অতুলপ্রসাদ সেন : কবি ও গীতিকার
কথায় বলে স্বীয় জিহ্বাকে শাসনে রাখিবে। ছেলেবেলায় এই প্রবাদ বাক্য পড়ে বড় হ ওয়া বাঙালি এখন তা ভুলে গেছে। যার পদ পদবী যতো বড় তার জিভ ততো সংযত হলেই মঙ্গল। কিন্তু আমাদের সমাজে এখন আর কেউ তা মানে না। এই মানা না মানা ব্যক্তিগত বিষয় হলেও এর প্রভাব কিন্তু ব্যক্তিপর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে না।
পররাষ্ট্র বলে যে মন্ত্রণালয় পাশের দেশে তার নাম বিদেশ মন্ত্রক। এই নামটা আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়। পররাষ্ট্র ব্যাপক অর্থে প্রচলিত হলেও ইংরেজি ঋড়ৎবরমহ অভভধরৎং এর সাথে এটি যায় না। এই পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় আর মন্ত্রী সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখা দরকার আমরা সবে ডানা মেলতে শুরু করেছি। আমাদের ভিত্তি যখন ধীরে ধীরে মজবুতের পথে তখন এমন পদে আসীন মানুষটি হবার কথা চৌকস বিজ্ঞ আর প্রমিতভাষী। ভাষা যে কি সংঘাতিক একটা বিষয় আর মুখের কথা যে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ বা আত্মঘাতী হতে পারে তা বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজকাল প্রায়ই সংবাদ শিরোনামে পরিণত হচ্ছেন। এই প্রসঙ্গে যাবার আগে আমি একাত্তরের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। সে সময়কাল এখন অনেকের চোখে কেবলই অতীত। আর সরকারি দলের একতরফা ইতিহাসের ঠেলায় এর গুরুত্ব প্রায় শূন্যের কোঠায়। কিন্তু ঐ বীজতলাই আমাদের ভিত্তি। সে সময়কার নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল নাজুক। আমেরিকানরা আমাদের তলানী হীন ঝুড়ি বলে উপহাস করতো। ইউরোপে বিশেষত পশ্চিম ইউরোপে ফ্রান্স ব্যতীত মিত্র নেই বললেই চলে। সে সময় আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি বেফাঁস কথা বললেই তা বারুদ হয়ে উঠতে পারতো। কিন্তু তাঁরা পূর্ব অভিজ্ঞতার অভাব থাকার পরও কী দারুণ ভাবে সবকিছু ম্যানেজ করেছিলেন। এমন একটা গল্প আছে ফারুক চৌধুরীর লেখায়।
প্রয়াত কূটনীতিবিদ ফারুক চৌধুরী ছিলেন আপদমস্তক একজন ভদ্রলোক। উচ্চ মেধা আর প্রজ্ঞবান মানুষটির দু একটি লেখা পড়লেই বুঝবেন কেমন ঝানু ছিলেন তিনি। তিনি লিখেছেন একবার ইসলামিক দেশগুলোর এক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে চেপে ধরেছিলেন তানজানিয়ার রাষ্ট্রপতি। তাঁর অভিযোগ বঙ্গবন্ধু মুসলিম দেশ পাকিস্তান ভেঙে ঠিক করেন নি। এক থাকলেই ভালো হতো। ফারুক চৌধুরী লিখেছেন সবাই অধীর আগ্রহে দেখছিলেন বঙ্গবন্ধু এর জবাবে কী বলেন? তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে তানজানিয়ার প্রেসিডেন্টের কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, বন্ধু তা হলে তো আরব দেশগুলো একটা দেশ হলেই ভালো হতো। ভালো হতো উপমহাদেশ একটি রাষ্ট্র থাকলে? তা কি হয়েছে? তা যদি না হয় তো বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে কী দোষ করলো? এরপর তিনি এর বিশদ ব্যাখ্যা দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন।
একেই বলে শিষ্টাচার ও ভদ্রতা। আমাদের সমাজ না কি অনেক এগিয়েছে। দেশ এগিয়ে চলেছে। তাহলে মন্ত্রী কেন কথা বলবেন মান্ধাতার আমলের মন্ত্রীর মতো? যা কি না সরকারকে বিব্রত করে? এই যে তিনি এখন সামাজিক মিডিয়ায় ভাইরাল এর কারণ কী? আপনি গেছেন জন্মাষ্টমীর সভায় ভাষণ দিতে। সেখানে আপনি বলবেন ভগবান শ্রী কৃষ্ণের কথা। সেদিকে না গেলে আপনার কথা হওয়া উচিৎ ছিল সমপ্রীতি আর সহাবস্থান নিয়ে। এমন না যে তিনি তা বলেন নি। কিন্তু ঐ যে মুখরতা সে কারণে ছিটকে পড়লেন আপন বলয় থেকে। অহেতুক ভারত প্রসঙ্গ এনে যা যা বলছেন তা শেখ হাসিনার সরকারের জন্য কোনো ভাবেই ভালো হতে পারে না। একটা কথা বলতে চাই, আপনি যদি মহররমের কোনো আলোচনা সভায় যান সেখানে কি আপনি শিয়া প্রধান ইরানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করবেন? বা খৃষ্টানদের সভায় গিয়ে বলবেন পোপ বা রোমের ভ্যাটিকান নগরীর সাথে সম্পর্কের কথা? বৌদ্ধদের বুদ্ধ জয়ন্তীতে গিয়ে কি মিয়ানমার বা রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে হবে? তাহলে কী কারণে সেদিন চট্টগ্রামে ভারতের সাধে সম্পর্কের কথা এলো? কেনই বা বলতে হলো ভারতকে তিনি অনুরোধ করেছেন এই সরকারকে টিকিয়ে রাখার। রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব বা সরকারকে অসহায় করে তোলার এমন নজীর বিরল। এর ফলে এখন বিএনপি বা বিরোধী শক্তি যৌক্তিক ভাবেই প্রশ্ন তোলার অধিকার পেয়ে গেছে। কারণ তাদের এতদিনের অভিযোগও ভারত নির্ভরতার যে বিষয় সেটাই ভিত্তি লাভ করলো।
আমার মনে হয়েছে এতে হিন্দু সমপ্রদায়ের মানুষজনকে অপমান করা হয়েছে। চট্টগ্রাম আমার জন্মভূমি। আমি এই সভা আয়োজক বা উপস্থিতির সবকিছু সহজেই অনুমান করতে পারি। এমন একটা সভাতে দাঁড়িয়েই এরশাদ পত্নী রওশন এরশাদ প্রথম জন্মাষ্টমীর ছুটি ঘোষণা করেছিলেন। পরে যা এরশাদ বহাল করেন। কিন্তু তা যে লোক দেখানো তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ রাষ্ট্রধর্ম। যে কাজটি চাইলেও এখন আর এড়িয়ে যাওয়া বা রদ করা অসম্ভব। যাই হোক এই জন্মাষ্টমীর সভায় মানুষ যায় ধর্মের কথা শুনতে, ভগবান কে আরাধনা করতে। রাজনীতি যেহেতু বিষয় অন্তত: সংখ্যালঘু নামে পরিচিত হিন্দুদের জান মালের বিষয়ে তারা মন্ত্রীর কাছে আশ্বাস শুনতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ বিগত দুর্গাপূজায় মূলত: আমাদের শান্তি নামের কাচের ঘর ভেঙে গেছে। বেশির ভাগ মানুষ এখনো শান্তি আর সহনশীলতায় বিশ্বাসী বলে তেমন করে দাঙ্গা হয় নি। কিন্তু পরিষ্কার উস্কানী ছিল তাও আবার সরকারি দলের নেতাদের কাজ ও প্রশাসনের একটা পর্যায়ে। এসব কারণে তিনি তাদের জানমাল আর ভালো থাকার কথা বললেই মানুষ খুশী হতো। সেটা না করে তিনি ওভারল্যাপ করে কেন ভারতের কথা বললেন? এর মানে কি এই যে তিনি তাদের সবাইকে সেদেশের ভক্ত অনুরাগী বা এক পা সেখানে আছে এমন কিছু মনে করেন? জন্মাষ্টমীর সভায় উপস্থিত নিরীহ ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা কি আসলেই জানতে চায় সরকার টিকিয়ে রাখার দায় ভারতের কি না? তাঁর বক্তব্যে আরো একটা বিষয় খেয়াল করার মতো। সেদেশে বিজেপি শাসনে আসার পর থেকে দাঙ্গা হাঙ্গামা বা উস্কানী লেগেই আছে। যা আমাদের অপছন্দ। বিশ্বব্যাপী এ নিয়ে বাদানুবাদ আর প্রতিবাদ ও আছে। কিন্তু তিনি মনে করিয়ে দিলেন সেখানে অন্যায় হলেও নাকি শান্তির স্বার্থে তাঁরা চুপ থাকেন। সত্যি বলতে কি এমন প্রলাপ দেশ বা জাতির ভাবমুর্তি তো বটেই সরকারের জন্যও প্রবল আত্মঘাতী।
জানি না কেন কী কারণে হঠাৎ তিনি এমন করে কথা বলছেন। ক’দিন আগেই মানুষ বেহশতে আছে বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন। আর টক শোতে বক্তারা জানতে চাইলো বেহশতে এখন আণ্ডার দাম কত? আমার মনে হয় জ্হ্িবা শাসনে রাখার প্রবাদটি এখন কাচে বাঁধিয়ে দেয়ালে রাখার সময় এসে গেছে। এই ভাষণের আপাত: ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া যাই হোক এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবে সরকার আর আওয়ামী লীগই হবে টার্গেট। মাননীয় মন্ত্রী কি সেটা বুঝতে পেরে সাবধান হবেন না এমন ঢালাও প্রলাপ চলতেই থাকবে ?
লেখক: সিডনি প্রবাসী কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট









