দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ১৬ এপ্রিল, ২০২১ at ৭:৩৮ পূর্বাহ্ণ

মারি মহামারি অপতাণ্ডবেও
অপরাজেয় স্বদেশ

কঠোর লক ডাউনে দেশ। মতান্তরে ঢিলে ঢালা লকডাউন। যেটাই হোক মানতে হবে অবস্থা খারাপ।এ জন্য বহুকিছু দায়ী। সরকারি বেসরকারি গোঁয়ার্তুমি জেদ উদাসীনতা ও জনগণের বেপরোয়া মনোভাব। অভাবের কথা কাজের কথা কাজ হীনতার সব কথাই মানলাম। কিন্তু কঙবাজার কারা গেছিলেন? কারা পাগলের মতো পিকনিক সমাবেশ দাওয়াত বিয়ে নিয়ে পাগল ছিলেন? সবমিলিয়ে এক ভয়াবহ বাসতবতা।
আজকের বাংলাদেশে করোনা যখন আবার তার থাবা মেলেছে তখন করোনার লকডাউন ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠতে চাইছে মামুনুল হকের নামের একজন। যে চেতনা আর আদর্শকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধ আজ তার আভা প্রায় অস্তমিত। এ যেন এক অভিশাপ। বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙা দেশময় অশান্তি নৈরাজ্য সৃষ্টি কারীদের ও মানুষের একাংশ সমর্থন করে। তারা অপরাধ প্রবণ হয়েও ছাড় পেয়ে যায়। কারো ব্যক্তিগত চরিত্র হনন কিংবা স্খলন দিয়ে আমরা কি করবো? আমাদের প্রয়োজন শান্তি। তাই ৫০ বছরে দাঁড়ানো দেশের সামনে মূল এজেন্ডা হয়ে ওঠা উচিৎ মামুনুল হকের চরিত্র না বরং তাদের অনৈতিক কাজ আর দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড।এই দেশ এই পতাকা মাটিকে না মানা এরা এখনো সচল। এদের আক্রমনে আজ জাতির সংস্কৃতি দিশাহারা। আমরা ভুলে যাচ্ছি এদেশের গর্বিত ইতিহাস।
নব্য ধনী লুটেরাদের হাতে পড়ে দেশের চেহারা আজ বিকৃত। সবচেয়ে বেশী ঝুঁকির মুখে সুস্থ স্বাভাবিক চেতনা আর আদর্শ। এই ভাবে কি আসলেই অনেকদূর যাওয়া সম্ভব? আমি মনে করি বাংলাদেশে অপরাজনীতি আর অপধারার বদলে যদি সঠিক ধারা ফিরে আসে বা সত্যিকার ইতিহাস ও একমুখিনতা বাদ দিয়ে সর্বজনীন ইতিহাস আর গৌরব ফিরিয়ে আনা যায় তবেই মামুনুল হকেরা পরাজিত হতে বাধ্য। সে কারণে ইতিহাস আর অতীত জানা জরুরি।
৫০ বছরে দাঁড়িয়ে স্বদেশ। আমার জন্মভূমি বাংলাদেশ। আমার বালক বেলায় পরাধীনতার গ্লানি মোছানো মায়ের মুখ। আমি একাত্তর দেখেছি। আমি নিজে পরিবারসহ শরণার্থী হয়েছিলাম। আমি দেখেছি বাঙালি মা বাবা ভাই বোন কেমন করে থাকতেন কলাকাতর অদূরে সল্টলেকের পানির পাইপের ভেতর। মাথার উপরে ছাদহীন ঘরে থেকেছি আমরাও। তখন আমরা শরণার্থী হলেও আমাদের মাথার ওপর ছিলেন বঙ্গবন্ধু। নেতার দায়িত্বে ছিলেন মরহুম সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন আহমেদ, তাঁদের সঙ্গীরা। সহজ ছিলো না এই যুদ্ধ। আজ মুখে মুখে আমরা যাই বলি না কেন সে যুদ্ধ ছিলো ভয়ংকর। একদিকে আমেরিকা চীন আর তাদের বন্ধু পাকিস্তান।অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধার দল, ভারত আর রাশিয়া। সে লড়াইয়ে আমরা না জিতলে ইতিহাস হতো ভিন্ন। হয়তো দুনিয়া থেকেই চলে যেতো বাঙালি নামের এক জাতি। অথবা বাঁচতে হতো আত্মসম্মান মর্যাদাহীন এক দাস জাতি হয়ে। স্যালুট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযোগী নেতাদের। স্যালুট জানাই সে সব ছিন্নবস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের যারা দু বেলা না খেয়েও যুদ্ধ করেছিলেন। যাঁদের রক্তে ত্যাগে আজ আমরা স্বাধীন দেশের গর্বিত নাগরিক।
দেশ স্বাধীন হবার পরও ষড়যন্ত্র থামে নি। কতো ধরনের ষড়যন্ত্র। পাকিস্তান তখনো মনে প্রাণে বিশ্বাস করছে তাদের ভাষায়, গাদ্দার ভিখারী কালো বাঙালিরা কোনদিনও দাঁড়াতে পারবে না। পারবে না মাথা তুলতে। উগ্র ভুট্টো তখনো সমানে চক্রান্ত করে যাচ্ছেন। দেশের ভেতর সক্রিয় মাওবাদী নামে চৈনিক রাজনীতির সমর্থকেরা। তাদের পেছনে জোট বেঁধেছিল স্বাধীনতা বিরোধীরা। কোথা থেকে অস্ত্র পেতো কোথায় টাকা সে সব ষড়যন্ত্র ধীরে ধীরে উন্মোচিত হলেও তখন আমরা বুঝতাম না। এরপর শুরু হয়েছিল জাসদের রাজনীতি। সে আরেক অধ্যায়। জাসদ নিয়ে কিছু বলাও মুশকিল। জাসদ ও তার আদর্শ মরে ভূত হলেও তাদের সমর্থক ফলোয়াররা আছেন। নকশাল আন্দোলন দেখা তরুণ আমি। আমার আত্মীয়দের অনেকে সে আন্দোলনে যোগ দিয়ে পরে ফিরেছিলেন সাধারণ জগতে। আমি একসময় ভারতে গজিয়ে ওঠা আনন্দমঠের আনন্দমার্গীদেরও দেখেছি। সেসব ব্যর্থ আন্দোলনের নায়ক খলনায়ক কিংবা সমর্থক পথ হারানো কর্মীরা সব আগুন নিভে যাবার পর আর এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করতেন না। কিন্তু আমাদের জাসদ থামতে নারাজ। এখন তাদের বেশীরভাগ আওয়ামী জোটে ভিড়লেও উল্টোদিকে আছে অনেকে। স্বাধীনতার পঞাশ বছরে জাসদের ভুল ভ্রান্তি মনে না রাখলে ইতিহাস থেকে যাবে বিতর্কিত। এদের কথা শুনলে এদেশ এগুতে পারতো না। আমরা থাকতাম আফ্রিকার কোন কোন দেশের মতো জঙ্গলময় সমাজে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সামরিক শাসন এক অনিবার্য ব্যাধি হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর জিয়াউর রহমান তারপর একের পর এক ক্যু। তখনকার টাইমস আমাদের দেশের নাম দিয়েছিল ‘দ্যা ক্যু ক্যু ল্যান্ড’। দেশের কাঁধে সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসা এরশাদ দেশে দুর্নীতি আর বিচারহীনতা প্রাতিষ্ঠানিক করে দিয়েছিলেন। সে জায়গা থেকে বেরুতে সংগ্রাম আর রক্তপাত দেখেছেই আমরা। কিন্তু এখানে একটা কথা বলতেই হয় মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ত্যাগ আর জীবনদান ইতিহাস এখনো সেভাবে ধারণ করে না। যখন যে সরকার তাদের ইচ্ছেমতো বদলে দেয় ইতিহাস। বাংলাদেশে একাধিকবার দেশশাসনে থাকা বিএনপি ষড়যন্ত্র আর পাকি ধারার প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে গিয়ে না পারলো দেশের উন্নতি করতে না পারলো নিজেদের ঘর ঠিক রাখতে। চরম সৌভাগ্য জাতির ওয়ান ইলেভেনের মাধ্যমে তারা অপসারিত হবার পর দেশ শাসনে এসেছিল আওয়ামী লীগ।
ঠিক তখন থেকেই পাল্টে যেতে থাকলো দেশ। বলাবাহুল্য ততোদিনে বিশ্ব রাজনীতি অর্থনীতিতে লেগেছে নতুন হাওয়া। বিশ্বায়নের হাওয়ায় সব দেশ সব জাতি বসবাস করতে শুরু করেছে গ্লোবাল ভিলেজে। হঠাৎ খুলে যাওয়া পৃথিবীর জানালায় মূক রাকা এই অনুন্নত গরীব নামের দেশটির প্রয়োজন ছিলো এক সঠিক নেতার। দরকার ছিলো বলিষ্ঠ কোমল আর দেশ দরদী ভূমি সন্তানের। সে মূহূর্তে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশ শাসনে এলেন যেন প্রকৃতির এক উপহার। তিরতির ঢেউয়ে বয়ে যাওয়া তরতর করে চলা নৌকা বাংলাদেশকে নিয়ে চললো সামনের দিকে।
এটাই আজকের বাংলাদেশ। আজ সব অপসংস্কৃতি দুর্নীতি সামাজিক অন্যায়ের পরও মাথা তুলে আছে স্বদেশ। তার শির নেহারি নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রীর। এতো রক্ত ত্যাগ অপমান আর দু:শাসনের জবাব দিয়েছে মাটি। ইতিহাস হয়েছে শুদ্ধ। জাতি হয়েছে পরিশুদ্ধ। আজকের বাংলাদেশ আজকের নতুন প্রজন্ম জানেই না কাকে বলে পরাধীনতা। এই দেশ এই পতাকা এই অর্জন হোক সকলের। দল মত ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশ হোক সবার। কোন শক্তি অপশক্তি পরাশক্তি যেন থাবা বিস্তার করতে না পারে। জয়তু বাংলাদেশ।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধনুসরাত ফারিয়ার রমজান স্মৃতি