্য।

লেখক: সিডনি প্রবাসী প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও ছড়াশিল্পী

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধউপহারের ঘরের চাবি হাতে পেলেন রূপনার মা