লকডাউন : বন্দী থাকা নয়,
এটাই বাঁচার পথ
করোনার মারাত্মক ছোবল এখন ঘাড়ের ওপর। শুধু বাংলাদেশ না দূর সিডনিতেও আমরা গৃহবন্দী। লকডাউনের কঠোর বিধিনিষেধের আওতায় থাকতে হবে দু সপ্তাহ। পার্থক্য একটাই সিডনিতে নিয়ম মানবে নব্বই শতাংশ কিংবা তার চেয়ে বেশী মানুষ। আর আমাদের দেশে না মানার তালিকায় থাকবে এই আশি নব্বই শতাংশ মানুষ। কেন এই প্রবণতা? কেন এই না মানার আকুলতা? এটাতো এখন সবাই দেখছে করোনা কি পরিমাণ ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশের কোন কোন জেলায় প্রায় মরণ ছোবল হেনেছে তা ঢাকায় আঘাত হানা সময়ের ব্যাপার। জনসংখ্যার দিক থেকে ভয়ংকর এক পরিস্থিতিতে আছি আমরা। এই জনসংখ্যার ভেতর করোনার সময় মেলামেশা কিংবা সামাজিক দূরত্ব সহ বিধিনিষেধ ঠিক রাখা নিয়ন্ত্রণ করা দুঃসাধ্য।
সীমিত জনসংখ্যার সমুদ্রবেষ্টিত এই দেশটি ভেবেছিল তার সীমান্ত বন্ধ করলেই করোনার হাত থেকে মুক্তি পাবে। করোনা মুক্ত দেশ হতে পারার পথে যারা এগিয়েছিল তারা কঠোরতা মানা দেশ। কিন্তু তাতে কি? এক পা এগুলে দু পা পিছানোর মতো হাল। শনিবার ২৬ জুন সন্ধ্যে সাতটা থেকে দু সপ্তাহের কঠোর লকডাউনে গেছে এই শহর। সর্বশেষ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট নামে পরিচিত এই ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে। নর্দান টেরিটরি নামের রাজ্য এদেশের একেবারে অন্যপ্রান্তে। সেখানে আদিবাসী তথা এব্যরজিনালদের ভীড়। তারা থাকেন প্রত্যন্ত এলাকায়। তাদের সংস্কৃতি ও প্রকৃতি একে অপরের সাথে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে। তারা বিশ্বাস করেন তাদের ভাষা তাদের ডাক তাদের আহ্বান বোঝে প্রকৃতি। তাদের ডাকে মাছ উঠে আসে। তাদের শখ বালিতে গড়াগড়ি যাওয়া। তাদের সাথে প্রকৃতির নিবিড়তা যতোটা গভীর হোক না কেন স্বাস্থ্যগত ভাবে তারা দুর্বল। দেখতে দশাস ই হলেও তাদের ইমিউন তেমন শক্ত কিছু না। তার ওপর আছে নেশার আধিক্য। এতোদিন বেঁচে থাকলেও এবার এই ভাইরাস ধরা পড়েছে সেখানকার প্রত্যন্ত এলাকার কয়লা খনিতে। করোনার এই টার্গেট সবাইকে হতভম্ব করে দিয়েছে। বলাবাহুল্য সাথে সাথেই ঐ রাজ্য চলে গেছে দু দিনের কঠোর লকডাউনে।
যখন প্রায় ঘুরে দাঁড়িয়েছিল তখন এ দেশে করোনার থাবা আবারো বুঝিয়ে দিয়েছে ত্রাণ পাওয়ার সময় আসে নি। কিংবা ত্রাণ লাভ এতো সহজ হবে না। যে দু সপ্তাহ সিডনি তথা নিউ সাউথ ওয়েলস লকডাউনে থাকবে সে সময়কালে যারা কাজ করতে পারবেন না যাদের আয় রোজগার বন্ধ থাকবে তারা সরকারি সাহায্যের আবেদন করতে পারবেন। ইতোমধ্যে ছোট ব্যবসা আর তেমন সব ব্যবসার জন্য সাহায্য ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে লকডাউন মানুষের মগজ মেধা চিন্তার ওপর যতোটা প্রভাব ফেলবে ততোটা পকেটে না।
এবার আসি দেশের কথায়। আমাদের জনবহুল দেশ। গিজগিজ করা মানুষের সমাজে লকডাউন সহজ কিছু না। তবু এখন এর বিকল্প নাই। দেশের সাথে তুলনা করা অন্যায়। তবু এটা মানতে হবে জানতেও হবে আমাদের দেশে সিস্টেম বা পর্যাপ্ত উপকরণ নাই। আই সি ইউ ভেন্টিলেশন এখনই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে হারে রোগীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তাতে এর শেষ কোথায় বলা মুশকিল। মৃত্যুর হারও অনেক বেশি দেশে। কিন্তু কে শুনছে কার কথা? গোড়ায় অবহেলা মাঝখানে ভয়ে নিয়ম মানার পর মানুষ এখন আবার বেপরোয়া। আমাদের মতো দেশে মানুষের বেপরোয়া হবার অনেক কারণ। কিছু মানুষ সত্যি অসহায়। তাদের কাজে যাবার বা কাজ করার কোন বিকল্প নাই। এবারের করোনা আক্রমনে সবচাইতে খারাপ জায়গায় দাঁড়িয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত। তাদের পাশে না সরকার না সাহায্য সংস্থা না কোন বিত্তশালী। তাঁরা কি ভাবে বাঁচবেন বা লকডাউনে কি করবেন তার কোন দিকনির্দেশনা নাই। যে সব গরীব মানুষ দিন আনে দিন খায় তারা মনে করে না খেয়ে মরার চাইতে করোনায় মরা ভালো। এই বাস্তবতায় সরকারও দোদুল্যমান । এর আগেও আমরা সরকারি তরফে এমন সব কাজ দেখেছি যা কোন না কোন ভাবে করোনাকে উস্কে দিয়েছে। অথচ সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞদের মতামত ছিলো:
“বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার মুখে কোভিড সংক্রান্ত সর্বোচ্চ জাতীয় কমিটি সারা দেশে অন্তত ১৪ দিন সম্পূর্ণ ‘শাট-ডাউন’ বা সবকিছু বন্ধ রাখার সুপারিশ করছে। জরুরি সেবা ছাড়া যানবাহন, অফিস-আদালতসহ সবকিছু বন্ধ রাখা প্রয়োজন বলে কমিটি মনে করছে। বুধবার রাতে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির এক বৈঠক থেকে এই সুপারিশ করা হয়। কমিটির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কোভিডের ডেল্টা জীবাণুর সংক্রমণ ক্ষমতা তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি।
এতে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে সারা দেশেই উচ্চ সংক্রমণ এবং ৫০টিরও বেশি জেলায় এর ‘অতি উচ্চ সংক্রমণ’ লক্ষ্য করা গেছে। ফলে এই মহামারি প্রতিরোধের জন্য খণ্ড খণ্ড ভাবে এতদিন যেসব কর্মসূচি নেয়া হয়েছে তার উপযোগিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক মন্তব্য করেছে।”
অথচ আমি যখন এই লেখা লিখছি তখন আদালত প্রাঙ্গণ গরম করে চলছে মেজর সিনহা হত্যার বিচার। প্রদীপ ওসি সহ আসামীদের দেখার জন্য ভীড় মানুষের। এর আগে দেখলাম ফরিদপুরে সরকারি নেতার বিশাল জনসভা। সে জনসভায় হাজার হাজার মানুষের ভীড়। এ দুই ঘটনাই আইন ভঙ্গের সামিল। কিন্তু কে ধার ধারছে কে রাখছে কার খবর?
এই লেখা যখন আলোর মুখ দেখবে তখন থেকে শুরু হয়ে যাবে কঠোর লকডাউন। কিন্তু এই কঠোরতা এখন পর্যন্ত কথার কথা। সরকারের কোন মহল কি সিদ্ধান্ত কখন নেয় বোঝা মুশকিল। হঠাৎ করে দিন তারিখ পাল্টে গেলো লকডাউনের। সোমবার হয়ে গেলো বৃহস্পতিবার। অকস্মাৎ চেতে গেলেন পোশাক শিল্পের মালিকেরা। প্রতিবার তারা এ কাণ্ড ঘটনা। কথাবার্তা ছাড়া তারা খোলা বন্ধের নোটিশ দিয়ে জাতিকে যেমন বিপদে ফেলেন তেমনি হতচকিত হয়ে পড়ে মানুষজন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয় নি।
এমন বাস্তবতায় কিভাবে লকডাউন সার্থক হবে? সত্যিকার অর্থে এবার ভুল করলে সময় তো সময় জীবনও মাফ করবে না। বাংলাদেশে এমনিতেই গুজব আর মিথ্যাচারের জয়জয়াকার। একদল মানুষ সুকৌশেলে প্রচার করছে করোনা নাকি ভুয়া। এই রোগ আমাদের দেশে হয় না। এটা নাকি বিদেশীদের রোগ। এই অসত্য প্রচারণা বিপাকে ফেলেছে জাতিকে। অনেকে টিকা নিতে অপারগ। অথচ টিকা হীনতায় বিপদ ছাড়া কোন লাভ নাই। এবার আমাদের সামনে দুটো বিষয়: জাতি কি পারবে এবার ত্রাণ লাভ করতে? নাকি ডুবে যাবে ভারত আমেরিকা ব্রাজিলের মতো সমস্যার গভীরে?
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট