দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ৮ অক্টোবর, ২০২১ at ৭:৩০ পূর্বাহ্ণ

রোহিঙ্গাদের অভয়ারণ্য ও সাবধানতা

সমপ্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিহত হয়েছেন তাদের এক নেতা। মিডিয়া বলছে শীর্ষ নেতা। সংবাদটি পাঠ করেই এগুনো যাক: কক্সবাজারের উখিয়ায় কুতুপালং ক্যাম্পের ভেতরে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গুলিতে রোহিঙ্গাদের একজন শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ মারা গেছেন।
ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটলিয়ন ১৪’এর কমান্ডিং অফিসার পুলিশ সুপার নাইমুল হক এই তথ্য নিশ্চিত করেন। মুহিবুল্লাহর স্ত্রী’র বরাত দিয়ে মি. হক জানান, বুধবার রাত সাড়ে আটটার দিকে কুতুপালং শিবিরে তার বাড়িতে চার-পাঁচজন লোক এসেছিলেন। মি. মুহিবুল্লাহকে চার-পাঁচ রাউন্ড গুলি করা হয় বলে তার স্ত্রী্থর বরাত দিয়ে মি. নাইমুল হক জানান। একজন শীর্ষ নেতা থাকা মানে তাদের আরো নেতা আছে। নিশ্চয়ই তাদের অনুসারীরা আছে। আছে অন্যদলের নেতারাও। এই যে নেতাগিরি এর ভিত্তি কি? আমরা যদি একাত্তরে ফিরে যাই তাহলে দেখবো, শরণার্থী জীবনে আমাদেরও নেতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তো মাথার ওপর ছিলেনই । কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আমাদের দিকভ্রান্ত জাতিকে সামাল দিয়েছিলেন চার নেতা নামে খ্যাত চারজন নেতা। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীনের মতো নেতা না থাকলে তাজউদ্দীনের মেধা আর সাহস না থাকলে আমাদের স্বাধীনতা কতো প্রলম্বিত হতো বলা মুশকিল। কিন্তু তাঁরা কোন শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়ে নেতা হননি। তাঁদের জীবনই ছিলো রাজনীতি। ধারাবাহিক সংগ্রামে বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ বোনা হয়ে গেছিল ১৯৫২ সালে। রোহিঙ্গাদের কি তেমন কোন ইতিহাস তেমন কোন নেতা আছেন? এ পর্যন্ত আমরা কি তার কোন সন্ধান পেয়েছি? না আমরা জানতে পেরেছি তেমন কোন নেতৃত্বের কথা? তাহলে একটা প্রশ্ন রেখেই এগুতে হয়, এরা কি ধরনের নেতা বা কোথা থেকে উদিত হয়ে কি চেয়েছিলেন? যার কারণে প্রাণ দিতে হলো।
শুরুতে এটা বলবো আমাদের আবেগ সবসময় বাঁধভাঙ্গা। সেটা ব্যক্তিগত জীবনে লাভ লোকসান যাই করুক জাতি বা রাষ্ট্রের জন্য অগ্রহণযোগ্য। সে ভয়াবহ আবেগের সাথে যুক্ত হয়েছিল ধর্ম। আর যায় কোথায়? পারলে মাথায় নিয়ে নাচি আমরা। সামাজিক মিডিয়া জুড়ে হাহাকার আর রোহিঙ্গা নারীদের দরকার পড়লে বিবাহ করার আকুল আবেদনে ভেসে যাওয়া সমাজ জানলেও মানেনি যে নিজেদের জন্য এক বড় ধরণের বিপদ টেনে আনছি আমরা। শুধু নিরীহ বা রাজনীতি না জানা সাধারণ মানুষ কেন আমাদের শীর্ষ পর্যায়েও ছিলো আবেগের ঢল। এমনও বলা হয়েছে বাঙালি নাকি একবেলা খেয়ে আরেক বেলা উপোস থাকলেও রোহিঙ্গাদের জায়গা দেবে। একবারও কেউ বলেনি ভাবেনি এদের রাখার চাইতেও বড় সমস্যা এদের প্রত্যাবর্তন। আর তাও এমন একটি দেশের সাথে যাদের সরকার নোবেল জয়ী সরকার প্রধান নেতাকে ঘরে বন্দী রেখে মৃত্যুর সময় তাঁর স্বামীর সাথে দেখা করতে দেয় নি। এখন তাঁকে এমন এক ঘরে রেখেছে যেখানে টয়লেট আর বিছানা পাশাপাশি।
এই সামরিক জান্তাকে মোকাবেলা করার জন্য দরকার বুদ্ধি কূটনীতি আর আন্তর্জাতিকতা। তার একটাও পালন করিনি আমরা। আজ দেখছি সরকারী দল ও বুদ্ধিজীবীদের একাংশ দায়ী করছেন আমেরিকা চীনসহ নানা শক্তিকে। এই আমাদের আর এক রোগ। জঙ্গি ধরা পড়লে বলি এক দেশের উস্কানী চোর ধরা পড়লে বলি আরেক দেশের নাম। ছেলেবেলা থেকে পাশের দেশ দূরের দেশ আমেরিকা রাশিয়া চীন এদের দোষ দিতে দেখে বড় হওয়া আমরা জেনেছি এটা হলো দুর্বলের কাজ। সে নিজে যখন কিছু পারে না তখন অন্যের ওপর দোষ চাপায়। কোন দেশ বলেছিল এদের বুক পেতে নিতে? কারা আমাদের বলেছিল এদের নিয়ে মাতামাতি করতে? তখন তো তুরস্কের ভূমিকাই ছিলো বেশী। তাদের নাম বলে না কেউ কিন্তু কেন? উত্তর সবারই জানা। রোহিঙ্গা সমস্যা আমাদের ভুল রাজনৈতিক সিদ্বান্তের ফল। এর কুফল ভোগ করতে হবে দীর্ঘকাল।
সোজা কথা হলো আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানি ঐ এলাকা কক্সবাজার থেকে টেকনাফ বিশেষ করে গহীন অরণ্যের এলাকাগুলো দীর্ঘকাল থেকেই সন্ত্রাসের আখড়া। সেখানে ট্রেনিং অস্ত্র চোরাচালানের কথা সবাই জানেন। টেকনাফের অবসহা এমনই নেতার নাম পর্যন্ত হয়ে গেছে মাদকের নামে। তাহলে কি করে ভাববো যে সে এলাকায় বসবাসরত আশ্রয়হীন লেখাপড়া না জানা সংস্কৃতি রুচি বর্জিত একদল নিরীহ মানুষ বা তাদের ভেতর ঘাপটি মারা শয়তানেরা ভালো থাকবে? আমাদের সমাজকে ভালো রাখবে?
দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কোটি কোটি হাজার কোটি টাকার খোয়াবে মশগুল সমাজের গডফাদারেরা এদের ওপর ভর করবে এটাই স্বাভাবিক। চট্টগ্রাম গিয়ে শুনি সেখানকার মাদক ও নেশার জগত এখন রোহিঙ্গাদের দখলে। দখলে বলতে সাপ্লাই আসার পর বিতরণ করে বিক্রি করানো হয়ে এদের তরুণদের দিয়ে। সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেন অসহায় ও একরোখা এদের তরুণ তরুণীদের টাকা দিয়ে বশ করা সহজ। আরো একটা কথা সবাই স্বীকার করেন এরা নাকি অপরাধপ্রবণ। এর প্রমাণ আমি সিডনিতেই দেখেছি। এখানে ও কিছু শরণার্থী নামের উদ্বাস্তু বাংলাদেশ দূতাবাসের কোন কোন কর্মচারীর সহায়তায় জাল পাসপোর্ট নিয়ে ঢুকে পড়েছে। সাথে শরনার্থী হিসেবে আসা জেনুইন রোহিঙ্গাও আছে। তারা প্রকাশ্যে রাস্তায় এদেশের নিয়ম ভেঙে মারামারি করে। আমি নিজেই তা দেখেছি। পুলিশের তৎপরতা আর চটজলদি ব্যবস্থা নেবার ফলে এরা বেশীদূর এগুতে পারেনি। কিন্তু এটাই তাদের প্রকৃতি।
তাদের দোষ দিয়ে লাভ নাই। এরা মিয়ানমারের অবহেলিত পশ্চাৎপদ এক জনগোষ্ঠী। তারা পারেনি মূলধারায় ভিড়তে। পারেনি নিজেদের গড়ে তুলতে। আজ যখন বাংলাদেশের রাজনীতি আবেগ হারিয়ে সত্য দেখছে তখন অস্থির করছে। মরিয়া হয়ে উঠেছে এদের বিদায় করার জন্য। কিন্তু পানি তো গড়িয়ে গেছে অনেক দূর। বলও চলে গেছে কোটের বাইরে। এসব মানুষেরা কতোটা ভয়াবহ হতে পারে তার নমুনা কিন্তু মাঝে মাঝেই দেখা গেছে। নিজেদের ভেতর মারামারি বাঙালি জনগোষ্ঠীকে নিজভূমে মার দেয়া এবং জায়গা বুঝে সংখ্যাগুরু হয়ে ওঠার পরও সবাই চুপ ছিলেন। এখন এটা মানতেই হবে এদের ফিরিয়ে দিতে যতো দেরী হবে ততোই বাড়বে মাদক নেশা আর মারামারি। আমাদের নিজেদের মানুষজন বা জনগোষ্ঠীই ঠিকমতো পড়াশোনা করে না। আমাদের শিক্ষার হার খুব লোভনীয় কিছু না। যে এলাকায় রোহিঙ্গাদের বসবাস সেসব এলাকায় দুটো বিষয় মারাত্মক ভাবে চোখে পড়বে। লেখাপড়ার অভাব আর নারীদের পিছিয়ে থাকা। নারীদের সেখানে বাংলাদেশের অন্য এলাকার মতো সম্মান আর ন্যায্য পাওনা দেয়া হয় কিনা তার জন্য গবেষণার দরকার নাই। কাজেই রোহিঙ্গা নারীদের কি হবে বা হতে পারে তাও অনুমান করা কঠিন না। সে পথেই চলেছে পরিস্থিতি। নেশা সন্ত্রাস আর দাঙ্গার অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে এলাকা। দুর্ভাবনা এটাই যেন এই আগুন এই দাবানল ছড়িয়ে না পড়ে বাংলাদেশের সর্বত্র। খাল কেটে কুমির আনার ইতিহাসে শীর্ষে থাকি সবসময়। রোহিঙ্গাদের সময়মতো আন্তর্জাতিক চাপ তৈরী করে ফেরত পাঠাতে পারিনি আমরা।
এখনো সময় আছে। সবকিছু আরো একবার বিপদে পড়া আর নষ্ট হবার আগে তাদের দ্রুত ফেরত পাঠাতে হবে। কথায় কাজ না হলে আমাদের কূটনীতি চাপ তৈরি করবে। আর তা যদি না পারে তা হলে একটা সময়সীমা অন্তত থাকতে হবে। এগুলো ঠিক করার বিকল্প নাই। আবেগ সরিয়ে মগজ আর ভবিষ্যৎ যেন সমাধান করে এই সমস্যার।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধআধ্যাত্মিক ও নৈতিকতার সংকট এবং হযরত শাহজাহান (রহঃ)-এর শিক্ষা
পরবর্তী নিবন্ধবিয়ে বাড়িতে দই নিয়ে ক্ষোভ কনের বাবাকে পিটিয়ে হত্যা!