আওয়ামী লীগ বা বিএনপি এ দুই বড় দলের দ্বন্দ্ব সংঘাতের বাইরে যে সমাজ তার দিকে নজর দেয়ার সময় নেই কারো। সমাজ জীবন এগুলো যেন সেকেন্ডারী বিষয়। মানুষকে ফেইসবুক ট্যুইটার বা অন্য মিডিয়ামে বুঁদ করে রেখে বিচ্ছিন্ন করে রেখে যারা বাণিজ্য করছে তারা ব্যতীত বাকীদের লাভের ঘরে শূন্য। এই ফাঁকে বাড়ছে সামাজিক দূরত্ব। বাড়ছে বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে তার কুফলে জীবনহানি। গত কিছু দিনের সংবাদপত্রে দেখলাম আত্মহননের একগাদা খবর। এই প্রবণতা মানুষের নতুন কিছু না। কিন্তু এর থেকে পরিত্রাণও জরুরি। সবাই জানেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত: আমাদের দেশে তা মানা হয় না। কিংবা বলা ভালো এ নিয়ে মাথাব্যথা চোখে পড়ে না। আর দশটা বিষয়ের মতো অবহেলা বা এড়িয়ে যেতে যেতে যখন দুর্ঘটনা ঘটে যায় তখন টনক নড়ে। কিন্তু তখন চোখের পানি আর দীর্ঘ বেদনা ছাড়া কিছুই থাকে না। যাদের কেউ যায় বা যারা হারায় তাদের সারাজীবন এই কষ্ট এই গ্লানি বয়ে বেড়াতে হয়। অথচ দেশে প্রতিদিন গড়ে ৩৫ জন মানুষ আত্মহত্যা করছে। আত্মহত্যার মধ্যে বিত্তবান, শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারী-পুরুষ রয়েছে। ফেইসবুক লাইভে ঘোষণা দিয়ে আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়ছে।
আত্মহননের কারণ অনেক। কেউ কোনো কারণে অকৃতকার্য হলে করে, কেউ প্রেমে ব্যর্থ হলে করে, কেউ অভিমানে করে, কেউ কেউ আদর্শের জন্যও করে বৈকি। যারা আদর্শের জন্য বা দেশ মাতৃকার জন্য এমন করে তাদের আমরা বীরের সম্মান দিয়ে থাকি। একসময় বঙ্গদেশের বহু বিপ্লবী পুরুষ ও নারী আত্মহননে প্রাণ দিয়েছিলেন । এখন সে ধারা নেই। এখন যারা প্রাণ দেয় তাদের সিংহভাগই মূলত: কোনো না কোনো কারণে ব্যর্থতার শিকার আর অবহেলা অপমানে জর্জরিত বলেই তা করে থাকে। তাহলে এটা বলার দরকার পড়ে না যে মনোযোগ আর তাদের প্রতি ভালোবাসা কতটা জরুরি।
আজকাল ডিজিটাল যুগ। এ যুগে দ্রুতগামী মানুষের হাতে সময় নেই। তারা বড়সড় কোনো বই পড়ে না। দীর্ঘ কোনো নাটক দেখে না। সিনেমা দেখে না। এমন কি প্রিয়জনদের সাথেও বেশি সময় কাটাতে চায় না। কারণ সবার তাড়া আছে। কিসের তাড়া কিসের এতো কাজ তাও কেউ ঠিকমতো জানে না। আমি দেশে গেলে দেখি টিভি চ্যানেলের রিমোটটি মূলত: তসবীর মতো। ওটা হাতে থাকা মানেই চিপতে থাকা। অজস্র চ্যানেলের ভীড়ে কোনটা দেখবে আর কোনটা দেখবে না এই যুদ্ধে ক্লান্ত মানুষ রিমোটের বোতাম চিপতে চিপতেই তার সময় শেষ করে ফেলে। এর ওপর আছে মোবাইল সামাজিক মিডিয়ার আক্রমণ। আক্রমণই বটে। মা বাবা ভাই বোনকে কা’র আপন সেটাও বোঝা দায়। কোনো রকমে দরকারী কথা সেরেই ফেইসবুক বা অন্য কোথাও ডুব। আপনি বাস টার্মিনাল রেল স্টেশন ফেরী ঘাট কোথাও এমন কোনো মানুষ পাবেন না যার ঘাড় নীচু নয়। এই ঘাড় নীচুর কারণ তার হাতের মোবাইল। সারা সময় ওখানেই চোখ ওখানেই তার মনোযোগ।
এই মনোযোগহীনতার কারণে মানুষ এখন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। মূলত: তার অন্তরের বেদনা আনন্দ কোনোটাই সে প্রকাশ করতে পারে না। আগেকার দিনে যে কোনো সমস্যার সমাধান হতো বাড়িতে। মা বাবা ভাই বোন সবাই মিলে খেতে বসলে বহু জরুরি বিষয়ে আলাপ হতো যার সমাধান হয়ে উঠতো সহজ। এখন নাকে মুখে দুটো গুঁজে উঠতে পারলেই বাঁচে। একবার একটা গল্প শুনেছিলাম যা সত্যও বটে। একজনের শিশু কন্যা তার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিল সে বড় হয়ে মোবাইল হতে চায়। তার এমন কথা শুনে বা চাওয়া জেনে সবাই হা হা করে হাসলেও একজন মানুষের মনে কৌতুহল জেগেছিল। তিনি বারবার বাচ্চাটির কাছে জানতে চেয়েছিলেন কেন সে মোবাইল হতে চায় ? কেন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার এসব নয়? বাচ্চাটি তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে মা বাবাকে লজ্জায় ফেলে বলেছিল : ওর মা বাবা দু’জনই মোবাইল কোলে করে ঘুমায়। ওর চাইতে বেশি সময় ব্যয় করে মোবাইলে। কখনও কিছু বললে শোনে না বা ধমক দেয় তাই ও মোবাইল হলেই মা বাবার আদর বেশি পাবে।
সমাজের এই চিত্র বলে দেয় আমরা এখন কতটা বিচ্ছিন্ন। বিচ্ছিন্নতা আত্মহননের একটি মূল কারণ। পরীক্ষা নামের এক ভয়াবহ দানবও কম দায়ী কিছু নয়। এই পরীক্ষা আর তার ফলাফল আমাদের সমাজের কত তরুণ তরুণীর প্রাণ কেড়ে নেয় তার হিসেব দেয়া কঠিন। জীবন অনেক বড়। আর সে দৌড়ে কে কখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কেউ জানে না। তারপরও সাময়িক ফলাফল এমন বিষময় করে তোলে সবকিছু। বলাবাহুল্য পরিবার ও সমাজের চাপে মানুষ মন্দ পথে যেতে বাধ্য হয়। তখন তার মনে হয় জগৎ সংসারে কেউ তার নয়। কেউ তাকে ভালোবাসে না। এ কারণেই চালু হয়েছে হেল্প লাইনগুলো। ওদের কাজ হচ্ছে ঐ বিশেষ পরিবেশ থেকে মানুষটাকে বাঁচানো। তার মনে অন্তরে যে নীল ঢেউ তা দূর করে তাকে আলোতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। আমাদের দেশে এমন হেল্প লাইন নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু তার ব্যবহার নেই। কারণ এজন্য যে প্রচার বা আন্তরিকতা তা নেই বললেই চলে। অথচ এটা চালু করতে পারলে এর ধারা বজায় থাকলে বহু মানুষের প্রাণ বাঁচবে।
হতাশাসহ নানাবিধ কারণে মানুষের মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য, সম্মানহানি, সংসারের টানাপোড়েন, বেকারত্ব, মাদকাসক্তি, পারিবারিক কলহ, প্রেম, বিয়ে বিচ্ছেদ, একাকিত্ব। তবে এসব কারণ ছাড়াও বন্ধু, আত্মীয়, পরিবারের সদস্যদের অবিবেচকের মত ব্যবহার, পরিবারের প্রত্যাশা মেটাতে না পারার হতাশা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের অর্জনের খবরের সাথে নিজেদের অর্জনের তুলনা করার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষণ্নতা ও হতাশার হার বাড়ছে যেই বিষণ্নতা ও হতাশা এক সময় তাদের আত্মহত্যাপ্রবণ করে তুলে।
ধমক তুচ্ছ-তাচ্ছিল্ল অবহেলা করে কথা বলার অভ্যাস ছাড়তে পারেননি। দুই একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল দুই একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাউন্সিলিং-এর ব্যবস্থা নেয়। অথচ প্রতিটি স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাউন্সিলিং-এর ব্যবস্থা রাখা খুবই গুরুত্বর্পূণ।
দীর্ঘ প্রবাস জীবনে আমি যা কিছু শিখেছি তার ভেতর একটি, মানুষের প্রশংসা করা বা করতে পারা করতে জানা। আমাদের দেশে যার যতো বড় পদ সে ততো গম্ভীর। আমাদের চট্টগ্রামের নামকরা বুদ্ধিজীবীরা কবে শেষ হেসেছেন তাঁরাই জানেন। যে কোনো কারণে হোক আমাদের সমাজে প্রশংসা বিষয়টা খুব কম। সবাই দোষটা যে ভাবে ধরে বা বলতে ভালোবাসে ততটাই নিস্পৃহ থাকে প্রশংসা করার বেলায়। এক্সেলেন্ট, ওয়ান্ডারফুল, চার্মিং এমন শব্দগুলো ব্যবহার করা হয় না আমাদের সমাজে। বাংলায়ও না। অথচ আপনি ব্যবহার করে দেখুন এসব ম্যাজিকের মতো কাজ করে। মানুষের মনোবল বাড়িয়ে তোলে। তাকে বুঝতে দেয় তার গুরুত্ব আছে। আমাদের সমাজে যারা আত্মহত্যার শিকার হন তাদের বেশির ভাগই জীবনে এমন কিছু শোনেন নি।
সমাজ ও দেশ এগিয়ে যাবার সময় বিচ্ছিন্নতা বা সামাজিক দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। তা ই ব্যালেন্স দরকার। দরকার সমাজ পরিবার ও মানুষের মেলবন্ধন। আমাদের মায়ার সমাজ আজ বিচ্ছিন্নতার রোগী। তার প্রয়োজন ভালোবাসা। এতেই নিরাময় এতেই প্রশমিত হতে পারে আত্মহননের মতো ভয়াবহ প্রবণতা।
লেখক: সিডনি প্রবাসী কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, ছড়াশিল্পী