গত ক দিনের ঘটনায় বাংলাদেশ অসহায় হয়ে তাকিয়ে আছে মুখের দিকে। পূজা এতোদিন মহা সমারোহে হলেও এবার হয় নি। যে বা যারাই করুক এটাকে কোন ভাবে বিচ্ছিন্ন বলা যাবে না। এখনো থেমে থেমে আক্রোশ ও আক্রমণ চলছে। বেশীর ভাগ মানুষ চায় নি বলেই ঘটনা পুরো দেশে ছড়ায় নি। এসব সাধারণ মানুষদের স্যালুট। কিন্তু যে দাগ রেখে গেলো তার জন্য সমাজ ও নৈতিকতার দিকটা ভাবার দরকার আবার।
পাঠ্যক্রম বদলানো থেকে আপোসের সবটাই আজ বুমেরাং। সরকার ও প্রশাসন থামাতে চায় নি বা পারে নি। এটাই সত্য। নৈতিকতা একসময় ভূষণ ছিলো সমাজের। সে সময় আমাদের জীবন ছিলো প্লেইন লিভিং আর হাই থিংকিং এর আদর্শে এক সরল জীবন। আমরা এখন ব্যাকডেটেড মানুষ। পুরনো যুগের অচল মাল। সেটা যেমন জীবনযাপন, পোশাক খাদ্য কিংবা কথায় টের পাই তেমনি মনে করিয়ে দেয় নানা ঘটনার আকস্মিক ধাক্কা। এ এক আজব যুগ। এখন কোনটা নৈতিক কোনটা অনৈতিক বোঝা দায়। শিশু কিশোর তরুণ তরুণীকে দোষারোপ করি আমরা। ভাবি তার যুগের প্রবাহে নানা ধরনের আজগুবি কাণ্ড ঘটায়। তাদের ভাষা পোশাক আমাদের চোখ পীড়ার কারণ হয়। কিন্তু আসলে কি তা সত্যি? আমরা যখন যৌবনের শুরুতে বেলবটম প্যান্ট পরতাম তখনো আমাদের অভিভাবকেরা বিস্ময়ের চোখে তাকাতেন। ভাবতেন এ আবার কী রে বাবা! হঠাৎ নীচের দিকে এসে ঢোলাঢালা এ এক আজব পাতলুন। এটাও ঠিক হিল দেয়া জুতা না পরলে সে পাতলুনের নীচের দিকটা ময়লা আবর্জনা কুড়িয়ে নিতো মহানন্দে। এমন সব ঘটনা যে কোন সমাজে ঘটে। পরিবর্তন মানুষকে মানতে হয়। আর পরিবর্তনের ভেতর দিয়েই মানুষ পৌঁছে যায় আধুনিকতায় নতুন কোন গন্তব্যে। সমপ্রতি আমাদের দেশে যতগুলো অঘটন আর মুখরোচক কাহিনী তার পেছনে ক জন তরুণ তরুণী আছে আসলে?
সবগুলো ঘটনার নেপথ্যে মধ্যবয়সী পুরুষ কিংবা নারী। এসব ঘটনার সাথে জড়িত পুরুষ মানেই এখন যৌনতার ইন্ধন কিংবা আকামের নায়ক। কেউ কাউকে ভোগ করে কেউ কাউকে প্ররোচনা দিয়ে কেউ অর্থ আত্মসাৎ করে বা লুটপাট করে সংবাদ শিরোনাম। আর নারীরা কি পিছিয়ে? নৈতিকতার কথাই যদি বলেন দেখবেন তার দেয়াল এরাও ভেঙ্গে ফেলেছে অনেক আগে। কেউ লুটপাট কেউ মধুচক্রের হোতারা কেউ কেউ রাজনীতির নামে সমাজে মাফিয়া হয়ে দাঁড়িয়ে গেছিল। এদের একেকজন যখন ধরা পড়ে আমরা অবাক হ ই। ভাবি ওহ এমনও ঘটে? কিন্তু এমন সরল ভাবনার কি আসলে কোন মানে হয়?
প্রত্যেকটি ঘটনা মিডিয়ায় বের হয়ে আসার পর দেখা যায় এসব নারী পুরুষের বাড়ীতে পাওয়া মালামাল এক ধরনের। বিয়ারের বোতল। মদের খালি বা আধাভর্তি কয়েকটা বোতল। হরিণের চামড়া বা এমন জাতীয় কিছু। হয়তো পাওয়া যায়। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় এসব কোথায় ছিলো এতোদিন? কেন ই বা কর্তারা এসব জানতেন না? আর জানলেও কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল? আইন তার নিজস্ব গতিতে চলুক। হোক বিচার। আসল কথা আমরা চাই সব ধরনের দুর্নীতি ও অপরাধমুক্ত দেশ ও সমাজ। ভাবনাটা এদের নিয়ে যতোটা তারচেয়ে অধিক আরো এক ঘটনায়। আমি একটু পেছন ফিরে তাকাতে চাই।
প্রাইমারি ও হাইস্কুলের পর কলেজ জীবন এটুকু আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। আজ মনে হব এই শ্রেষ্ঠতার কারণ বুঝি। প্রাইমারী স্কুলে আমাদের টিচারেরা ছিলেন অভিভাবকের চাইতেও বড় কেউ। তাঁরা আমাদের কাছে দেবতুল্য। বুঝতে না পারলেও এটা জানতাম এঁরাই মানুষের বীজতলা তৈরী করেন। ভয় পেতাম তাঁদের ভয় পেতাম তাঁরা মার লাগাবেন বলে। কিন্তু মাঝে মাঝে তাঁদের স্নেহ আর ভালোবাসা বয়ে যেতো নদীর ধারার মতো। এরপর হাই স্কুলের জীবন। সে মাষ্টার মশাই স্যারেরা ছিলেন আমাদের অভিভাবক। আমাদের ইংরেজি স্যার ছিলেন কড়া একজন মানুষ। তাঁর অনেকগুলো শুচিবাইয়ের ভেতর একটি ছিলো জামার হাত গুটানো যাবে না। লম্বাহাতের যে কোন জামার আস্তিন কোন ভাবে গুটানো থাকলে হয় প্রহার নয়তো বকা খাওয়াই ছিলো নিয়তি। তিনি আমাদের অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ করতেন। যে কোন অভিযোগ বা পড়াশোনার ঘাটতি সব খুলে বলতেন। মাঝে মাঝে তাঁর ভাষা পথ হারাতো বটে কিন্তু সেগুলো এখন হাসির খোরাক মাত্র। বড় জোর এই কুলাঙ্গার ছেলেকে নিয়ে কি করবেন আপনারা? বা এই ছাগল তো মানুষ হবে না। এমন কঠিন কঠোর মানুষটি আমাদের স্কুল শেষ হবার দিন ক্লাশে এসেছিলেন একটা লম্বা ছিপছিপে বেত নিয়ে। আমরা সবাই অবাক। শেষদিনও তিনি আমাদের কাউকে কাউকে মারবেন? সে দিনটি আমি কখনো ভুলবো না। ক্লাশ শেষ হয়েছিল কান্না আর ভালোবাসা দিয়ে। সে বেতটি তিনি টুকরো করে ভেঙ্গে কেঁদে দিয়ে বলেছিলেন, এটা দিয়ে তোদের অনেক মেরেছি। শুধু একটা কারণে, তোরা মানুষের মতো মানুষ হবি বলে। তার কান্না আমাদের এই কথা বলেছিল, কঠিন হলেও এঁরাই তোমাদের আলোর দিশারী।
দিনকাল পাল্টেছে। এখন এমন সব কথাবার্তা ফাঁস হয় যা শুনে আমরা লজ্জায় মুখ লুকাই। দেশের নামকরা স্কুল কলেজের স্বনামধন্যদের মানুষ এখনো অভিভাবক মানে। জানে এঁদের কাছে তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ গচ্ছিত। ছেলেমেয়েরা এঁদের কাছেই শিখবে নৈতিকতা। কিন্তু সমপ্রতি কি দেখছি কি শুনছি আমরা? আমি কারো ব্যক্তিগত নিন্দা বা বিদ্বেষ ছড়ানোকে লেখার উপজীব্য মনে করি না। আমার একটাই প্রশ্ন যতোবড় আঘাত আর রাগ এসে ভিড় করুক কেন আমাদের ভাষা তার সীমা ছাড়াবে? বিষয়গুলো যদিও দু দিক থেকে ভাবা দরকার। একদিকে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ফাঁস আর বেঈমানী। অন্যদিকে কঠিন এক নিদারুণ বাস্তবতা। এভাষায় তো যাদের আমরা ছোটলোক বলে তুচ্ছ করি তারাও কথা বলে না । বরং আজ দেখা যাচ্ছে তারাই ভদ্রলোক। আর আমাদের শেষ আশ্রয় অভিভাবকের চাইতে বড় মাষ্টারদের আচরণ কথা অসংযত।
জ্িহবা এমন একটা অঙ্গ যা বত্রিশ পাটি কঠিন শক্ত দাঁতের ভেতর নিরাপদে থাকতে পারে। যে দাঁতগুলো মাংস চিবিয়ে হাড্ডি টুকরো করে তাদের ফাঁকে এর নিরাপদ থাকার কারণ তার নমনীয় শীতল অবস্থান। সে জিহ্বা নিয়ে চমৎকার লিখেছেন সাহিত্যিক সন্জীব চট্টোপাধ্যায়। আর আমরা সবাই জানি এই একফালি জিনিসটা সময় মতো তলোয়ারের চাইতেও বেশী শক্তিশালী। এ যেমন মায়া ভালোবাসা প্রেম বাড়াতে পারে কাউকে দুশমন থেকে বন্ধু করে তুলতে পারে তেমনি পারে বন্ধুকে দুশমন করে ছাড়তে। তারজন্য খুব বেশী সময়ের দরকার হয় না। আমাদের সমাজে দেশে রাষ্ট্রে বহু খ্যাতিমান মানুষের সবর্নাশ হয়েছে শুধু জিভের কারণে। তবু আমরা একে বাগে রাখতে ভুলে যাই।
অহংকার রাজনৈতিক দম্ভ আর জিভের অসংযতায় আজ যখন সবাই কমবেশী আক্রান্ত তখন বাল্যপাঠের সেই বাণী মনে পড়ে। যেখানে বলা হয়েছিল: স্বীয় জিহ্বাকে শাসনে রাখিবে। এ কথা না মানলে যে কি হয় তাও আমাদের অজানা না। নৈতিকতার এই স্খলন বিপজ্জনক । দেশ ও জাতির জন্য এর সুরক্ষা আজ জরুরি।
লেখক : সিডনি প্রবাসী কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট